সৈকত মিত্র
ছোট থেকেই গানের পরিমণ্ডলে মানুষ। বাড়িতে আসতেন দিকপাল শিল্পীরা। তৈরি হত কত কালজয়ী গান। আমি তখন নিতান্তই ছোট। সব কথার মানেও বুঝতাম না। একটু একটু করে সুরগুলো ভাল লাগতে শুরু করল। বাড়িতে যে গানটা তৈরি হচ্ছে, বাবা যেটা রিহার্সাল দিচ্ছেন, সেটাই কদিন পর সিনেমায় দেখছি, রেডিওতে শুনছি। এ এক অন্য অনুভূতি। সেই মুগ্ধতাকেই বয়ে বেড়ালাম বাকি জীবনেও। তাই অন্য কোনও পেশার কথা না ভেবে আমিও গানকেই আঁকড়ে ধরলাম।
আমি পরম সৌভাগ্যবান। হেমন্তজেঠুর সুরে আমার গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেটা ১৯৮৯। তাঁর সুরে গেয়েছিলাম ‘ঘর ছেড়ে চলে যেও/ঘর ভেঙ যেও না।’ হেমন্তবাবুর তখন শরীর ভাল নয়। উনি তখন বাইরে অনুষ্ঠান করা বন্ধ করে দিয়েছেন। বাইরেও খুব একটা বেরোচ্ছেন না। ফলে, কাছে বসে গান তুলিয়ে দিতে পারতেন না। এমনকী রেকর্ডিংয়ের সময়েও থাকতে পারতেন না। উনি ক্যাসেট করে পাঠিয়ে দিতেন। সেই ক্যাসেট শুনেই শিল্পীরা গান তুলে নিতেন। আমিও সেভাবেই গানটি তুলেছিলাম।
উনি বলেছিলেন, রেকর্ড করা হয়ে গেলে ক্যাসেটটি যেন ফেরত দিয়ে আসি। আমিও কথা দিয়েছিলাম, ফেরত দিয়ে আসব।
এর মধ্যে আমার গান রেকর্ড করা হয়ে গেছে। অনেকেই প্রশংসা করছেন। কিন্তু হেমন্তজেঠুর ক্যাসেটটা এর ফেরত দেওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম, লোকের হাতে পাঠাব না। একদিন তাঁকে প্রণাম করে আমার রেকর্ডটি তাঁকে দিতে যাব। সেইদিনই ক্যাসেটটি ফেরত দেব।
কাল নয়, পরশু— এই ভেবে আর যাওয়া হচ্ছিল না। এর মধ্যে রবীন্দ্র সদনে একটা অনুষ্ঠান ছিল। আমি গ্রিনরুম থেকে বেরোচ্ছি। হঠাৎ দেখি, হেমন্ত জেঠু ঢুকছেন। আমি প্রণাম করলাম। উনি কাঁধে হাত রেখে বললেন, কথা দিয়ে কথা রাখো না। এটা তো ভাল নয়।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না।
উনিই বুঝিয়ে দিলেন, তোমার না ক্যাসেটটা দিয়ে আসার কথা ছিল।
আমার তখন ‘ধরণী দ্বিধা হও’ অবস্থা। সত্যিই খুব লজ্জায় পড়ে গেলাম। কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম, জেঠু, কাল অবশ্যই দিয়ে আসব।
পরেরদিন ওই ক্যাসেট দিতে তাঁর বাড়ি গেলাম। উনি বললেন, কাল আমার কথায় কিছু মনে করোনি তো! আমি তো তোমার পিতৃতুল্য। এটুকু তো বকতেই পারি।
তার কয়েকদিন পরেই উনি মারা গেলেন। আমাদের মাথার ওপর থেকে যেন একটা আকাশ সরে গেল। পরের বছর, নেতাজি ইনডোরে তাঁর স্মরণে বিশাল অনুষ্ঠান হল। আমি গেয়েছিলাম পাল্কির গান। কোরাসে গলা মিলিয়েছিলেন সলিল জেঠু, শিবাজিদা, কল্যাণদা। তিরিশ বছর পেরিয়ে গেল। এখনও বারবার মনে পড়ে সেই দিনটা। বারবার মনে পড়ে সেই কিংবদন্তি মানুষটার কথা। চেষ্টা করি, কথা দিয়ে কথা রাখতে। শুধু গান নয়, আমাকে জীবনের চরম একটা শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন।