(বেঙ্গল টাইমসে শনি ও রবিবার বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় সাহিত্য বিভাগকে। এবার একটি স্মৃতিচারণধর্মী গল্প। সুদূর আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছেন বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত। )
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরির খোঁজ করছি। কাগজ দেখে বিভিন্ন জায়গায় আবেদন পত্র পাঠাচ্ছি। কিছু জায়গায় ইন্টারভিউ ও দিয়ে এসেছি আর সব জায়গায় একই উত্তর – আমরা আপনার বাড়ির ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে দেব আর রোজই নিয়ম করে বিকেল বেলায় ডাক বাক্স চেক করি, যে চিঠির জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি সেই চিঠি আমার নামে আসেই না। ডিসেম্বর মাসের একদিন আমার বাড়ি ফিরতে একটু রাতই হয়ে গিয়েছিল। ঘরে ঢুকতেই মা বললেন- তোর নামে একটা খাম এসেছে। আজ বিকেলে পিওন সই করিয়ে খামটা দিয়ে গেল। ভাবলাম কোনও কোম্পানির থেকে হয়ত কোন রিগ্রেট লেটার এসেছে। তবু দেখতে হয় এই ভেবে খামটা খুলে চিঠিটা পড়ে আনন্দে একেবারে লাফিয়ে উঠলাম। একেবারে এপয়েন্টমেন্ট লেটার আর আগামী সোমবার সকাল ১০ টায় আমাকে অফিসে জয়েন করতে বলা হয়েছে । মাইনেপত্তর খুবই ভাল আর সঙ্গে আনুসাঙ্গিক অনেক সুযোগ সুবিধা। বাড়িতে যেন একটা আনন্দের জোয়ার। খবরটা শোনার পর মা–র এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার ঠাকুর – দেবতাদের উদ্দেশ্যে নমস্কার করা হয়ে গিয়েছে। যেহেতু আমার অফিসে কাজ করা সম্পর্কে কোন ধারনা নেই, বাবা আমাকে অফিসে কাজ করা সংক্রান্ত নানা ধরনের উপদেশ দিলেন।
নির্দিষ্ট দিনে সকাল ১০ টার বেশ কিছুক্ষণ আগেই কলকাতার ডালহৌসি অঞ্চলে স্ট্র্যান্ড রোডে অফিস বিল্ডিং এর সামনে এসে উপস্থিত হলাম। বাড়িটা বেশ বড়। এই বিল্ডিংয়ের তিনতলায় আমার অফিস। বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছিল বহু পুরনো, আর উপরে ওঠার জন্য ততোধিক পুরনো আমলের লিফ্ট আর চওড়া কাঠের সিঁড়ি। রেলিংগুলি অপোক্ত, লোকজনের চলাচলের দরুন কাঠের সিঁড়িগুলি অনেক জাগায় ক্ষয়ে গেছে। আধো অন্ধকার মেশানো সিঁড়ি দিয়ে অফিসে পৌঁছে একটু হতচকিত হলাম। প্রধান দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিরাট হলঘর। হলঘরের শেষে দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে ব্রিটিশ আমলের বহু পুরনো বিশাল এক দেওয়াল ঘড়ি। প্রায় সারা দেওয়ালগুলি জুড়ে নানা ধরনের ছোট – বড় কাঠের আর স্টিলের পুরনো ধরণের আলমারি। পুরনো আমলের অনেক চেয়ার টেবিল আর টেবিলের উপর অগোছালো ভাবে রাখা ফাইলের স্তূপাকার। কিছু কিছু টেবিলের উপর টাইপ – রাইটার মেশিন। বড় হলঘরটার অনুপাতে জ্বলা লাইট গুলিকে একটু নিষ্প্রভ লাগছিল। বড় বড় রডসমেত অপরিষ্কার সিলিং ফ্যানগুলি ছাদের থেকে ঝুলছে । অফিসের ভিতর কোন লোককেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সব চেয়ারগুলো ফাঁকা। ঘড়িতে দেখলাম দশটা বেজে গেছে। হঠাৎ একজন দপ্তরি গোছের লোককে দেখতে পেয়ে আমার অফিসে আগমনের উদ্দেশ্য বললাম। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – এই হলঘর দিয়ে সোজা গিয়ে ডানদিকে দেখবেন আলমারির পাশে বড় টেবিলের উল্টো দিকে আমাদের অফিসের ” বড়বাবু ” স্নেহময় দত্ত বসে আছেন। আপনার কাগজপত্র নিয়ে আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করুন, তিনি আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবেন।
