‌জিন্দেগি কা সফর

কুন্তল আচার্য

তখন সবে ফিল্মে হাত পাকাচ্ছেন। পরিচালকের যা হয়, যাই দেখেন, তাই নিয়েই সিনেমা বানাতে ইচ্ছে করে। সন্দীপ রায়ের ইচ্ছে হল, কিশোর কুমারকে নিয়ে যদি কোনও ছবি বানানো যায়।

গাঙ্গুলি পরিবার আর রায় পরিবারের সম্পর্ক অনেকদিনের। সত্যজিৎ রায়কে মানিকমামা বলতেন কিশোর। মাঝে মাঝেই আসতেন। বম্বে গেলে সন্দীপ উঠতেন কিশোর কুমারের বাড়িতেই। অমিতের সঙ্গে গল্প আড্ডায় কেটে যেত রাত। কাছ থেকে দেখেছেন কিশোরের নানা কর্মকান্ড। একদিন ছবি করার কথা অমিত কুমারকে বলেই ফেললেন। অমিত বললেন, বাবা যা ব্যস্ত মানুষ, বাবাকে নিয়ে ছবি করা মুশকিল।

ইচ্ছেটা মনের মধ্যে থেকেই গিয়েছিল। হঠাৎ করেই কার্যত বিনা নোটিশে চলে গেলেন কিশোর। সন্দীপ রায় নেমে পড়লেন তথ্যচিত্রের কাজে। গেলেন একের পর এক দিকপাল মানুষের কাছে, যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন কিশোরকে। ছবির নাম ‘জিন্দেগি কা সফর’। ইউ টিউবে বিভিন্ন অংশ চাইলেই দেখা যায়। সেই ছবিতে ক্যামেরার সামনে কে কী বলেছিলেন ? আসুন, একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক ।।

সত্যজিৎ রায়
আমার চারুলতা ছবিতে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। খালি গলায় কিশোরকে দিয়ে রেকর্ড করাব ভাবলাম। ওকে বলতেই এক কথায় রাজি। তবে একটাই শর্ত, ও বলল রেকর্ড বম্বেতে হলে ভাল হয়। তাই হল। বম্বেতেই রেকর্ডের ব্যবস্থা করলাম। কিশোরকে আবার গাওয়ালাম। এবার ঘরে বাইরে ছবিতে। সেখানে তিনটি রবীন্দ্র সঙ্গীত। একটা কথা সবার জানা দরকার। এই গানগুলি গাইতে কিশোর এক টাকাও নেয়নি।

সুনীল দত্ত
সিনেমা করতেন, প্লে ব্যাক করতেন। আমার মনে হল, এই লোকটাকে দিয়ে যদি মঞ্চে গাওয়ানো যায়, তাহলে কেমন হয়। বললাম, গুরুজি, একবার ভাবুন তো, পাহাড়ে বরফের উপর দাঁড়িয়ে জওয়ানরা আপনার গান শোনে। তারা যদি আপনাকে সামনে থেকে দেখে, তাহলে কত ভাল হয়! কিছুটা নার্ভাস ছিলেন। রিহার্সাল হল। নিয়ে গেলাম নাথুলা সীমান্তে। আমি বললাম, আমি সামনে থাকি, আপনি পেছনে দাঁড়িয়ে গেয়ে যান। কিশোরদা ধরলেন, ‘মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে / এক চাঁদ সা টুকড়া র্যালহতা হ্যায়’। জওয়ানরা ভাবছিল, হয়ত আমিই গাইছি। অমনি আমি সামনে থেকে সরে গেলাম। কিশোরদাকে দেখে সে কী হাততালি! থামতেই চায় না। কিশোরদা বললেন, এত ঠান্ডায় জওয়ানরা দাঁড়িয়ে আছে, আমি গান গাইতে পারব না! একের পর এক গান গেয়ে শোনালেন। সেই শুরু, তারপর স্টেজেও মাতিয়ে গেলেন দেশের নানা প্রান্তে, এমনকি দেশের বাইরেও। কিশোরদাকে নিয়ে যদি সত্যিই কোনও ইতিহাস লেখা হয়, তাতে আমার নামও থাকবে। আমিই তো প্রথম স্টেজে গাইয়েছিলাম।

