‌মহারাজা, তোমারে সেলাম

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

বেশ মনে পড়ছে, ৯ বছর বয়সে টিভিতে সোনার কেল্লা দেখার পর ফেলুদার স্টাইলে একবার বাড়ির বড়দের এনে রাখা সিগারেট ঠোঁটে ছুঁইয়েছিলাম। তখন তো সিনেমা মানে ‌সোনার কেল্লা‌, জয় বাবা ফেলুনাথ আর গুপী গাইন বাঘা বাইন ও হীরক রাজার দেশে এইটুকুই জ্ঞানগম্যি ছিল। ফেলুদার মতো করে সিগারেট মুখে গোঁজার পরে বাড়ির বড়দের নজরে পড়ে যাওয়ায় তৎক্ষণাৎ সেটা ফেলে দিতে তো হয়েছিলই, উপরন্তু ওই বয়সে সিগারেট মুখে দেওয়ায় গুরুজনদের থেকে আরও যা যা কপালে জুটেছিল, তা আর বলার বা লেখার মতো নয়। যাই হোক, ফেলুদার ওই স্টাইলটা কেন জানি না, মনের মণিকোঠায় একেবারে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছিল।

soumitra
তখন কিন্তু ভাললাগা মানে শুধুই ‘‌ফেলুদা’‌। সেই চরিত্রে যাঁকে পর্দায় দেখা যাচ্ছে, তাঁর নামটাও জানতাম না। এমনকি ‘‌ফেলুদা’‌ এল কোথা থেকে, পর্দায় ওইসব কার নির্দেশে হচ্ছে, এমনকি ‘‌সোনার কেল্লা’‌র গল্পটাই বা কার লেখা, এসব কিছুই জানতাম না। পরে বহু জায়গায় বহু বই, ছবি এবং সংবাদপত্রে, ওই সিগারেট মুখে দেওয়া ছবিটা দেখেছিলাম, তবে সেটা ফেলুদার মুখে নয়। ফেলুদার থেকেও লম্বা, একদম হলিউডের কোনও সিনেমার নায়কের চরিত্রে মানানসই একটা লোকের মুখে। আর দেখেই কেন জানি না, একটা অদ্ভূত ভাললাগা ও ভালবাসা চলে এসেছিল সেই সাড়ে ছয়ফুট দীর্ঘ লোকটার প্রতি। ভদ্রলোকের নামটা ততদিনে জেনে গেছি। প্রায় আমার নিজের নামের মতোই উচ্চারণ। তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘‌সত্যজিৎ’‌ শব্দটার মধ্যেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি ধীরে ধীরে।

আসলে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে লিখতে বসলে, সে লেখা শেষ করা খুবই দুরূহ কাজ। সারা জীবন ভদ্রলোক যা যা করেছিলেন, তার যে কোনও একটা বিষয় নিয়ে গুণগতভাবে চর্চা করতেই সাধারণ লোকের গোটা জীবন পেরিয়ে যাবে। ৩৬ বছরের চলচ্চিত্রকার জীবনে ২৯ টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি এবং ৬ টি তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টরি পরিচালনা। প্রথম জীবনের ৬ টি ছবি বাদে বাকি সবকটির সঙ্গীত পরিচালনা, ফেলুদা এবং প্রোফেসর শঙ্কু চরিত্রে প্রায় ৮০ টি দীর্ঘ এবং নাতিদীর্ঘ গোয়েন্দা এবং কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী রচনা, শতাধিক ছোটগল্প লেখা এবং সর্বোপরি ‘‌সন্দেশ’‌ সহ অন্যান্য পত্রিকায় অগণিত চিত্রাঙ্কন—এই সবকটি কাজই সত্যজিৎ রায় তাঁর চল্লিশ বছরের কর্মজ়ীবনে করেছিলেন। বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি The Bicycle Thief ছিল সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুপ্রেরণা। প্রথম ছবি ‘‌পথের পাঁচালী’‌ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫ সালে। অর্থাভাবে ছবি মুক্তির কাজ বন্‌ধ হয়ে যাওয়ায় তদানীন্তন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের আনুকূল্যে ছবিটি মুক্তি পায়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তা এককথায় মাইলস্টোন। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অপু-দুর্গার সেই মর্মস্পর্শী কাহিনীর সুত্র ধরেই পরের ছবি ‘‌অপরাজিত’‌ এবং ‘‌অপুর সংসার’‌ নির্মাণ। কলেজ জীবনে অজস্র নাটকে অংশগ্রহণ করা তরুণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নজরে পড়ে গিয়েছিলেন সত্যজিতের। বাকিটা ইতিহাস। ১৪ টি ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের সান্নিধ্য পেয়ে অভিনয় জীবনটাই বদলে গিয়েছিল সৌমিত্রবাবুর। ‘‌অপুর সংসার’‌ এর অপু, ‘‌অভিযান’‌ এর নরসিংহ থেকে চারুলতার ‘‌অমল’‌, সমাপ্তির ‘‌অপূর্ব’‌,সোনার কেল্লায় ‘‌ফেলুদা’‌, হীরক রাজার দেশের সেই অসীম সাহসী ‘‌উদয়ন পণ্ডিত’‌, ঘরে বাইরের ‘‌সন্দীপ’‌ থেকে গণশত্রুর সেই ডাক্তার অশোক গুপ্ত—সত্যজিৎ রায়ের সুনিপূণ হাতে নানা আঙ্গিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আর বাকি ছবিগুলোতে? সেখানেও অতুলনীয় চিন্তাশক্তির অধিকারী সত্যজিৎ রায় রেখেছিলেন তাঁর মৌলিকতা। ‘‌মহানগর’‌ ছায়াছবিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বামী এবং স্ত্রীর সংসারের আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে একই সঙ্গে চাকরি করা এবং শেষে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে দুজনেরই চাকরি হারানোর যে দৃশ্য পরিস্ফুটিত হয়েছিল, তা বাস্তবিকই অনবদ্য। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বনে ‘‌পোস্টমাস্টার’‌ ছবিতে ‘‌রতন’‌ এর ভূমিকায় চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য অভিনয় এবং পোস্টমাস্টারের বিদায়কালে তার সজল, করুণ মুখচ্ছবি পরশুরামের কাহিনী অবলম্বনে ‘‌মহাপুরুষ’‌ ছবিতে বুজরুকির বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রুপাত্মক বার্তা, কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কোলে নীরব প্রেমের যে দৃশ্য বা ‘‌জলসাঘর’‌ এ জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের ভূমিকায় ছবি বিশ্বাসের আভিজাত্যের যে ছবি সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছিলেন, তা একজন গুণী পরিচালকের সর্বাঙ্গীণ শ্লৈল্পিক বোধের পরিচয়।

