(মুকুলকে নিয়ে আবার জোর জল্পনা। আবার পুরনো ঘরে ফিরে আসবেন? নাকি চাপ বাড়িয়ে যেখানে আছেন, সেখানেই থেকে যাবেন। বছর পাঁচেক আগেও তাঁকে নিয়ে এমনই জোরালো জল্পনা তৈরি হয়েছিল। যেন সোনার কেল্লার সেই মুকুল। পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বেঙ্গল টাইমসে লেখা হয়েছিল সোনার কেল্লা পার্ট টু। লিখেছিলেন রবি কর। সেই লেখা আবার প্রকাশিত হল।)
। ১।।
“ভালো লাগছে না রে তোপসে। ভালো লাগছে না”, বলল ফেলুদা।
তার মুখ গম্ভীর। কপালে গভীর খাঁজ। অবশ্য এখন তার যা বয়স, তাতে সারাক্ষণই মুখ গম্ভীর হয়ে থাকে। সারা মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। তাই কপালের গভীর খাঁজ আমি ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না।
ফেলুদা যখন দার্জিলিঙে প্রথম গোয়েন্দাগিরি করেছিল, তখন আমার বয়স ছিল সাড়ে তেরো। ফেলুদার তার ডবল। অর্থাৎ ২৭। সে আজ ৫০ বছর আগেকার কথা, অর্থাৎ এখন তার বয়স ৭৭। লোকে এখন তাকে ফেলুদাদু বলে ডাকে।
গত ২০ বছর সে কোনও কেস হাতে নেয়নি। হয়তো নিয়েছিল, কিন্তু আমাকে জানায়নি। কারণ আমি, মানে সোনার কেল্লার সেই তোপসে সিনেমা ছেড়ে এখন পদ্মফুলে। আর ফেলুদা বরাবরই লাল ঘেঁষা। কিন্তু মুকুলের কেসটা সমাধান করার জন্য আমাকে ডাকতেই হয়েছে। সিধুজ্যাঠা বলেছে, মনের দরজা জানলা খুলে রাখো ফেলু। বি জে পির মনে কী আছে তা জানতে না পারলে তুমি কখনই মুকুলের রহস্য ভেদ করতে পারবে না।
ফেলুদা বলল, “ কয়েকজন অত্যন্ত লোভী ও বেপরোয়া লোক মুকুলের ব্যাপারে একটু বেশি মাত্রায় কৌতূহলী হয়ে পড়েছে। তারা ভাবছে, মুকুল তাদের সারদার গুপ্তধনের হদিশ দিতে পারবে।“
“কিন্তু ফেলুদা, মুকুলের কাছে কি এখনও গুপ্তধন আছে? ”
আমার মাথায় একটা গাঁট্টা মেরে ফেলুদা বলল, মুকুলের কাছে না থাকলেও কার কাছে আছে, সেটা মুকুল জানে। তারা সেই গুপ্তধন নিয়ে কী করেছে সেটাও সে জানে। মুকুল ভবিষ্যতে কী করবে সেটা জানতে গেলে, তার অতীতটাও তো জানতে হবে। নইলে সবই তো উটের পাকস্থলী হয়ে যাবে।’
শেষের কথাটা ফেলুদা বলল লালমোহন গাঙ্গুলিকে উদ্দেশ্য করে। তিনি এই মাত্র পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। অনেক দিন তাঁর নতুন বই চোখে পড়েনি বলে আমি ভেবেছিলাম তিনি মারা গেছেন। কিন্তু ফেলুদা বলল, লালমোহনবাবু আজকাল আর জটায়ু নামে রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখেন না। ‘ভঙ্গুর হল সিঙ্গুর’, ‘নন্দীগ্রামের ফন্দি’ ইত্যাদি রাজনৈতিক উপন্যাস লেখেন। তাঁর লেখা সাম্প্রতিকতম উপন্যাস ‘ডেলো পাহাড়ের কেলো’ নাকি ২০ হাজার কপি বিক্কিরি হয়েছে। ফেলুদা আরও বলল, লালমোহনবাবু নাকি বুদ্ধিজীবী হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার মুছতে চান। তাই এথিনিয়াম ইন্সটিটিউশনের বাংলার মাস্টার বৈকুণ্ঠনাথ মল্লিকের কবিতা না আউড়ে আজকাল দিদিমনির কবিতা বলেন।
লালমোহনবাবু বললেন, “শুনবেন নাকি একটা!” বলেই হাত পা ছুঁড়ে, গলা ছেড়ে আবৃত্তি করলেন,
হংস বলাকা
জোটবদ্ধ
সব চলে সাথে সাথে
প্যাঁক প্যাঁক
দ্যাখ সবাই দ্যাখ
ফেলুদা একটা গলা খাঁকারি দিতে মাঝপথেই কবিতা বন্ধ হয়ে গেল।
।। ২।।
আমি বললাম, আচ্ছা ফেলুদা, এত বছর পরে তুমি হঠাৎ মুকুলকে নিয়ে পড়লে কেন?
