স্বরূপ গোস্বামী
সত্যিই, মাত্র কয়েকদিনেই আমাদের অবস্থান কেমন বদলে যায়! কয়েকদিন আগেও পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে আমাদের দরদ উথলে উঠছিল। তাঁরা কোথায় আছেন, কী খাচ্ছেন, তা নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত ছিল না। কিন্তু যেই তাঁরা নিজের রাজ্যে ফিরতে শুরু করেছেন, অমনি আমাদের সুর পাল্টে গেল। এখন পরিযায়ীরাই যেন সবথেকে বড় ভিলেন।
কেন পরিযায়ীদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে? পরিযায়ীরা আসছেন বলেই সংক্রমণ বাড়ছে। এরকম একটা সুর বেঁধে দিতে চাইছে খোদ রাজ্য সরকার। আর সরকার সুর বেঁধে দিলে কাগজগুলিও সেই সুরেই কথা বলতে শুরু করে। সেটাই হচ্ছে। বাংলা কাগজ পড়লে মনে হবে, কেন তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হল। এবার সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে যাবে। কোথাও কোথাও তোয়াজ এতটাই যে, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াটাও মুখ্যমন্ত্রীর সাফল্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী তো আগেই বলেছিলেন, সংক্রমণ বাড়বে। বাড়ছে। অতএব, মুখ্যমন্ত্রীর আশঙ্কাই সত্যি হল। হায় রে, এটাও মুখ্যমন্ত্রীর সাফল্য!
সব মহলই এই ব্যাপারে সুবিধাবাদী অবস্থান নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছিলেন, ‘যিনি যেখানে আছেন, তিনি সেখানেই থাকুন।’ তাহলে, এখন ফেরত পাঠানোর তোড়জোড় কেন? যিনি যেখানে আছেন, সেখানে তাঁকে নিরাপদে রাখা গেল না কেন? যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁদের দায়টুকু নেওয়া গেল না? এখন হাত ঝেড়ে ফেলতে হচ্ছে?
দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও রাজ্য সরকার তালিকাই করতে পারল না, কোন রাজ্যে কতজন আটকে আছেন। পাশে দাঁড়ানো তো অনেক দূরের কথা। অথচ, ব্লক ধরে ধরে, পঞ্চায়েত ধরে ধরে খুব সহজেই এই তালিকা বানানো যেত। আসলে, যাঁরা সরকার চালাচ্ছেন, তাঁদের পঞ্চায়েতের কাঠামো সম্পর্কে ধারণাই নেই। তাই যে তালিকা দেড়দিনে হতে পারত, তা দেড় মাসেও হল না। এখন বলা হচ্ছে, পরিযায়ীদের পাঠানো হচ্ছে কেন? কেউ কেউ বলছেন, যদি পাঠানোর হয়, আগেই পাঠাতে পারত।
সঠিক যুক্তি। কিন্তু আগে পাঠানো হোক, এমন দাবিটা তখন জানানো হয়নি কেন? লকডাউন ঘোষণার সময়েই তো বলা যেত, আপাতত পিছিয়ে দেওয়া হোক। আগে শ্রমিকরা ফিরে আসুন। সাতদিন পর লকডাউন হোক। কিন্তু রাজ্য সরকার বা রাজ্যের শাসকদল এমন দাবি করেছিল? সেই সময়ের কোনও কাগজে বা ভিডিও ফুটেজে দেখাতে পারেবন? একই অভিযোগ বিরোধীদের সম্পর্কেও করা যায়। তাঁরা আগে পরিযায়ীদের ফিরিয়ে আনার দাবি তোলেননি। এখন বলছেন, কেন আগে পাঠানো হয়নি?
আম নাগরিকও তাই। যখন লকডাউন চালু হয়, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার তেমন দাবি চোখে পড়েনি। বরং, রাজ্যে না এলেই ভাল, এই জাতীয় একটা বার্তা দেখা গিয়েছিল। যেই তাঁরা ফিরছেন, অমনি বলা হচ্ছে, আগে পাঠানো যেত।
আসলে, আমরা সরকারকে দোষারোপ করি। কিন্তু কী চাই, আমরা নিজেরাও জানি না। আমরা যেমন, আমাদের সরকারও তো তেমনই হবে। তাঁরাও তাই দিনে–রাতে ডিগবাজি মারে। সুযোগ বুঝে অবস্থান বদলে নেয়। যদি ফিরিয়ে আনাই হয়, তাঁদের তো আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা যেত। তাঁদের যদি গ্রামে আলাদা রাখা যেত, তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না। সেটা করা যায়নি। রাখলে টেস্ট করতে হবে। তাদের খাওয়া–দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার যথারীতি দায় এড়িয়ে গেছে। এত এত মানুষকে কাজের সন্ধানে রাজ্যের বাইরে যেতে হয়েছিল! এই সত্যিটা যদি বেরিয়ে আসে! তাহলে, ‘এগিয়ে বাংলা’র ফানুসটা চুপসে যাবে। তাই, সব ব্যাটাকে ছেড়ে এখন পরিযায়ী ব্যাটাদের ধরো। তাঁদেরই ভিলেন বানিয়ে দাও। তাতে নিজেদের অক্ষমতা যদি কিছুটা আড়াল হয়।