kishore kumar2

কল্যাণজি
স্টেজ শো করার ব্যাপারে কিশোরদাকে অনেকবার বলেছি। উনি বারবার বলেছেন, এত লোক থাকবে। তাদের সামনে গান গাওয়া সম্ভব নয়। তাঁকে বোঝালাম, আপনি কাদের ভয় পাচ্ছেন ? যারা দর্শকাসনে বসে থাকবে, তারা কেউ তো আর গুলাম আলি, লতা মঙ্গেশকার বা মহম্মদ রফি নয়। আপনি তাদের ভয় পাচ্ছেন? কথাটা ওর মনে ধরল। বললেন, গাইব। এমন গাইলেন, সবাইকে পাগল করে দিলেন।
সলিল চৌধুরি
কিশোরের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ভারি মজার একটা কান্ড ঘটেছিল। কিশোর আর লতার একটা ডুয়েট গান ছিল। কোনও একটা কারণে লতাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। বোধ হয়, বাইরে ছিল। রেকর্ডিংয়ের ডেট ঠিক করা যাচ্ছিল না। কিশোর বলল, দাদা একটা উপায় আছে। আমি যদি লতার গানটা গেয়ে দিই! যদি মেল, ফিমেল দুটো ভয়েসই আমার থাকে! আমি ভাবলাম, হয়ত মজা করছে। পরে বুঝলাম, ও সত্যি সত্যিই এমন প্রস্তাব দিচ্ছে। বললাম, ঠিক আছে। গেয়ে দেখাও। আমাকে অবাক করে দিল। ও সত্যি সত্যিই মেয়ের গলায় গাইল। সিনেমায় দুটো কণ্ঠই ছিল কিশোরের। দুটো একসঙ্গে গেয়েছিল। এটা বোধ হয় ওর পক্ষেই সম্ভব।

আর ডি বর্মন
বাবার কাছে আসতেন। আর আমার সঙ্গে গল্প করতেন। বলতেন, পঞ্চম, এই লোকটা চলে গেলে আর এমন লোক পাওয়া যাবে না। বাবার সুরে কিশোরদার শেষ গান ছিল মিলি ছবিতে – ‘বড়ি শুনি শুনি হ্যায়।’ কিন্তু রেকর্ডিংয়ের আগেই বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। কিশোরদা দেখতে গেলেন। বাবার হাতটা ধরে বললেন, কাল রেকর্ডিং। দেখবেন কেমন গাই। সত্যি সত্যিই দারুণ রেকর্ডিং হল। কিন্তু বাবাই শুনে যেতে পারল না ।

অশোক কুমার
মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড ঘটাত। কেউ হয়ত কখনও ওকে কিপটে বলেছিল। ও পাল্টা কিছু বলেনি। একবার সবাইকে বলল, চলো অজন্তায় ঘুরে আসি। ওর নাছোড়বান্দা আবদার। না গিয়ে উপায় নেই। শুধু আমরা নই, মোট বারোটা পরিবারকে নিয়ে গেল। নিজেই গাড়ি ভাড়া করল। যাদের গাড়ি ছিল, তাদের গাড়িতে পেট্রোল ভরে দিল। দশটা গাড়িতে করে আমরা গিয়েছিলাম। অজন্তায় হোটেলের ঘর ও আগেই বুক করে রেখেছিল। সবাইকে অজন্তা ঘোরাল, ইলোরা ঘোরাল। কাউকে কোনও খরচা করতে দিল না। ফিরে আসার পর বলল, এবার থেকে আমাকে আর কেউ কিপটে বলবে না।
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.