হাঁটুর ব্যথার জন্য ফেলুদাকে আজকাল জিলাক্সো লাগাতে হয়। টিভিতে তার বিজ্ঞাপনও দেখায়। অতিকষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে একগাদা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন নিয়ে এল। বলল, মুকুলের বাবা সুধীরবাবু আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর ছেলেকে নিরাপদে ঘরে পৌঁছে দিতে। তাঁর অনুরোধেই আমরা রাজস্থানে গেসলুম। কিন্তু এই কাগজগুলো দ্যাখ। মুকুল আজও ঘর পাচ্ছে না। নিজাম প্যালেসে ছিল। কিন্তু এখন সেখানে তার থাকা না থাকা সমান। দিল্লির ঘর থেকে সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। উচ্চসভাতে ছিল সামনের সারিতে, এখন একেবারে পিছনে, তার নিজের ছেলে প্রণাম ট্রনাম করে পুরানো ঘরে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু মুকুল যেখানে আছে সেটা তার ঘর নয়। যেখানে যেতে চায় তারা দরজা বন্ধ করে রেখেছে। কখনও সে দার্শনিক হয়ে পড়ে, তখন বলে, ‘ক্রিজে পড়ে থাকলেই রান আসে।’ কখনও বলে, ‘সময় এর উত্তর দেবে।’ বাংলাতেই বলে। কিন্তু কী যে বলে, ঠিক বোঝা যায় না। এমন বাংলা, যা ল্যাটিন বা স্প্যানিশের থেকেও দুর্বোধ্য।
“আচ্ছা ফেলুবাবু, মুকুল কোথায় যাবে সেটা তো তাকে জিগ্যেস করলেই হয়’’ বললেন লালমোহনবাবু।
“আপনি যখন মুকুলকে দেখেছিলেন তখন তার বয়স ৮ বছর ৯ মাস। সরলমতি বালক। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। কিন্তু আজ সে বুড়ো দামড়া। মাথার চুল, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, সব পেকে গেছে। মনের ভেতরটা আরও বেশি পেকেছে। তাকে কিছু জিগ্যেস করলেই বলে সোনার কেল্লায় যাব। বুঝতেই পারি না এজন্মের কথা বলছে না গত জন্মের। তবু আপনি যখন বলছেন আজ বিকেলে তাকে নিয়ে একবার বেরব। ”
।।৩।।
লালমোহনবাবু নিজের অ্যাম্বাস্যাডারটার সবুজ রং পালটে নীল সাদা করেছেন। তাঁর ধারনা, যে শহরে বাড়ির রং নীল সাদা করলে কর ছাড় দেওয়া হয়, সেই শহরে গাড়িতে নীল সাদা রং করলে ট্র্যাফিক আইন ভাঙলেও পুলিশ কিছু বলবে না।
লালমোহনবাবু বললেন, আমরা কি ডেকয়েটসদের পিছু নেব?
“ডেকয়েটস, তবে আরবল্লির নয় খাস কলকাতার।”
‘ডেকয়েটসদের নিয়ে কিছু প্রশ্ন করা চলবে?”
“চলবে?”
“এরা কি রাজনৈতিক ডেকয়েটস?”
“সম্ভবত হ্যাঁ?”
“এরা কী খায়?”
“প্রধানত চিট ফান্ডের টাকা।”
“টাকা কি এরা বেছে বেছে খায়, না কি সব চিট ফান্ডের টাকাই খায়?”
‘ড্রাইভারসাব রোখকে রোখকে ’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
আমরা যাচ্ছিলাম ই. এম. বাইপাস ধরে। দেখি রাস্তা জুড়ে পোড়া কুপন ছড়িয়ে আছে। আর সেই রাস্তার পাশে জোড়াফুল আঁকা একটা বাড়ি। সে দিকে তাকিয়ে মুকুল ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। বলল, ওইটা আমাদের অফিস ছিল। ওখানে আমরা কুপন পোড়াতাম।
ফেলুদা মুকুলকে বলল, “এটাই কি তোমার সোনার কেল্লা? তুমি কি এই বাড়িতে থাকতে চাও?”