ফাইল – পত্তরে ভরা বড় টেবিলটার সামনে দাঁড়াতে স্নেহময় বাবু, বোধহয় অফিসের কোনও কাজ করছিলেন, আমাকে দেখে অল্প সময়ের জন্য কিছু একটা পরখ করলেন তারপরে বসতে বললেন। আমার কাগজগুলি দেখতে দেখতে বললেন – তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট তাই তোমাকে ” তুমি ” বলেই বলছি। তুমি ঠিক সময়েই অফিসে এসেছো। ১০ টা বাজার আগেই অফিসে ঢুকবে। আমি অবশ্য রোজই দশটা বাজার অনেক আগেই অফিসে চলে আসি। এরপরে চিৎকার করে একজনকে ডেকে বললেন – এ হচ্ছে দিবাকর সেন। আজ থেকে আমাদের অফিসে জয়েন করল তারপর একটা সিট দেখিয়ে বললেন ওখানে দিবাকরের বসার ব্যবস্থা করে দাও। আমাকে বললেন – তুমি সিটে গিয়ে বসো অমি একটু পরে এসে কী কাজ করতে হবে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। দেখলাম অফিসের লোকজন সব আসতে শুরু করেছে। যে হলঘরটা একদম চুপচাপ ছিল সেটা লোকজনের কথাবার্তায় একেবারে সরগরম হয়ে উঠেছে। এদের কথাবার্তার ফাঁকে শুনলাম কেউ বলছে – বাসের ভিড়ে সারাটা পথ দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে, আবার কাউকে বলতে শুনলাম আসার সময় ট্রেনে তাস খেলায় গো হারা হেরে গেছেন আবার কারুর গত রাতে বউ এর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছে …. এই রকম নানা ধরনের আলোচনা। অফিসে ঢুকে প্রথম দর্শনে আমাদের অফিসের বড়বাবুকে ভালো লেগেছিল। সৌম্য চেহারা। চোখে-মুখে এক বুদ্ধিদীপ্তর ছাপ। চাহুনিতে এক দয়ালু ভাব আর সহজেই অপরকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা। পরনে মাল-কোছা দেওয়া ইস্ত্রি করা সাদা ফিন ফিনে ধুতি আর গলা বন্ধ কালো কোট। গায়ে দামি সেন্টের গন্ধ, চোখে দামি রিমলেস চশমা। দেখলেই মনে হয় মানুষটা বেশ সৌখিন। হঠাৎ দেখি বড়বাবু আমার টেবিলের সামনে আর সঙ্গে কয়েকজন লোক। বেশ কিছু কাগজ আমার হাতে দিয়ে বললেন – এগুলি মন দিয়ে পড়, আমি কিছুক্ষণ পরে এসে তোমাকে সব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেব। এই কথা বলে সবাইকে নিয়ে হলঘরের অন্য দিকে চলে গেলেন। আমি ও ভাবলাম – যাক , এতক্ষণ পরে অফিসে কাজ করার সুযোগ পেলাম। বড়বাবুর দেওয়া কাগজে লেখাগুলি পড়ে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। লেখাগুলি বিখ্যাত একটি বাংলা নাটকের সংলাপ। কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে রয়েছি । এমন সময় বড়বাবু একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমার পাশে বসলেন আর বেশ সিরিয়াস ভাবে বললেন – অফিসে তোমাকে কী কাজ করতে হবে সেটা আমি তোমাকে টিফিনের পরে সব বুঝিয়ে দেব। আমাদের অফিসে একটি সাংস্কৃতিক বিভাগ আছে। প্রতি