স্বরূপ গোস্বামী
এই রাজ্যের কতজন শ্রমিক ভিনরাজ্যে আছেন? এই সংখ্যাটা কেউই জানেন না। রাজ্য সরকারের কাছে স্পষ্ট কোনও হিসেব নেই। এমনকী কোন জেলায় কত মানুষ বাইরে আছেন, জেলা প্রশাসনের কাছেও এই খবর নেই। আন্দাজে যে যা পারছেন, বলছেন। কারও তথ্যের সঙ্গে কারও তথ্য মিলছে না। আর জেলাগত তথ্যই যদি না থাকে, তাহলে রাজ্যগত তথ্য যে থাকবে না, এটা বোঝার জন্য কোনও ফেলু মিত্তির হওয়ার দরকার পড়ে না।
বেশ কয়েকদিন লকডাউন চলছে। আরও কতদিন চলবে, কেউ জানে না। ধরে নেওয়াই যায়, এটা মাস দুয়েক চলবে। আরও বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা কী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছেন, এখনও হয়ত সেই ছবিটা পরিষ্কার নয়। এখনও হয়ত খাবারের জোগাড় হয়ে যাচ্ছে। যা টাকা হাতে আছে, তা দিয়ে এখন হয়ত চলে যাচ্ছে। আরও কয়েকদিন হয়ত চলেও যাবে। কিন্তু তারপর পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। মালিক হাত তুলে নেবে। যারা টুকটাক সাহায্য করছিলেন, তাঁরাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। তখন নানারকম বিপর্যয় নেমে আসবে। ঘরে আসার জন্য ছটপট করবেন। কিন্তু কীভাবে ফিরিয়ে আনা হবে, তা নিয়ে প্রশাসনকে লেজে গোবরে হতে হবে।
কোনও সন্দেহ নেই, কঠিন এক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে দেশ। এর শেষ কোথায়, বলা মুশকিল। কিন্তু তাই বলে কোন রাজ্যে কতজন আটকে আছেন, এই তথ্যটাও এতদিনে জানা যাবে না! এটা চূড়ান্ত প্রশাসনিক ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়। দূরদর্শিতার অভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে। যে তথ্যটা খুব সহজে পাওয়া যেত, সেটা জোগাড় করতে কেন এত সময় লাগছে?
তাহলে উপায় কী? এমএলএ, এমপি, চিফ সেক্রেটারি, হোম সেক্রেটারি, মুখ্যমন্ত্রী— এঁদের কাউকে দরকার নেই। শুধুমাত্র পঞ্চায়েত মেম্বাররাই এই বিপর্যয় অনেকটা সামলে দিতে পারেন। কিন্তু তাঁদের কাজে লাগানোই হচ্ছে না। পঞ্চায়েত সম্পর্কে শহুরে লোকের একটা নাক সিঁটকানো মনোভাব আছে। ধরে নেওয়া হয়, পঞ্চায়েত মানেই মূর্খদের জায়গা। এখানে শুধু দুর্নীতি হয়। কিন্তু একজন পঞ্চায়েত সদস্য যে কত কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেন, সে সম্পর্কে অধিকাংশ লোকের কোনও ধারণাই নেই।
ধরা যাক, রামবাবু একজন পঞ্চায়েত সদস্য। তাঁর এলাকায় কজন ভোটার? ধরে নেওয়া যাক, সাতশো। এই সাতশোর মধ্যে অন্তত দুশো মানুষ আছেন, যাঁদের বয়স ষাটের বেশি। তাঁরা নিশ্চয় বাইরে কাজ করতে যাননি। অর্থাৎ, এই দুশো হিসেবের বাইরে। বাকি রইল পাঁচশো। এই পাঁচশো জনের মধ্যে ধরে নিলাম, চল্লিশজন বাইরে থাকেন। সেই চল্লিশজনের মধ্যে হয়ত দশ–পনের জন পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা সূত্রে কলকাতায় আছেন। অর্থাৎ, তাঁরাও শ্রমিক নন। তাঁদের চাল, ডাল, আলুর সমস্যা অন্তত নেই। ভিনরাজ্যে আছেন, এমন হয়ত কুড়িজন। তার মধ্যে পাঁচজন চাকরি করেন। তাঁদেরও তেমন অভাব নেই। অর্থাৎ, জনা পনেরো আছেন, যাঁরা শ্রমিকের কাজ করতে বাইরে গেছেন। এঁদের সাহায্য করতে পারলে ভাল হয়।
