রফি সাহেবকে এই প্রজন্ম কতটা মনে রেখেছে!‌

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

করোনা ভাইরাসের এই প্রকোপ এবং তার প্রতিকার হিসেবে লকডাউনের এই নিস্পন্দ জীবনের মধ্যে সেদিন বাজার থেকে ফেরার পথে একজনের বাড়িতে, মনে হয় কোনও মিউসিক সিস্টেমে বাজছিল শুনতে পেলাম ‘‌ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে, সুন দর্দ ভরে মেরে নালে’‌। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম দু-তিন মিনিট। গানটা অন্তত ৫০০ বার শুনেছি সেই টেপরেকর্ডার থেকে তিভি চ্যানেলে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ামে। আর আমি ঈশ্বরবিশ্বাসীও নই। তবুও কেন জানি না, ভোরবেলায় এই লকডাউনের থমকে যাওয়া জীবনপ্রবাহে গানটা একটা অন্যরকম ভাল লাগছিল। সেই সূত্র ধরেই মনে পড়ে গেল আগামীকালই ৪০ বছর অতিক্রান্ত, সেই স্বর্গীয় কণ্ঠস্বরের সুরলোক থেকে পরলোকে পাড়ি দেওয়ার। বলিউডের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী রফি সাহেবকে কি আমরা মনে রেখেছি, তাঁর বিদায়ের এত বছর পরে?

rafi2

আসলে মহম্মদ রফির সম্পর্কে যাই লিখি বা আলোচনা করিনা কেন, মনে হয় তাঁর অবদানের কাছে নগণ্য হয়ে গেল। তাঁর মতো কণ্ঠশিল্পী বা প্লে ব্যাক ভয়েস বলিউডে দ্বিতীয় কেউ তো নেই-ই, এমনকি অদূর ভবিষ্যতে কোনওদিন কেউ আসবেন কিনা সন্দেহ, বিশেষত যখন সময়ের দাবিতে গান আজ কানে শোনার থেকেও চোখে দেখার মাধ্যম হিসেবেই স্বীকৃত হয়েছে। সঙ্গীত আজ আর আদৌ সাধনার বিষয় আছে কিনা, তা নিয়েও বিতর্ক কম নয়। কিন্তু রফি সাহেব যা দিয়ে গেছেন সঙ্গীতের জগতে, তা আজও প্রবল দাবদাহের মধ্যে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাসের মতোই কানে সুধা বর্ষণ করে।

১৯৪৯ সালে ‘‌দুলারী’‌ ছায়াছবিতে নৌশাদ আলির সুরারোপে গাওয়া ‘‌সুহানি রাত ঢল চুকি’‌ মহম্মদ রফির সাঙ্গীতিক জীবনে একটা মাইলস্টোনই বলা যায়। তারপরে ১৯৫২ তে সেই ঐতিহাসিক ছবি ‘‌বৈজু বাওরা’‌। এই ছবির সঙ্গীতকার ও সুরের বাদশা নৌশাদ। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই ছায়াছবিতে নায়ক ভরতভূষণের ঠোঁটে গান করার জন্য নৌশাদ প্রথম কিন্তু ভেবেছিলেন তালাদ মাহমুদকেই। কিন্তু শোনা যায়, একদিন রিহার্সালের মাঝপথে তালাত সাহেবকে ধূমপান করতে দেখে নৌশাদ নাকি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁকে বাদ দিয়ে দেন। বিকল্প হিসেবে নিয়ে আসেন মহম্মদ রফিকে। বাকিটা ইতিহাস। দিনের পর দিন রিহার্সাল করিয়ে একজন শিল্পীর সেরাটা বের করে এনেছিলেন সুরস্রষ্টা নৌশাদ। আর তার ফলেই ‘‌ও দুনিয়া কি রাখওয়ালে’‌, ‘‌মন তরপত হরি দরশন কো আজ’‌ ইত্যাদি মণিমুক্তার সৃষ্টি হয়েছিল। বলিউডে তৈরি হয়েছিল এক অপূর্ব সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীর মেলবন্ধন। তারপর ‘‌শবাব’‌ ছবিতে ‘‌আয়ে না বালাম’‌, ‘‌কোহিনুর’‌ ছবিতে হাম্বীর রাগে বাঁধা সেই বিখ্যাত গান ‘‌মধুবন মে রাধিকা নাচে’‌, ‘‌গঙ্গা যমুনা’‌ ছবিতে ‘‌নয়ন লাড় যায়ি রে’‌ –নৌশাদ-রফির জুটিতে সোনা ফলেছিল সব ছবিতেই। সেখান থেকে পরবর্তী প্রায় ৩০ বছর, দিন ঢল যায়ে, ইয়ে দুনিয়া আগর মিল ভি জায়ে তো ক্যায়া হ্যায়, মেরি বিনতি শুনো ভগবান, ‌এহসান তেরা হোগা মুঝপর, ‌দিওয়ানা হুয়া বাদল, ‌স সাল পেহলে, জো ওয়াদা কিয়া ও নিভানা পড়েগা, আভি না যাও ছোড়কর, বাহারো ফুল বরসাও, কেয়া হুয়া তেরা ওয়াদা– কালজয়ী গানের তালিকাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিল।

