উত্তম–সুচিত্রা। পরপর উচ্চারিত হয় নাম দুটো। প্রায় প্রবাদ হয়ে গেছে। কিন্তু একটু তলিয়ে পোস্টারগুলো দেখুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন। অধিকাংশ ছবির পোস্টারেই কিন্তু উত্তম–সুচিত্রা নয়, লেখা আছে সুচিত্রা–উত্তম। অর্থাৎ, সুচিত্রার নাম আগে। এটাই নাকি সুচিত্রার শর্ত ছিল। নীরবে মেনেই নিয়েছিলেন মহানায়ক। লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।
বাংলা ছবির রোমান্টিক জুটি বলতে কাদের বোঝায় ? এই প্রশ্নটা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। সবাই একটাই উত্তর দেবেন- উত্তম-সুচিত্রা। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন তো, এমন জুটির কথা কোনও ছবির পোস্টারে বা টাইটেল কার্ডে দেখেছেন কিনা। শুরুর দিকের কয়েকটা ছবিতে হয়ত উত্তম-সুচিত্রা পাবেন। কিন্তু অধিকাংশ ছবিতেই উত্তম সুচিত্রা পাবেন না। এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। একটু সার্চ করলেই অনেক ছবির পোস্টার পেয়ে যাবেন। বা টিভিতেও মাঝে মাঝেই পুরানো ছবিগুলো দেখায়। আর এই ঢালাও নেটের যুগে মুশকিল আসান ইউটিউব তো আছেই। আরও ভাল করে ছবিগুলো দেখুন। টাইটেল কার্ডে সবার আগে সুচিত্রার নাম। আগে সুচিত্রা, পরে উত্তম।
এমনটা কেন হয়েছিল? পরিচালকরা কি তুকতাক বিশ্বাস করতেন? নাকি লেডিজ ফার্স্ট এর তত্ত্ব মেনে চলতেন? আসলে, এটা ছিল সুচিত্রার একটা শর্ত। পরিচালকদের কাছে তিনি শর্ত দিতেন, পোস্টারে আমার নাম উত্তম কুমারের আগে রাখতে হবে। উত্তম কুমার ক্রমশ মহানায়ক হয়ে উঠছেন। পরিচালক-প্রযোজকরা চাইছেন, তাঁদের ছবিতে উত্তম কুমার কাজ করুন। তাঁকে ভেবেই চিত্রনাট্য লেখাও হচ্ছে। অথচ, সেই মহানায়ককে কিনা সুচিত্রার এইসব শর্ত মেনে নিতে হচ্ছে। অন্য কোনও নায়িকা যদি এমন শর্ত আরোপ করতেন, উত্তম কুমার নিশ্চয় তাঁর সঙ্গে ছবি করতেন না। অন্য নায়িকা এমন শর্ত দেওয়ার সাহসও পেতেন না।
কিন্তু সুচিত্রা বরাবরই অন্যরকম। আর দশজনের সঙ্গে তাঁর অনেক ফারাক। তাই তিনি অবলীলায় শর্ত দিতেন, আমার নাম আগে দিতে হবে। আর উত্তম কুমারকেও সেই শর্ত হজম করতে হত। পরের দিকে আমরা ছবির টাইটেল কার্ডে একটা জিনিস দেখতে পাই। শুরুতে সুচিত্রার নাম। তারপর একের পর এক পার্শ্ব অভিনেতার নাম সবার শেষে লেখা ‘এবং উত্তম কুমার’। এই ‘এবং উত্তম কুমার’কে দেখে অনেকে ভাবতে পারেন, এটা উত্তম কুমারের নতুন কোনও স্টাইল। আসলে, তিনিও একটা সম্মানজনক রাস্তা খুঁজছিলেন। শুরুতে যখন সুচিত্রার নাম রাখতেই হবে, তারপরে কেন তিনি থাকবেন? তার চেয়ে বরং একেবারে শেষে ‘এবং উত্তম কুমার’ হওয়াই ভাল। তিনিও একটি পাল্টা কৌশল নিয়েছিলেন। সুচিত্রার পরে থাকুক পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্র, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, নবদ্বীপ হালদার, ছায়া দেবী, মলিনা দেবী- এসব নাম। সবার শেষে বিশেষ আকর্ষণ নিয়ে হাজির ‘এবং উত্তম কুমার’। একটা চমকও হল, আবার সুচিত্রার অহঙ্কারকে একটু ‘শিক্ষা দেওয়া’ও হল।
