সবুজ মেরুনের নতুন পথ চলা মধুর হোক

সোহম সেন

সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে কলকাতা এখন মেতে থাকত ফুটবল আবহে। নতুন মরশুমে দলগঠন, প্র‌্যাকটিস, কন্ডিশনিং ক্যাম্পের পর এতদিন রমরমিয়ে চলত কলকাতা লিগ। কিন্তু করোনা আবহে লিগও শুরু হয়নি। এমনকী, কলকাতার দলগুলির প্র‌্যাকটিসও শুরু হয়নি। দলগঠনের কাজটাও সেভাবে গতি পায়নি। ফুটবলপ্রেমীদের দৈনন্দিন চর্চা থেকে গত কয়েক মাসে ফুটবল যেন অনেকটাই নির্বাসিত।

এমনই একটা সময়ে সাড়াজাগানো ঘটনা কলকাতা ফুটবলে। এবার সরাসরি আই এস এলে খেলবে মোহনবাগান। ভিনরাজ্যের বা অন্য কোনও শহরের নামে নয়। একেবারে কলকাতার দল হয়েই তারা মাঠে নামবে। কারণ, মিশে গেল এটিকে কলকাতা আর ১৩১ বছরের ঐতিহ্যশালী মোহনবাগান। দুই দল মিলিয়ে এবার একটিই দল। তারাই অংশ নেবে আই এস এলে।

দুই দলের সংযুক্তিকরণের ঘোষণা হয়েছিল আগেই। এবার ক্লাবের জার্সি, লোগো চূড়ান্ত হয়ে গেল। এ টি কে মোহনবাগান ফুটবল ক্লাব নাম নিয়েই খেলবে নতুন দল। জার্সিতে যেমন সবুজ মেরুন রং থাকছে, তেমনি মোহনবাগানের ঐতিহ্যের প্রতীক সেই পালতোলা নৌকোও থাকছে। এ যেন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার যথাযথ মেলবন্ধন।

কলকাতা ফুটবলের পক্ষে নিঃসন্দেহে বড় একটা ঘটনা। মোহনবাগান নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাহেবদের হারিয়ে আই এফ এ শিল্ড জেতা থেকে শুরু করে কত বর্ণময় ইতিহাস। এবারও তারাই আই লিগে চ্যাম্পিয়ন। লকডাউনের জন্য লিগ শেষ হয়নি ঠিকই, কিন্তু পয়েন্ট তালিকায় তারা এতটাই এগিয়ে, যা অন্যদের ধরাছোঁয়ারও বাইরে ছিল। তাই ফেডারেশন মোহনবাগানকেই চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে। অথচ, এর পরেও আই এস এলে খেলার ছাড়পত্র আসছিল না। মোহনবাগানের ফুটবলার, কর্তা, সদস্য, সমর্থকদের মধ্যে একটা আক্ষেপ থাকারই কথা। সেই আক্ষেপ এবার মিটতে চলেছে। এই মরশুম থেকেই আই এস এলে দেখা যাবে কলকাতার এই ঐতিহ্যশালী ক্লাবকে। সেইসঙ্গে এএফসি কাপেও আরও বেশি শক্তি নিয়ে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পারে এ টি কে মোহনবাগান।

আসলে, আই এস এলে খেলতে গেলে যা যা শর্তপূরণ করতে হত, সেগুলি পূরণ করা মোহনবাগানের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। মূলত আর্থিক কারণেই বারবার পিছিয়ে যেতে হচ্ছিল। এমন সময় পাশে এসে দাঁড়াল এ টি কে। এ টি কে পরিচালনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, বাণিজ্যিকভাবে তাঁরাও কলকাতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িয়ে আছেন। আধুনিক ফুটবলে ঐতিহ্যের পাশাপাশি দরকার কর্পোরেট সংস্থার আনুকূল্য। সারা পৃথিবীতে এই মেলবন্ধনে এগিয়ে চলেছে ফুটবল। নানা কারণে সেই আনুকূল্য থেকে যেন বঞ্চিত হচ্ছিল মোহনবাগান। এবার সেই আনুকূল্য এসে যাওয়ায় আই এস এলে খেলতেও বাধা রইল না। দলগঠন থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক প্র‌্যাকটিস, মাঠ সব ব্যাপারেই এবার আরও আধুনিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যাবে, এমনটা আশা করাই যায়।