এই ১৫ জনের নাম, ফোন নম্বর জোগাড় করা কি খুব কঠিন? একটু চেষ্টা করলে দু ঘণ্টার মধ্যেই করা যায়। তাঁদের ফোন করে আশ্বস্ত করা যায়। তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর জেনে নেওয়া যায়। সেই অ্যাকাউন্টে প্রাথমিকভাবে যদি এক হাজার টাকা পাঠাতে হয়, তাহলে লাগে পনেরো হাজার টাকা। একজন পঞ্চায়েত মেম্বারের কাছে এই টাকা জোগাড় করা কি খুব কঠিন? নিজের পকেট থেকেই দিতে পারেন। প্রধান আশ্বাস দিতে পারেন, এখন তুমি দিয়ে রাখো। পরে অন্যভাবে ‘ব্যবস্থা’ হয়ে যাবে। নইলে, এলাকায় সাতশো ভোটারের মধ্যে অন্তত দুশোজন চাকুরে, পেনশন প্রাপক আছেন। এই কঠিন সময়ে যদি তিরিশজন পাঁচশো টাকা করেও দেন, তাহলেই পনেরো হাজারের ব্যবস্থা হয়ে যায়।
একবার এই প্রক্রিয়া শুরু করলে অনেকেই আরও এগিয়ে আসবেন। পরের সপ্তাহে আরও পনেরো হাজারের ব্যবস্থা করা যায়। একটু সক্রিয় মেম্বার হলে অনায়াসে গ্রাম থেকেই একলাখ টাকা তুলতে পারেন। অর্থাৎ প্রায় দু মাসের ব্যবস্থা হয়ে যায়। এর জন্য এমএলএ, এমপি, মন্ত্রী বা ডিএম, এসপি–কারও দ্বারস্থ হতে হবে না। এমনকী প্রধানের দ্বারস্থও হতে হবে না। একজন পঞ্চায়েত মেম্বার নিজেই এই ব্যবস্থা করতে পারেন।
সবাই যদি নিজের নিজের এলাকার সমস্যা সামলে দিতে পারেন, তাহলে বড় বড় মাথাদের ভাবারই দরকার নেই। কোথাও সমস্যা হলে, তখন না হয় তাঁরা নিজেদের কেরামতি দেখাবেন। ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা না হয় পরে করা যাবে। কিন্তু আপাতত যিনি যেখানে আছেন, তিনি সেখানে যেন খেয়ে–পরে বেঁচে থাকতে পারেন, এই ব্যবস্থাটুকু করাই যায়।
কিন্তু করা যাচ্ছে না কেন? কারণ একটাই। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যেটুকু কার্যকরী ছিল, দু বছর আগে গাজোয়ারি করে দখল নিতে গেলে, তাকে গলা টিপে খুন করা হয়েছে। অধিকাংশ মেম্বারকেই ভোটে জিতে আসতে হয়নি। ফলে, তিনি এলাকা চেনেনও না। সেই তাগিদটাও নেই। পঞ্চায়েত মেম্বারের কী কাজ, সে সম্পর্কে ধারণাও নেই।
তাই পঞ্চায়েত মেম্বাররা বুঝতেও পারলেন না এই কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁরা কতখানি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারতেন। তাঁদের বোঝাবেন, এমন লোকেরও বড় অভাব। আগামী দিনেও বুদ্ধি খুলবে, এমন ভরসা কম।
গা জোয়ারি করে পঞ্চায়েত দখল করতে গিয়ে শিক্ষিত ও সমাজ মনষ্ক মানুষদের দূরে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েতগুলো ক্রমশ অকেজো হয়ে উঠছে। তারই মাশুল আজ দিতে হচ্ছে।