কে বড়, সে তর্ক তোলা থাক। তবে উত্তম কুমারও বুঝতেন, তাঁর জনপ্রিয়তার অনেকটাই নির্ভর করছে সুচিত্রার উপর। অন্য নায়িকাদের সঙ্গে যতই ছবি করুন, বাঙালি সবসময় উত্তম-সুচিত্রাকেই দেখতে চেয়েছে। এই জুটিকে দেখার জন্যই সব কাজ ফেলে সে কাউন্টারের সামনে লাইন দিয়েছে। কিন্তু ছয়ের দশকের গোড়াতেই সুচিত্রার মাথায় ঢুকে গেল, উত্তমকে ছাড়াই তাঁকে স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করতে হবে। তিনি যে একা একটা ছবিকে টানতে পারেন, তা দেখিয়ে দিতে হবে। বাষট্টিতে সৌমিত্রকে নিয়ে করলেন সাত পাকে বাঁধা। সেই ছবি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেল। সুচিত্রার অহমিকা আরও কিছুটা বাড়ল। তাঁর উত্তমকে দরকার নেই, এমন একটা বার্তা হাবেভাবে দিতে শুরু করলেন।
সেই জন্যই কি পরের দিকে উত্তমের সঙ্গে ছবির সংখ্যা কমে গেল? সুচিত্রা যে তাঁর নাম আগে লেখার শর্ত দিয়েছিলেন, তা তিনি নিজেই নানা জায়গায় স্বীকার করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছেন, উত্তমের সঙ্গে আমার এত ছবি, কিন্তু আমি প্রোডিউসারকে বলেছিলাম, আমার নাম বিজ্ঞাপনে আগে দিতে হবে। তারপর সব ছবিতে ‘সুচিত্রা-উত্তম’, ‘উত্তম-সুচিত্রা’ নয়।
ওঁদের জুটির প্রথম ছবি সাড়ে চুয়াত্তর। মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে। সেই ছবি অবশ্য পুরোপুরি উত্তম-সুচিত্রার ছিল না। সেটা অনেক বেশি ছিল তুলসী চক্রবর্তী-মলিনা দেবীর ছবি। উত্তম-সুচিত্রার প্রথম হিট ছবি পরের বছর, অগ্নিপরীক্ষা। ৬ বছর চুটিয়ে দুজন অভিনয় করে গেলেন। একষট্টি সাল থেকে লক্ষ করে দেখুন। সুচিত্রাও ছবি কমিয়ে দিলেন। একষট্টিতে মুক্তি পেল একটাই ছবি- সপ্তপদী। বাষট্টিতেও একটাই ছবি- বিপাশা। দুটোতেই নায়ক উত্তম। এরপর পাঁচ বছরের ব্যবধান। ৬৭ তে উত্তমের সঙ্গে গৃহদাহ, ৬৯ এ কমললতা। তার দু বছর পর নবরাগ। উত্তমের সঙ্গে শেয় ছবি পচাত্তরে, প্রিয় বান্ধবী।
না, তারপর থেকে উত্তমের সঙ্গে আর কোনও ছবিই করা হয়নি সুচিত্রার। শেষ দু বছরে দুটি ছবি, দুটোই সৌমিত্রর সঙ্গে। ছিয়াত্তরে দত্তা, আঠাত্তরে প্রণয়পাশা। অনেকে ভাবেন, উত্তম কুমারের মৃত্যুর পরই বোধ হয় উত্তম-সুচিত্রা জুটির বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কিন্তু সুচিত্রার ছবির তালিকাই বলে দিচ্ছে, শেষ ১৬ বছরে উত্তমের সঙ্গে ছবির সংখ্যা মাত্র ৬। শেষ পাঁচ বছরে একটিও ছবি নেই। উত্তম কুমার মারা গেছেন ১৯৮০ তে। তার দু বছর আগেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সুচিত্রা। সিনেমা জগৎ থেকে অনেক দূরে, লোকচক্ষুর আড়ালে।
আরও একটা বিষয় লক্ষ করা দরকার। দুজনেই বম্বেতে নিজের নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। উত্তমও হাফডজনের উপর ছবি করেছেন। সুচিত্রাও প্রায় তাই। কিন্তু দুজন কখনও একসঙ্গে ছবি করার কথা ভাবেননি।
অবশ্য, এসব পরিসংখ্যান নিয়ে বাঙালি কখনই তেমন মাথা ঘামায়নি। সুক্ষ সুক্ষ অনুভূতিগুলো আম বাঙালির অ্যান্টেনায় কখনই সেভাবে ধরা দেয়নি। তাঁরা উত্তম-সুচিত্রা জুটি বলতেই অজ্ঞান।। উত্তম-সুচিত্রা বলতে তাঁদের কাছে ‘হারানো সুর’, সপ্তপদী বা সাগরিকা। সবই পাঁচের দশকের শেষ, অথবা ছয়ের দশকের গোড়ার ছবি। কিন্তু তারপর! শেষ আঠারোটা বছর! সম্পর্কের সেই তারটা বোধ হয় অনেক আগেই ছিঁড়ে গিয়েছিল।
***************
বেঙ্গল টাইমসের মহানায়ক স্পেশাল।আস্ত ই–ম্যাগাজিন। রয়েছে নানা আঙ্গিকের ১৮ টি লেখা।
পড়তে হলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন। প্রচ্ছদের ছবিতেও ক্লিক করতে পারেন। তাহলেও পুরো ম্যাগাজিনটি খুলে যাবে।
https://www.bengaltimes.in/BengalTimes-MahanayakSpecial.pdf