rafi3

সারা জীবনে কত হাজার গান যে রেকর্ড করেছিলেন মহম্মদ রফি তার কোনও সঠিক হিসেব মনে হয় নেই। এমন কোনও নায়ক মনে হয় নেই যাঁর লিপে রফির গান নেই। সেখানে দিলীপকুমার, দেব আনন্দ, গুরু দত্ত, সুনীল দত্ত, বলরাজ সাহানি থেকে শাম্মি কাপুর, রাজেন্দ্র কুমার, শশী কাপুর হয়ে পরবর্তী কালের সঞ্জীব কুমার, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন সকলেরই নাম থাকবে। এমন কোনও কমেডি চরিত্র নেই যিনি রফি সাহেবের গানে লিপ দেননি। প্রখ্যাত কৌতুকাভিনেতা জনি ওয়াকার তো বটেই, মেহমুদ, প্রেমনাথ, মুকরি—কেউ বাদ নয়। সেই সময়ের এমন কোনও সঙ্গীত পরিচালক নেই যিনি রফির মধুক্ষরা কণ্ঠকে কাজে লাগাননি। নৌশাদ, মদনমোহন, শচীন দেববর্মণ থেকে সলিল চৌধুরী, হেমন্ত কুমার, শঙ্কর-জয়কিশান থেকে রাহুল দেব বর্মণ, লক্ষ্মীকান্ত–‌পিয়ারিলাল অবধি একটা সঙ্গীতের যুগ থেকে আরেকটা যুগের পরিবর্তনকালেও রফি সাহেব সমুজ্জ্বল। নইলে সাতের দশকে যখন বলিঊদের গানের সংজ্ঞা অনেকটাই বদলে গেছে, যখন হিন্দি ছবির গানে পাশ্চাত্য বা ওয়েস্টার্ন সঙ্গীতের প্রভাব এসে পড়েছিল ব্যাপকভাবে, যখন সিনেমায় প্লে ব্যাক করতে গেলে শিল্পীকে অনেকটা দম লাগিয়ে গান গাইতে হত, সেইখানেও কিন্তু রফিসাহবের কণ্ঠ নিজগুণে প্রতিভাত হয়েছিল। তাই কিশোরকুমার যখন সাতের দশকে একের পর এক ছবিতে প্লে ব্যাক করছেন, তখনও কিন্তু ‘‌হাম কিসিসে কম নেহি’‌ ছবির ‘‌কেয়া হুয়া তেরা ওয়াদা’‌ বা ‘‌সুরজ’‌ ছবির ‘‌বাহারো ফুল বরসাও’‌, ‘‌কর্জ’‌ ছবির ‘‌দর্দ এ দিল,দর্দ এ জিগর’‌ অথবা ‘‌অভিমান’‌ ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের লিপে সেই বিখ্যাত গান ‘‌তেরি বিন্দিয়া রে’‌ আজও জনপ্রিয়তার নিরিখে সুপারহিট। দেশে যখন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জোর চেষ্টা চলছে, তখন তাঁর গান বুঝিয়ে দেয়, এই দেশে সম্প্রীতির শিকড় কতটা গভীরে। রামকে নিয়ে সবথেকে জনপ্রিয় গানগুলির একটি হল, ‘‌রামজি কি নিকলি সাওয়ারি/‌রামজি কে সেনা চলে’‌। সেই গানের গায়ক কিনা মহম্মদ রফি‌!‌

তাঁর কণ্ঠের একটা ঐশ্বরিক শক্তি ছিল যা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা এবং নিয়মিত অনুশীলন বা রেওয়াজ করেও মাধু্র্য কিন্তু একটুও হারায়নি। বলিউডে তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী মান্না দে’‌র শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা বা যে কোনও ধরণের গান গাওয়ার আশ্চর্য দক্ষতা থাকলেও কণ্ঠমাধুর্যে কিন্তু রফি সাহেব অনেক এগিয়ে। এই কারণেই নায়কের লিপে গান মানেই প্রথম পছন্দ ছিল রফি সাহবের কণ্ঠ। আর সেই কণ্ঠ দিয়েই কত ধরণের গানে যে তাঁর সহজাত মুনশিয়ানার প্রকাশ পেয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। সেখানে যেমন রোমান্টিক গান আছে, বিরহের গান আছে, তেমনি ক্ল্যাসিকাল, ভজন, গজল, কমেডি সং, দেশাত্মবোধক গান এমনকি মাতালের গানেও তাঁর কণ্ঠশৈলী আশ্চর্যভাবে বিকশিত হয়েছিল। বাংলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতোই বলিউডে মহম্মদ রফি ছড়িয়ে আছেন প্রতিটি সুরকার থেকে নায়ক, খলনায়ক, কৌতুকাভিনেতার সঙ্গেই। আর হিন্দি ছাড়াও পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাটি, তামিল, ভোজপুরী, অসমীয়া এমনকি বাংলাতেও নজরুলগীতি বা আধুনিক গানে তিনি ছিলেন স্বভাবসিদ্ধ সাবলীল। সব মিলিয়েই তিনি সুরেশ্বর। উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন।

প্রয়াণের ৪০ বছর পরেও কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, আসমুদ্রহিমাচল আপামর সঙ্গীতপ্রেমীর ঘরে ঘরে, মানসে, হৃদয়ে আজও বেজে চলেছে, ‘‌চাহুঙ্গা ম্যায় তুঝে সাঁঝ সবেরে/ ফির ভি কভি আব নাম কো তেরে/ আওয়াজ ম্যায় না দুঙ্গা’‌!

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.