mohun bagan3

অন্যদিকে, এটিকে দল হিসেবে নতুন হলেও আই এস এলে তারা তিনবারের চ্যাম্পিয়ন। আই এস এলের প্রস্তুতি পর্বে বিদেশে অনুশীলন করতেও দেখা গেছে এই দলকে। দলের সঙ্গে কলকাতার নাম জড়িয়ে। কিন্তু এরপরেও গত কয়েক বছরে মাঠে সেভাবে দর্শক সমাগম হত না। পাশে মোহনবাগানকে পাওয়ায় কলকাতার মানুষের সমর্থন আরও বেশি করে পাওয়া যাবে। খবরে প্রকাশ, সঞ্জীব গোয়েঙ্কার হাতে থাকছে নতুন দলের ৬৮ শতাংশ শেয়ার। মোহনবাগানের হাতে প্রায় ২০ শতাংশ। উৎসব পারেখের হাতে থাকছে ৮ শতাংশ। ৪ শতাংশ থাকছে সৌরভ গাঙ্গুলির হাতে। এই দলের বড় একটা প্লাস পয়েন্ট সৌরভ গাঙ্গুলির উপস্থিতি। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সফল অধিনায়ক, ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সভাপতিকে পাশে পাওয়া নিঃসন্দেহে বড় এক প্রাপ্তি। তাঁর উপস্থিতিই মাঠের চেহারা বদলে দিতে পারে। সাধারণ জনতার কাছেও দলটার গ্রহণযোগ্যতা একলাফে অনেকটা বেড়ে যাবে।

খুশির পাশাপাশি আশঙ্কার একটা চোরাস্রোতও থেকে গেছে কারও কারও মনে। মোহনবাগানের হাতে থাকছে মাত্র কুড়ি শতাংশ শেয়ার। কোচ নিয়োগের ক্ষেত্রে বা দল গঠনে বা অন্যান্য ব্যাপারে ক্লাবের কতটা ভূমিকা থাকবে, তা নিয়েও সংশয়। মোহনবাগানের আবেগ ও ঐতিহ্যের প্রতি এখন শ্রদ্ধার কথা শোনা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে তাঁরা কতখানি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন, সেটা নিয়েও কোনও কোনও মহলে সংশয় আছে। বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর সঙ্গে মোহনবাগানের গাঁটছড়া অবশ্য এই প্রথম নয়। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্লাবের নামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ভিনরাজ্যের এক বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর নাম। তখনও নানা মহল থেকে আপত্তি এসেছিল। তবে মোহনবাগান তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেনি। এবারও মাত্র কুড়ি শতাংশ শেয়ার থাকার পরেও জার্সির রং বা লোগোতে মোহনবাগানের ঐতিহ্য ধরে রেখে যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছেন নতুন বিনিয়োগকারী সংস্থা। এমনটাই মনে করছেন প্রাক্তন ফুটবলাররা।

মোহনবাগান বললেই কলকাতার আরও এক বড় দল ইস্টবেঙ্গলের কথা অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে। কয়েক বছর আগে তারাও এক বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। যদিও সেই মধুচন্দ্রিমা খুব একটা সুখের হয়নি। বিনিয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের নানা বিতর্ক ও তিক্ততার কথা মাঝে মাঝেই শিরোনামে উঠে আসে। দুই সংস্থার বিচ্ছেদও নাকি সময়ের অপেক্ষা। নতুন স্পন্সরের সন্ধানে রয়েছে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর সঙ্গে ঐতিহ্যশালী ক্লাবের সম্পর্কে এত জটিলতা কেন তৈরি হচ্ছে?‌ আমাদের সাবেকি ক্লাবগুলো কি কর্পোরেট সংস্কৃতির সঙ্গে এখনও ঠিক মানিয়ে উঠতে পারছে না?‌ ইস্টবেঙ্গলের সাম্প্রতিক সমস্যা ময়দানে এই প্রশ্নও তুলে দিয়েছে। মোহনবাগানের সঙ্গেও তেমন ভুল বোঝাবুঝি হবে না তো!‌ এমন আশঙ্কার চোরাস্রোত হয়ত সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে।

তবে, সেই আশঙ্কাকে দূরে সরিয়ে রেখে আমরা ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিকে তাকাতেই পারি। আই এস এল চ্যাম্পিয়ন আর আই লিগ চ্যাম্পিয়নের মেলবন্ধন ভারতীয় ফুটবলে নতুন জোয়ার আনবে, এই স্বপ্ন দেখতেই পারি। পাশাপাশি, ইস্টবেঙ্গলের সামনেও যদি আই এস এলের দরজা খুলে যায়, তা হবে কলকাতার ফুটবলের জন্য বাড়তি এক পাওনা। আপাতত, আমরা সেদিকেই তাকিয়ে রইলাম।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.