“এটা সোনার কেল্লা না। আমি সোনার কেল্লায় যাব।”
এরপর মুকুলকে নিয়ে আমরা গেলাম কয়লাঘাটায় রেলের সদর দপ্তরে, তারপর গেলাম গঙ্গার ধারে শিপিং কর্পোরেশনের অফিসে ( গতজন্মে মুকুল নাকি এই বাড়িগুলোতে কিছুদিন ছড়ি ঘুরিয়েছিল)। কিন্তু মুকুল কাঁদতে কাঁদতে বলল, কেন তোমরা আমাকে বারবার ভুল কেল্লা দেখাচ্ছ।
ভাবলাম, দিল্লিতে নিয়ে যাব। কিন্তু ইদানীং সেখানও সে যেতে চাইছে না। মুদিবাবুর সঙ্গে বৈঠক করেছে, কেটলির সঙ্গেও বার কয়েক বসেছিল। সবাই ঝোলাচ্ছে। নেব নেব করেও নিচ্ছে না। মুকুল এখন ওদেরকেও বলছে, ‘দুষ্টু লোক’।
।। ৩।।
শেষ চেষ্টা হিসাবে আমরা মুকুলকে ডেলোর পাহাড়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুকুল বলল একবার ওখানে গিয়ে ফেসেছে। আবার গেলে তাকে পাহাড় থেকে ফেলে ভ্যানিস করে দিতে পারে।
‘কে ভ্যানিস করে দেবে মুকুল?’
‘দুষ্টু লোক।’
মুকুলের দুষ্টু লোক কে? এজন্মের না আগের জন্মের সেটা বুঝতে না পেরে ফেলুদা হিপনোটিজম করার সিদ্ধান্ত নিল।
দুষ্টু লোক কে মুকুল ?
হাজ হাজ হাজ
লালমোহবাবু বললেন, মনে হয়, ডক্টর হাজরার কথা বলছে ।
“সোনার কেল্লা কোথায় মুকুল?”
“হা-হা-হা- ”
লালমোহনবাবু বললেন, “হালি শহর, কাঁচড়াপাড়া”
“শ-শ-শ”
“হাজ-হাজ-হাজরা”।
“তোপসে, লালমোহনবাবুকে গাড়ি বের করতে বল। ফেলু মিত্তিরের টেলিপ্যাথির জোর আজ বোঝা যাবে।’’ আমি বললাম, ‘ও কি ডাক্তার হাজরার কথা বলছে ? যাকে পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ?’ ফেলুদা বললেন, সময়টা বোঝার চেষ্টা কর। এখানে হাজরা মানে, ডক্টর হাজরা নয়, ও বলতে চাইছে হাজরা রোডের কথা। তার কাছাকাছি কোথাও গুপ্তধন থাকতে পারে।
হাজরার মোড়ে পৌঁছে লালমোহনবাবু বললেন, আচ্ছা ফেলুবাবু, হাজরার মোড়ে কি হাজার হাজার হাজরা থাকে ?’
ফেলুদা কোনও কথা না বলে, গাড়ি ঘোরাল চেতলা ব্রিজের দিকে। হরিশ চাটুজ্জে স্ট্রিট হয়ে গাড়ি থামল আদিগঙ্গার ধারে, একটা গলির সামনে। একটু দূরেই একটা টালির বাড়ি।
“চিনতে পারছ মুকুল?”
“সো-না-র কে-ল-লা।“
“আর তোমার বাড়ি?”
“আমার বাড়ি তো কাঁচড়াপাড়ায়। এটা সোনার কেল্লা। ওইদিকে ববির বাড়ি, ওইদিকে মদনের বাড়ি, আর ওইদিকে বক্সির বাড়ি। আমরা এখানে সাংবাদিক সম্মেলন করতাম। ”
“আর গুপ্তধন? গুপ্তধন কার কাছে আছে?”
মুকুল উত্তর দেওয়ার আগেই বিশাল ভুঁড়িওয়ালা একটা লোক, গায়ে ক্যাটক্যাটে সবুজ পাঞ্জাবি, মুখটা হুলোবেড়ালের মতো গম্ভীর, গলির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল।
“ফেলুদা দেখেছ, নকল ডাক্তার হাজরার মতো এর থুতনিতেও ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি আছে।
সেই ভুঁড়িওয়ালা- ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ির লোকটা মোবাইলে কাকে যেন বলছে, ‘সিবিআই নিয়ে চিন্তা নেই। সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘হাইলি সাসপিসাস’।
মুকুল এতক্ষণ কান্নাকাটি করছিল বলে লোকটাকে দেখতে পায়নি। ‘সিবিআই’ শুনেই মুকুল সেই লোকটার দিকে তাকাল। তার দিকে চোখ পড়তেই, তুমি দুষ্টু লোক, তোমার জন্যই আমি সোনার কেল্লায় ফিরতে পারছি না। তোমাদের জন্য পদ্মবাবুরাও আমাকে নিচ্ছে না। তোমরা দুষ্টু লোক, দুষ্টু লোক, বলতে বলতে গলির ভিতরে ছুটে গেল।
আমি, ফেলুদা আর লালমোহনবাবু তার পিছু পিছু ছুটলাম। “মুকুল, তুমি কোথায় মুকুল মুকুল…”
মুকুল কোথায় যে হারিয়ে গেল!
ফেলুদা বলল, ছেড়ে দে। ওকে বাড়িতে ফেরানো আমাদের কম্ম নয়। আমাদের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধি ওর আছে। ও নিজের বাড়ি ঠিক নিজে খুঁজে নেবে।