সরল বিশ্বাস
একসঙ্গে অনেকগুলি পুরসভার মেয়াদ শেষ। এখন ভোট করানোর পরিস্থিতি নেই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসক বসাতে হবে। এরই মধ্যে কলকাতা পুরসভায় মেয়রকেই বসানো হয়েছে প্রশাসক হিসেবে। আইনের দিক থেকে তেমন ত্রুটি নেই। আমলাকেই বসাতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। শোনা যাচ্ছে, শিলিগুড়ির ক্ষেত্রে নাকি মেয়র অশোক ভট্টাচার্যকেই প্রশাসক হিসেবে বসানো হচ্ছে। এখনও সরকারি ঘোষণা হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর নামে ধন্য ধন্য রব উঠে গেছে। তিনি নাকি রাজধর্ম পালন করছেন।
রাজ্যে দুটি ছাড়া সব পুরসভাই তৃণমূলের দখলে। ফলে, সব জায়গায় তৃণমূলের লোকেরাই প্রশাসক হিসেবে বসবেন, সেটাই ধরে নেওয়া যায়। সেই হিসেবে শিলিগুড়ির মেয়র যেহেতু অশোক ভট্টাচার্য, তাঁকেই প্রশাসক করা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাহলে এত ধন্য ধন্য রব উঠছে কেন? এত জয়ধ্বনির আয়োজন কেন? এখনও ঘোষণাই হল না। এর মধ্যেই কাউন্সিলররা ভাষণ দিতে শুরু করে দিয়েছেন! তার মানে, নবান্ন কী ঘোষণা করবে, শিলিগুড়ির কাউন্সিলররা আগাম জানেন। এতে প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ল না কমল! মন্ত্রীপদে বসার সময় ফিরহাদ হাকিম যে গোপনীয়তার শপথ নিয়েছিলেন, তা রক্ষা হল তো!
আসলে, অনেকের কাছেই ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে। এর আগে শিলিগুড়ি পুরসভাকে বা মেয়রকে পাস কাটিয়েই একের পর এক সরকারি বৈঠক হয়েছে। আর এতে ইন্ধন দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। তিনি শিলিগুড়িতে প্রশাসনিক সভা করেছেন। কিন্তু মেয়রকে ডাকেননি। ডেকেছেন তৃণমূলের কাউন্সিলরদের। কখনও কখনও মেয়রকে না জানিয়ে রাখা হয়েছে পুরসভার অফিসারদের। মেয়রকে অন্ধকারে রেখে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসজেডিএ। দিনের পর দিন শহরের মন্ত্রী হুমকি দিয়ে গেছেন, বোর্ড উল্টে দেব। আমরা দখল নেব। বরাদ্দের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের ছাপটা স্পষ্ট। মেয়র একের পর এক চিঠি দিয়েছেন, প্রস্তাব দিয়েছেন। গুরুত্ব দেওয়ার বদলে তাচ্ছিল্যই করে গেছেন রাজ্যের মন্ত্রীরা। মেয়র ফোন করে গেছেন। পুলিশ কমিশনার বা থানার ওসি ফোন ধরার প্রয়োজন মনে করেননি। পুরসভার একের পর এক প্রকল্পে ধারাবাহিকভাবে বাগড়া দিয়ে গেছেন জেলাশাসক। মুখ্যমন্ত্রীর ইন্ধন না থাকলে এটা সম্ভব ছিল? কোনও মন্ত্রীর এতখানি সাহস হত! কোনও আমলা এই স্তরের অসভ্যতা করতে সাহস পেতেন!
পাঁচ বছর ধরে সরকার এই আচরণ করে গেছে। তাই সরকার যে কখনও স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে, সেটা বোধ হয় তৃণমূল নেতারাও বিশ্বাস করেন না। সেই কারণেই তাঁকে প্রশাসক রেখে দেওয়াটা অনেকের কাছে কিছুটা বিস্ময় স্মৃষ্টি করেছে। এটা কোনও মহত্ব বা উদারতা নয়। শিলিগুড়ির মেয়রকে ফের প্রশাসক করে দিলে বাকি পুরসভাগুলিতে চেয়ারম্যানদের বসাতে আর কোনও সমস্যা হবে না। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
যদি ধরেই নেওয়া যায়, সরকার দল বিচার করেনি। যে যেখানে আছেন, তাঁকে সেখানেই রাখা হয়েছে, তাহলে এটা মহত্বের কী হল? এটা তো রুটিন মাফিক একটা কাজ। দলের ঊর্ধ্বে উঠে মহান কাজ করেছেন, এমন ঢাক পেটানোর কী মানে হয়, তা কি সেই মন্ত্রীরা বুঝছেন! এটা যদি মহত্ব হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে বাকি যেখানে যেখানে তৃণমূলের চেয়ারম্যানদের প্রশাসক নিয়োগ করা হবে, সেটা দলবাজি। আর সেটা যদি দলবাজি না হয়, তাহলে এটাও কোনও মহত্ব নয়।
আসলে, স্তাবকতা করতে গেলে বোধ–বুদ্ধি আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিতে হয়। তাই ধন্য ধন্য রব তুলতে গিয়ে আসলে সরকারকেই বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছেন। এমন নির্বোধ অনুগামী থাকলে আর বিরোধীর দরকার হয় না।