এই অমানবিকতার দায় কি সরকার এড়াতে পারে!‌

 

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

ঘটনা ১- আঠারো বছরের এক অসুস্থ তরুণকে নিয়ে একের পর এক হাসপাতালে যাচ্ছেন তার অসহায় বাবা ও মা। সরকারি ও বেসরকারি তিন থেকে চারটে হাসপাতালে বেড নেই বা পরিকাঠামো নেই শুনে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এসে যখন সেখানেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল, তখন অসহায় মায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। চোখের সামনে শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি না নিলে, তিনি সেখানেই আত্মহত্যা করার সংকল্প করেন। অতঃপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর মরণাপন্ন ছেলেকে ভর্তি নিতে বাধ্য হয়। সবশেষে আঠারো বছরের হতভাগ্য ছেলেটির মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর কারণ করোনা সংক্রমণ।
ঘটনা ২-প্রবল জ্বর এবং শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে থাকা এক রোগীকে বনগাঁ হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার সময় স্ট্রেচার বইতে এগিয়ে এলেন না কেউ। অ্যাম্বুলেন্সে তোলার জন্য কাউকেই পাওয়া গেল না। তাঁর স্ত্রীর বারংবার অনুরোধে ও কর্ণপাত করেননি কেউ। অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে মরণাপন্ন শরীরে নিজেই অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়ে মারা গেলেন ওই হতভাগ্য বৃদ্ধ। পুলিশ সুত্রে খবর, তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন কিনা বা তাঁর কোনও উপসর্গ ছিল কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে শুধু ভয়েই মৃত্যুপথযাত্রী ওই বৃদ্ধকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি কেউ। তার ফলেই ঘটে গেল এই মর্মান্তিক ঘটনা।

mamata30

এরকম অনেক উদাহরণ, অনেক দৃষ্টান্ত বিগত দু মাস ধরে কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী জেলাতে রয়েছে।করোনা সংক্রমণ ভারতবর্ষে এবং আমাদের রাজ্যে বাড়তে বাড়তে এখন গোষ্ঠী সংক্রমণের জায়গায় পৌঁছেছে। আর সে কারণেই এই “অজানিত আতঙ্ক” ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি মানুষ থেকে নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও।

আসলে এই আতঙ্কের কারণটা কী? এই রোগটা এতটাই সংক্রামক যে ১ জন থেকে ২ জন, ২ জন থেকে ৪ জন, ৪ জন থেকে ১০ জন এইভাবে বেড়ে যায়। সেই কারণেই আক্রান্তের থেকে দূরত্ব বজ়ায় রাখার চেষ্টা সকলেই কম-বেশি করছে। আর আমাদের রাজ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যা অবস্থা, তাতে কেউই আক্রান্ত হলে পরিষেবা বা পর্যাপ্ত চিকিৎসা যে পাবেন, এটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। সেজন্যই বিন্দুমাত্র উপসর্গ কোনও রোগীর মধ্যে দেখা গেলেই বা উপসর্গ না থাকলেও সামান্য জ্বর বা কাশি বা হাঁপানি থাকলেও তিনি করোনা আক্রান্ত এই বিশ্বাসটা অন্যদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে পড়ছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপরে উল্লিখিত দু্টো অমানবিক ঘটনায় দায়ী কে? শুধু কি স্বাস্থ্যকর্মী বা নার্স বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী? নিশ্চয় নয়। আমাদের রাজ্যে একটা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার আছে। সরকার কি তার দায় এড়াতে পারে? সরকারের কড়া নির্দেশ থাকলে কোনও হাসপাতাল, সে সরকারিই হোক বা বেসরকারিই হোক, কোনও অসুস্থ রোগীকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করতে পারে?

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই স্বাস্থ্যদপ্তর দেখেন। তিনিই স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তাঁর প্রধান দায়িত্ব এই অজানা ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণের কঠিন সময়ে প্রতিটি রাজ্যবাসীর নিরাপত্তা এবং উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। তিনি কি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন বা করছেন?