বছর এই শীতকালে নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আর থাকে এই বিল্ডিংয়ে যত ছোট-বড় অফিস আছে , সেই সমস্ত অফিসের লোকেদের দ্বারা নাটকের প্রতিযোগিতা। সত্যি কথা বলতে কোনও বছরই এই নাটকের প্রতিযোগিতায় কোন পুরস্কার আমরা জিততে পারিনি। আজ অফিসের ছুটির পর আমাদের নাটকের রিহার্সাল আছে। তুমি ও সেখানে থাকবে। তোমাকে প্রথম দেখেই আমি মনে মনে ঠিক করেছি নাটকের প্রধান চরিত্রটা তোমাকে দিয়েই করাব। তোমাকে দেখতেও খুব সুন্দর আর শুনেছি তুমি পাড়াতে খেলাধূলা আর নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত আছ। শোন ভায়া, এবার আমাদের প্রাইজ পেতেই হবে নইলে একেবারে প্রেস্টিজ থাকছে না। ক্রমে অফিসের সবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল। রোজ কাজের শেষে সন্ধেবেলায় শুরু হত জোর কদমে নাটকের মহড়া। সেবার নাটকের প্রতিযোগিতায় আমাদের অফিসের নাটকের দল দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে অনেক প্রাইজ জিতেছিল। আমিও রাতারাতি অফিসে হয়ে গেলাম ” হিরো। অফিসের লোকেদের সঙ্গে ক্রমে আলাপ পরিচয়ের মাধ্যমে সখ্যতা ও বেড়ে গেল। অফিসের কাজ ছাড়াও সুখে – দুঃখে আমরা যেন একটা একান্নবর্তী পরিবারের মতন। অবশ্যই এই পরিবারের সর্বময় কর্তা আমাদের বড়বাবু – স্নেহময় দত্ত। তিনি একদিন অফিসে না এলে সকলেরই মনে হতো অফিসটা একেবারে ফাঁকা, জৌলুসহীন। এও জানতে পারলাম অফিসের প্রত্যেকের আর তাঁদের পরিবারের সঙ্গে বড়বাবুর এক নিজের লোকের মতো সম্পর্ক। অফিসের কাজ ছাড়াও কারো পরিবারে কোন অশান্তি – বিপদ হলে আর সেটার সুরাহা করার জন্য বড় দাদার মত বড়োবাবুকেই ডাকা হয় আবার কেউ আর্থিক ভাবে বিপদে পড়লে বড়বাবু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। অবশ্য সেই সাহায্যের টাকা তিনি অনেক সময় ফেরত ও পান না। সর্বক্ষেত্রে তিনিই অফিসের “মুশকিল আসান ” । ক্রমে ক্রমে বড়বাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আপন দাদা ভাইয়ের মত হয়ে গেল। অফিসে সবাই জানত বড়বাবু আমাকে ভীষণভাবে স্নেহ করেন। রোজ দুপুরবেলা বড়বাবুর বাড়ি থেকে বহুদিনের পুরনো লোক সনাতনদা বড়বাবুর জন্য রান্না করে খাবার নিয়ে আসতো। পরবর্তীকালে বড়বাবুর নির্দেশে সনাতনদা আমার জন্যও খাবার নিয়ে আসত। একদিন লজ্জাসহকারে বড়বাবুকে বলায় তিনি অত্যন্ত স্নেহ ভরে আমাকে বলেছিলেন – ছোট ভাইকে ছেড়ে বড় ভাই কি কখনও খেতে পারে? বড়বাবুর বাড়িতে আমি বহুবার গেছি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অতিথি পরায়ন। অফিসের কোনও লোক তাঁর বাড়িতে গেলে না খাইয়ে কখনও ছাড়তেন না। নিজে কাছে বসে থেকে যত্ন সহকারে খাওয়াতেন। শোভাবাজারে এক বনেদি পরিবারে বড়বাবুর জন্ম। প্রায় চার পুরুষ ধরে কলকাতায় বসবাস। নিজে বিয়ে করেননি। একাই থাকতেন সঙ্গে বহুদিনের পুরনো লোক সনাতনদাকে নিয়ে। বড়বাবুর থেকে শুনেছি, তাঁর পূর্বপুরুষদের ইতিহাস আর তাঁর জীবনের নানা ধরনের গল্প। যখন তাঁর খুব অল্প বয়েস, তখন দু-এক বছরের ব্যবধানে মা-বাবাকে হারান। বড় দাদারা ও দিদিরা