রাজ্যের তরুণ এক বিধায়ক। বিধানসভায় বিরোধীদের অন্যতম মুখ। সেই আলি ইমরানের চোখে কিংবদন্তি অশোক ঘোষ। লেখাটি পড়ুন। অনেক অজানা কথা জানতে পারবেন।
আলি ইমরান (ভিক্টর)
অশোক ঘোষের কথা বললেই মনের মধ্যে ভিড় করে টুকরো টুকরো কত স্মৃতি। আমার জীবনের সঙ্গে, আমার লড়াইয়ের সঙ্গে তিনিও যেন একাত্ম হয়ে আছেন। আজ তিনি আমাদের ধরাছোঁযার বাইরে। তবু কেন জানি না, চোখ বুজলেই তাঁকে দেখতে পাই। এখনও যখন কোনও বিষয় নিয়ে সংশয় তৈরি হয়, মনে মনে ভাবার চেষ্টা করি, তিনি থাকলে কী পরামর্শ দিতেন। তখন কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
প্রথম যখন দেখি, আমি তখন খুব ছোট। ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার বাবার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর চাকুলিয়ার বাড়িতে অনেকে এসেছিলেন। তিনিও ছিলন। তখনও চিনতাম না, এমনকি নামও শুনিনি। ঠিকমতো বাংলা বুঝতামও না। উনি মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, তোমার বাবাকে এত হাজার হাজার মানুষ ভালবাসে। তোমার বাবা এই অসহায়, গরিব মানুষের হয়ে লড়াই করেছিলেন। নিজের মনকে শক্ত করো। একদিন তোমাকেও এইসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
কথাগুলো শুনেছিলাম। তবে সবটা বোঝার মতো বয়স তখনও হয়নি। তারপর আমি চলে গেলাম আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে পড়তে। ফিরে এসে কলকাতায় ভর্তি হলাম আইন নিয়ে। উনি একবার পার্টি অফিসে ডেকে পাঠালেন। কিছু বই উপহার দিলেন। বাবা মারা যাওয়ার সময় কী কী বলেছিলেন, সবকিছু তাঁর মনে আছে। সেই কথাগুলো আবার বললেন। তারপর বললেন, তুমি আইন নিয়ে ভর্তি হয়েছে, শুনেছি। তোমার বাবাও একজন আইনজীবী ছিলেন। পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করতেন। তুমিও বাবার মতোই মানুষের পাশে থেকো।
কলেজ জীবনে জড়িয়ে গেলাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে। যোগেশচন্দ্র ল কলেজে তখন তৃণমূলের দাপট। আমাদের ছেলেদের উপর আসতে লাগল নানা হুমকি, আক্রমণ। আমরা তখন রাজ্যে শাসক দল। তবু দক্ষিণ কলকাতার ওই কলেজে একেবারেই কোণঠাসা। সেখানে বামপন্থী রাজনীতি করাই প্রায় নিষিদ্ধ। তার মাঝেও আমরা কয়েকজন ঠিক করলাম, এই অরাজকতা চলতে দেওয়া যায় না। রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা কয়েকজন মিলে ছাত্র বলকের ইউনিট খুললাম। ছাত্ররা অনেক সময় বলত, অশোক ঘোষকে আনতে হবে। কেউ বলত, কলেজে দলের মন্ত্রীরা এলে ছাত্ররা উজ্জীবীত হবে। একবার পুলিশ অকারণে আমাদের ছেলেদের ধরে নিয়ে গেল। কর্মীদের দাবি, দলের কোনও মন্ত্রী এসে যেন ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। গেলাম অশোক জেঠুর কাছে। বললাম ছাত্রদের দাবির কথা। উনি সবকিছু শুনে বললেন, ‘কোনও মন্ত্রীকে পাঠানোই যায়। কিন্তু তাহলে পুলিশ মন্ত্রীকে গুরুত্ব দেবে, তোমাকে দেবে না। তোমার বন্ধুদের কাছেও তোমার লড়াইয়ের কোনও গুরুত্ব থাকবে না। তুমি ওদের হয়ে লড়াই করো। একান্তই যদি দরকার হয়, পরে ভাবা যাবে।’
তারপর আমরাই লড়াই করে বন্ধুদের ছাড়িয়ে আনলাম। আরও একবার প্রতিবাদ জানিয়ে আমরা পথ অবরোধ করেছিলাম। আমাদের এক শীর্ষনেতার কাছে শুনে উনি ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘মানুষের জন্য লড়াই করছ, ভাল কথা। কিন্তু নায্য কারণে লড়াই কর। কথায় কথায় রাস্তা অবরোধ করে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলো না।’ এমন কত টুকরো টুকরো ঘটনা!