এইখানেই একটা বিশাল বড় গলদ। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন এই “কঠিন সময়ে”। তিনি কখনও রাস্তায় নেমে খড়িমাটি দিয়ে গোল গোল গন্ডী কাটলেন, কখনও আবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলে বসলেন, “করোনা কে পাশবালিশ করে নিশ্চিন্তে ঘুমোন”। এমনকি আজকেও শুনলাম তিনি নাকি বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আয়োজিত মিটিং এ বলেছেন, একমাত্র বাংলাতেই নাকি নিখরচায় করোনা রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে ! অথচ বাস্তব চিত্র বলছে, তাঁর রাজ্যেই করোনা আক্রান্তের চিকিৎসার খরচ আকাশছোঁয়া। মানুষের এই তীব্র জীবন সঙ্কট কালে চিকিৎসার নামে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চলছে রোগীর পরিবারকে আর্থিক দিক থেকে নিংড়ে নেওনার নির্লজ্জ চেষ্টা। শুধু তাই নয়, ১০ কিলোমিটার রাস্তা অ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে নিয়ে যেতে ভাড়া দিতে হচ্ছে প্রায় ন’হাজার টাকা। মুখ্যমন্ত্রী পারতেন না এই দুর্দিনে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নির্দিষ্ট করে দিতে? এবং কোনও চালক তার থেকে বেশি ভাড়া দাবি করলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের তরফে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে? তিনি পারেন না ঘোষণা করতে যে কোনও রোগী, করোনা আক্রান্তই হোক বা অন্য কোনও কঠিন অসুখে আক্রান্তই হোক, কোনও হাসপাতালের তরফেই তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না? যেহেতু চিকিৎসক দের সংক্রমণের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি, তাই মুখ্যমন্ত্রী পারেন না রাজ্যের সমস্ত চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের নিরাপত্তার দিকটা সুনিশ্চিত করতে? তাঁদের PPE KIT এবং মাস্ক আরও বহুল পরিমাণে সরবারাহের ব্যবস্থা করতে? নির্বাচনের আগে তিনি বাংলার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেন, রোগীর চিকিৎসার খরচ কমানোর নিদান দিতে, আর এই “দুঃসময়ে” তিনি পারেন না অনুরূপভাবে মিটিং করে অসহায় রোগীর পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করার পথ বন্ধ করতে ? তিনি সংবাদমাধ্যমে এসে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেন, ২১ জুলাই এর ভার্চুয়াল সভা থেকে আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনী প্রচার করেন, অথচ তাঁর শাসনেই প্রতিটি বঙ্গবাসী আজ মারণব্যধিতে বিপন্ন।

আসলে একটা নির্বাচিত সরকারের প্রশাসনিক প্রধানের থেকে মানুষ প্রত্যাশা করে জীবন সুরক্ষা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শান্তি। কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এইসব দিকে নজর দেন বলে মনে হয় না। তাঁর রাজ্যে হাজার হাজার যুবক-যুবতী বেকার। তাঁর রাজ্যে নারীর নিরাপত্তা নেই। তাঁর রাজ্যে রেশনে চাল-গম চুরি হয়। রাজ্যের সবকটি সরকারি হাসপাতালে নীল-সাদা রঙ করা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়। দেওয়ালে বড় বড় হোর্ডিং লেখা “সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল” এবং মুখ্যমন্ত্রীর ছবি সবকটা হোর্ডিং, ব্যানারে। এত আত্মপ্রচার করে পরিষেবার হাল এত রুগ্ন কেন? গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই ভগ্নচিত্র এবং মুমূর্ষু- মৃত্যুপথযাত্রী রোগী ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে চূড়ান্ত অসহযোগিতা এবং অমানবিকতার এই দায় মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সরকার কখনও এড়াতে পারে কি?

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.