একবারই মহালয়া করেছিলেন উত্তম কুমার। সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? বাংলার সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে কীবাবে দেখেছিলেন? কেন ক্ষমা চাইতে হল আকাশবাণীকে? এসব অজানা কথা উঠে এল দিব্যেন্দু দে-র কলমে।
আমি উত্তম কুমারের একজন অনুরাগী। উত্তমের একশোর উপর ছবি দেখেছি। অন্যরা যেমন লাইন দিয়ে টিকিট কেটে তাঁর ছবি দেখিছিলেন, আমার তেমন সৌভাগ্য হয়নি। কারণ, আমার জন্ম তাঁর মৃত্যুর পর। তাই আমার উত্তম কুমারকে চেনা মূলত টিভির হাত ধরেই।
ছোট থেকেই শনিবার টিভিতে উত্তম কুমারের সিনেমা। না জেনে, না বুঝেই ভালবেসে ফেলেছিলাম ওই মানুষটাকে। বাকিরা কে কেমন, কে পরিচালক, কে নায়িকা বা কে গান গাইছেন, সেগুলো নিয়ে ভাবতামও না। মনে হত উত্তম কুমারই বোধ হয় সিনেমার কাহিনী লিখেছেন। তিনি নিজেই গান গাইছেন।
পরে একটু একটু করে জানতে শুরু করলাম মানুষটাকে। বম্বেতে গিয়ে কীভাবে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল, শুনেছি। শুরুর দিকে কীভাবে লড়াই করতে হয়েছিল, তাও শুনেছি। আমি একটি বিশেষ দিকের কথা তুলে ধরব, যা এখনও সেভাবে আলোচিত হয়নি।
সাতের দশকে উত্তম কুমারকে দিয়ে একবার মহালয়া রেকর্ড করানো হয়েছিল। মহালয়া বলতেই আমরা চিরকাল শুনে এসেছি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর সেই উদাত্ত কণ্ঠ। ১৯৩৫ থেকে যার যাত্রা শুরু, এখনও সমান জনপ্রিয়। একবারই ব্যতিক্রম হয়েছিল, সেটা ১৯৭৬ সালে। আকাশবাণীর কর্তারা চেয়েছিলেন মহালয়াকে আরও জনপ্রিয় করতে তুলতে। মহানায়কের জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী। তাঁকে দিয়ে যদি রেকর্ড করানো যায়!
প্রস্তাব এল উত্তম কুমারের কাছে। এমনিতে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে সবসময়ই ভালবাসতেন। কিন্তু এইক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিধা ছিল মহানায়কের। বাঙালির অন্য কণ্ঠস্বর শুনে অভ্যস্থ। সেই কণ্ঠই বাঙালির কানে বাজছে। হঠাৎ নতুন এই চেষ্টাকে মানুষ আদৌ গ্রহণ করবে তো? ভরসা দিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনিই ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক।
ঠিক হল, বাণীকুমার লিখবেন। হেমন্ত সুর দেবেন। উত্তম পাঠ করবেন। বেশ কয়েকদিন মহড়া হল। বাড়িতে সংস্কৃতের মাস্টারমশাই রেখে সংস্কৃত উচ্চারণ শুদ্ধ করলেন। মহালয়ার দিন রেকর্ডিংও হল । মহিষাসুরমর্দিনীর বদলে নাম রাখা হল দুর্গেদুর্গতিহারিনী। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, সেই মহালয়াকে বাঙালি মোটেই ভালভাবে গ্রহণ করেনি। চারিদিকে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তখন সোশাল মিডিয়া ছিল না। কিন্তু চায়ের ঠেক, পাড়ার সেলুন, পুকুর ঘাট এগুলোই ছিল সোশাল মিডিয়া। দ্রুত ছড়িয়ে গেল, উত্তম কুমার একেবারেই করতে পারেনি, ঝুলিয়েছে। উত্তম বিরোধীরা বলতে লাগলেন, ‘যার কাজ তাকেই মানায়। যাকে তাকে দিয়ে কী মহালয়া হয়?’ ধার্মিক লোকেদের কেউ কেউ ক্ষেপে গেলেন, তাঁরা আকাশবাণীর সমালোচনা করতে লাগলেন। শোনা যায় প্রচুর চিঠি ও ফোন এসেছিল ক্ষোভ জানিয়ে। বাধ্য হয়ে আকাশবাণীকে ক্ষমা চাইতে হল। এমনকি উত্তম কুমারও ক্ষমা চাইলেন। জানিয়ে দিলেন, এটা করা তাঁর উচিত হয়নি। আগামীদিনে আর তিনি মহালয়া রেকর্ড করবেন না।
আর কখনই তিনি মহালয়া রেকর্ড করেননি। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭৭ থেকে আবার সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠস্বরই শুনে আসছে বাঙালি। উত্তম কুমারের জীবনে নিঃসন্দেহে এটা একটা ব্যর্থ চেষ্টা। অনেকেই বলেছেন, এটা ততটা খারাপও হয়নি। আসলে, বাঙালির কান বীরেন্দ্রকৃষ্ণর চণ্ডীপাঠ শুনতেই অভ্যস্থ ছিল। তাই নতুন এই মহালয়াকে তারা গ্রহণ করতে পারেনি।
তবু যাঁরা উত্তম কুমারের কণ্ঠে সেই মহালয়া শুনতে চান, তাঁদের জন্য ইউ টিউব লিঙ্ক দেওয়া হল। চাইলে শুনতে পারেন। https://www.youtube.com/watch?v=-YqGHZBvjBI