২০০৬-এর নির্বাচনে গোয়ালপোখর থেকে আমরা হেরে গেলাম। সাতাত্তর থেকে ওই আসনে জিতে আসছিলেন আমার বাবা রমজান আলি। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে জিতে আসছিলেন কাকা হাফিজ আলম সৈরানি। এতদিনের আসন হাতছাড়া হওয়ায় অশোক জেঠুও খুব হতাশ হয়েছিলেন। তাঁর কথাতেই এলাকায় আরও বেশি করে সময় দিতে লাগলাম। এলাকার রাজনীতির সঙ্গে, বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে আরও বেশি করে জড়িয়ে গেলাম। বামফ্রন্টেরই সরকার। কিন্তু কখনও কখনও সেই সরকারের বিরুদ্ধেও আন্দলন করতে হয়েছে। স্থানীয় একটি হাসপাতাল সম্পর্কে মানুষের মনে অনেকদিন ধরেই ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। ডাক্তার ছিল না, ওষুধ ছিল না, কোনও পরিকাঠামোই ছিল না। শুধু বিল্ডিংটা ছিল। এলাকার মানুষ কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েই আইন হাতে তুলে নিল। তারা বলল, কিছুই যখন নেই, তখন এই বিল্ডিংটা থেকেই কী লাভ ? ওটা ভেঙে ফেলাই ভাল। জনরোশে সেই বাড়ি ভেঙে ফেলা হল। তখন আমাদের এলাকার সাংসদ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। আর বিধায়ক তাঁর স্ত্রী দীপা দাশমুন্সি। তাঁদের চাপে আমার ওপর নানারকমের মামলা দেওয়া হল। জামিন অযোগ্য বিভিন্ন ধারা। পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ধরা পড়লে তিন মাসের আগে জামিন পাব না। ইসলামপুর কোর্টে আগাম জামিন খারিজ, হাইকোর্টেও খারিজ। ভরসা সুপ্রিম কোর্ট। একদিন অশোক জেঠু ডেকে পাঠালেন। কিছুটা ধমক দিলেন, ‘আন্দোলন করতে গেলে তার উপর একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করেছ। পুলিশ তো খুঁজবেই। তিন মাস জেল খাটার হিম্মৎ আছে ?’ হয়ত আমাকে বাজিয়ে দেখতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, জেলে যেতে আপত্তি নেই। আপনি বললেই ধরা দেব।’ উনি বললেন, এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে বেড়িও না। এলাকায় যাও। মানুষের মাঝে থাকো। আরও নানা বিষয়ে আন্দোলন করো। তুমিই পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করো, যেন তোমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেখবে, মানুষই তোমাকে রক্ষা করবে।’
তাঁর নির্দেশমতো এলাকায় ফিরে গেলাম। কেন জানি না, আরও বেশি মানুষ আমাদের আন্দোলনে সামিল হল। আমি পুলিশের উদ্দেশ্যে বললাম, আমি কোথাও পালাচ্ছি না। পুলিশ যখন খুশি আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে পারে।’ এদিকে, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিরা ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছেন, আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য। অন্যদিকে আই বি রিপোর্ট পাঠাচ্ছে, ভিক্টরকে গ্রেপ্তার করা হলে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। এলাকায় আইনশৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দেবে। ফলে, আমাকে গ্রেপ্তার করা হল না। আমাকে না জানিয়েই নানা জায়গায় মিছিল হচ্ছে, ভিক্টরকে গ্রেপ্তার করা চলবে না। এটা আর শুধু দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। যারা দলের বৃত্তে কোনওকালেও ছিলেন না, তাঁরাও পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন।
তিন মাস পর কোর্টে গেলাম। ততদিনে আইনের স্নাতক হয়ে গেছি। ঠিক করলাম, নিজেই নিজের হয়ে কেস লড়ব। নিজেই নিজের জামিনের জন্য মুভ করলাম। জামিন হয়েও গেল। যেভাবে নিজেই নিজের জন্য লড়াই করেছিলাম, উনি খুব খুশি হয়েছিলেন।