জালিয়াতি করে তাঁর ভাগের সমস্ত সম্পত্তি ঠকিয়ে আত্মসাদ করে নেয়। এখন থাকবার জায়গা বলতে পৈত্রিক ভিটেতে ছোট একটি ঘর। অনেক কষ্ট করে আর্থিক অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন। নিজের একান্ত চেষ্টায় স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পাশ করেছেন। কারুর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। সবসময় বলতেন তিনি খুব ভাল আছেন। নেশা বলতে নিজে খেতে আর লোককে খাওয়াতে খুব ভালবাসেন। আর ছিলেন থিয়েটার পাগল লোক। বড়বাবুর দৌলতে তদানিন্তন সময়ে কলকাতার সমস্ত থিয়েটার হলে নামকরা শিল্পীদের দ্বারা অভিনীত প্রায় সব নাটকগুলো দেখবার আমার সৌভাগ্য হত। বনেদি বাড়ির ছেলে হলেও বনেদিয়ানা তিনি কখনও করতে পারেননি। আমরা অফিসের সবাই জানতাম বড়বাবুর খুব ইচ্ছে ছিল – – সাদা ধুতি – পাঞ্জাবি পরে দুধ সাদা রঙের একটা হুড খোলা বড় গাড়ি নিজে চালিয়ে অফিসে যাতায়াত করবেন। অফিসের সবাই আমরা মজা করে বলতাম – আপনি যেদিন আপনার পছন্দ মতো সাদা রঙের গাড়িতে চড়ে প্রথম অফিসে আসবেন, আমরা সবাই এমনকী এই বিল্ডিংয়ের সব অফিসের লোকেরা হাসি মুখে বিল্ডিংয়ের প্রধান গেটে মালা নিয়ে অপেক্ষা করব আপনাকে বরণ করে নেবার জন্য। এই কথা শুনে বড়বাবু মিটি-মিটি হাসতেন আর নিজেও মজা করে বলতেন – তোরা দেখিস আমি ঠিকই একদিন তোদের সবাইকে একেবারে অবাক করে দিয়ে সাদা রঙের গাড়িতে চড়ে অফিসে আসব ।
একদিন সকালবেলা সত্যি সত্যি বিল্ডিংয়ের সমস্ত লোকজন আর আমরা সবাই মিলে সাদা মালা হাতে নিয়ে বড়বাবুর আসার জন্য অপেক্ষা করে আছি। একটা সময় তিনি এলেন সাদা ধুতি – পাঞ্জাবি পরে সাদা রঙের হুড খোলা গাড়ির বদলে কাঁচ দিয়ে ঘেরা সাদা গাড়িতে তবে নিজে চালিয়ে নয়, শায়িত অবস্থায়। আমরা সবাই তাঁকে সাদা ফুলের মালা পরিয়ে দিলাম হাসিমুখের বদলে গভীর অশ্রুজলে, তাঁকে অফিসে বরণ করে নেওয়ার বদলে চিরতরের জন্য বিদায় জানালাম। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল, মনে হল নিজের পিতাকে হারালাম ।
বড়বাবুর মৃত্যুর কিছুকাল পরে আমি চাকুরিসূত্রে অন্য এক সংস্থায় জয়েন করি । দীর্ঘ চাকরি জীবনে কাজের সূত্রে নানা ধরনের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ ঘটেছিল। কাজের ধরনটাই ছিল মেলামেশা বা কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষের ভিতরের আসল মানুষটিকে খুঁজে বার করা। আজ আমি ষাটউর্দ্ধ অবসর প্রাপ্ত একজন। আমার দীর্ঘ বৈচিত্রময় কর্মজীবনে বহু মানুষকে জানলাম, চিনলাম। কিন্তু আমার প্রথম জীবনের কাজের সূত্রে অফিসের ” বড়বাবুর ” মতন এই রকম অমায়িক লোকের সন্ধান কোথাও পাইনি, হয়তো পাবও না।
(বেঙ্গল টাইমসের সাহিত্য বিভাগে আপনিও স্বাগত। গল্প, অণু গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিচারণধর্মী লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের দপ্তরে। মনোনীত হলে প্রকাশিত হবে। পুজো সংখ্যার লেখাও এখন থেকেই পাঠিয়ে রাখতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: bengaltimes.in@gmail.com)