এরপর গোয়ালপোখর উপনির্বাচন (২০০৯)। আবার উনি ডেকে পাঠালেন। বললেন, তোমাকে এবার দাঁড়াতে হবে। আমি বললাম, আমার তো মাত্র সাতাশ বছর বয়স। তেমন অভিজ্ঞতাও নেই। অন্য কেউ দাঁড়াক, আমার তরফ থেকে যেটুকু পরিশ্রম করার, আমি করব।’ উনি বললেন, রাজনীতিতে বয়স আর অভিজ্ঞতাই শেষ কথা নয়। তুমি ওখানকার মানুষের হয়ে লড়াই করছ। ওখানকার মানুষ তোমাকে তাদের নেতা হিসেবে আরও বেশি করে পাশে চাইছে। পিছিয়ে যেও না। চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করো।
দাঁড়িয়ে তো গেলাম। কিন্তু অঙ্ক যে একেবারেই প্রতিকূল। কয়েকদিন আগেই হয়েছে লোকসভা নির্বাচন। দীপা দাশমুন্সি প্রায় দেড় লাখ ভোটে জিতেছেন। শুধু গোয়ালপোখরেই তাঁর লিড ছিল ২৭ হাজার। ২৭ হাজারের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব ? উনি কিন্তু ভরসা জুগিয়েছিলেন। মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন, আমি জিতব। বাকিরা মুখে বলতেন, কিন্তু বুঝতে পারতাম, তাঁরা মন থেকে বলছেন না। তাঁরা জানেন, আমি নিশ্চিত হারব, এবং অন্তত তিরিশ হাজার ভোটে। ব্যতিক্রম একজন, অশোক ঘোষ। নিয়মিত খোঁজ নিয়েছেন। শুধু আমার কাছে নয়, আমার এলাকার বিভিন্ন কর্মী ও নেতাদের কাছ থেকে। কলকাতায় বসেও সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন। সেই উপনির্বাচনে বাকি নটি আসনে বামফ্রন্ট হারলেও জয় এল একমাত্র গোয়ালপোখরে।
বাকি সবাই অভিনন্দন জানাল। উনি কিন্তু ঠিক উল্টো কথা বললেন, ‘মানুষ তোমাকে ভালবাসে, তাই তুমি জিতেছো। তাই বলে ভেবে নিও না, তুমি বিরাট কিছু হয়ে গেলে। আগের মতোই মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেশো। এলাকায় অনেক বেশি সময় দাও। মানুষের ভালবাসার মর্যাদা দাও।’ বিধানসভায় একবার সরকারের তুমুল সমালোচনা করলাম। উনি শুনেছিলেন। ভয় পাচ্ছিলাম, আবার হয়ত ধমক দেবেন। উনি সাহস জুগিয়ে বললেন, সবার আগে তুমি নিজের এলাকার। তারপর পার্টির। তারপর বামফ্রন্টের। এলাকার স্বার্থে যদি সমালোচনা করতে হয়, ভুলটা ধরিয়ে দিতে হয়, তুমি তাই করবে’।
২০১১ তে অনেক বিপর্যয়ের মাঝেও আবার জিতে এলাম (এবার চাকুলিয়া কেন্দ্র থেকে)। আবার একইভাবে উৎসাহিত করলেন। সঙ্গে সতর্কও করলেন, এবার তুমি আর নতুন নেই। দ্বিতীয়বার হয়ে গেল। এবার বিরোধী আসনে। তাই দায়িত্ব অনেক বেশি। আমি তরুণ বিধায়ক। তরুণরা সাধারণত বিধানসভায় বেশি বলার সুযোগ পায় না। কিন্তু আমি যেন বিধানসভায় বেশি বলার সুযোগ পাই, উনি সবাইকে বলে রেখেছেন। তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাজেট আলোচনায় (যেখানে আমার বলার কথাই নয়) বলার সুযোগ পেয়েছি। উনি পাশে না থাকলে বিধানসভায় নিজেকে এভাবে মেলে ধরার সুযোগও পেতাম না।
আরও অনেক স্মৃতি এসে ভিড় করছে। অনেক স্মৃতি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এই বয়সেই আমরা কতকিছু ভুলে যাই। কিন্তু উনি! নব্বই পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কী নিখুঁত স্মৃতিশক্তি ছিল! সব খুঁটিনাটি বিষয় মনে রাখতেন।ভাবতেও অবাক লাগে, একজন মানুষ চাইলে মন্ত্রী, সাংসদ সবকিছু হতে পারতেন। কত অনুরোধ এসেছে, কী অবলীলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন।রাজনীতির আঙিনায় এমন সন্ন্যাসীও থাকেন! কী বলব, ম্যাজিক! বিস্ময়! হ্যাঁ, অশোক ঘোষ ছিলেন আমার কাছে এক বিস্ময়। নেতাজিকে দেখিনি। কিন্তু আগামী প্রজন্মকে গর্ব করে বলতে পারব, আমি অশোক ঘোষকে দেখেছি।
(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন। )