satyajit6

বস্তুতঃ এখানেই চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অনন্য। তাঁর সমসাময়িক ঋত্বিক ঘটক অযান্ত্রিক বা মেঘে ঢাকা তারা তৈরি করে, বা মৃণাল সেন ‘‌নীল আকাশের নীচে’‌ বা ‘‌বাইশে শ্রাবণ’‌ নির্মাণ করে যখন তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলে দিয়েছিলেন, তখনই এক নতুন সত্যজিত রায়ের আত্মপ্রকাশ। ছোটদের ছবি ‘‌গুপী গাইন বাঘা বাইন’‌ এবং নিজের গোয়েন্দা উপন্যাস ‘‌সোনার কেল্লা’‌কে বড় পর্দায় নিয়ে আসা। বাংলা ছায়াছবিতে ততদিনে মূলধারার অনেক ছবিই তৈরি হচ্ছিল। ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেন ছাড়াও তপন সিংহ, অজয় কর, অসিত সেনের মতো কৃতী পরিচালকেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। শুরু হয়ে গেছিল উত্তম যুগ।
সত্যজিৎ রায় নিজেকে অন্যভাবে নিয়ে এলেন এই ছোটদের ছবি তৈরির মাধ্যমে। ছোটদের মধ্যে তো বটেই, তাদের আগের প্রজন্মের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া পড়ল এই দুটি ছবিকে ঘিরে। এর মধ্যে ‘‌গুপী গাইন বাঘা বাইন’‌ এ নিজের লেখা ছড়ায় সুর লাগিয়ে গান তৈরি করে এবং সিনেমায় গুপীর মুখে সেই গান লাগিয়ে সত্যজিৎ রায় প্রমাণ করলেন তাঁর সঙ্গীত বোধ কতটা গভীর। একটানা ১০২ সপ্তাহ চলেছিল এই ছবিটি, যা আজও ভারতীয় সবাক এবং নির্বাক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য নজির।
এই সময়ের একটু আগেই তিনি নির্মাণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘‌নষ্টনীড়’‌ অবলম্বনে ‘‌চারুলতা’‌, যা তাঁর নিজের বিচারে তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি। সত্তর দশকের উত্তাল রাজনৈতিক সময়ে যখন দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দুর্নীতিতে সমাজ আচ্ছন্ন, সেই কঠিন সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই সত্যজিৎ রায় বানিয়েছিলেন ‘‌সীমাবদ্ধ’‌, ‘‌প্রতিদ্বন্দ্বী’‌ এবং ‘‌জনঅরণ্য’‌ নামে তিনটি কলকাতা কেন্দ্রিক ছবি। এর মধ্যে ‘‌জনঅরণ্য’‌ যেমন বিতর্কিত, তেমনি তার অন্তর্নিহিত অর্থটাও ততোধিক নিগূঢ়। যে কোনও কুসংস্কার, স্বেচ্ছাচার, সামাজিক ব্যধির বিরুদ্ধে তাঁর ভাবনাশক্তি ও রূপদান অবিস্মরণীয়। ‘‌হীরক রাজার দেশে’‌ ছবিতে উদয়ন পণ্ডিতের অনাচারী হীরক রাজের বিরুদ্ধে অনমনীয় দৃঢ়তা, হিন্দি ছায়াছবি ‘‌সদগতি’‌তে জাতপাতের বিরুদ্ধে তীব্র বার্তা, ‘‌অশনি সঙ্কেত’‌ এ দুর্ভিক্ষপীড়িত সমাজের অসহনীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই প্রমাণ করেছে প্রবাদপ্রতিম এই স্রষ্টার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী।

আশির দশকে স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের ‘‌ঘরে বাইরে’‌ বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশাত্মবোধক ছবি। জ়ীবনের সায়াহ্নে এসে অশক্ত শরীরে বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের দ্বন্দ্বমূলক ছবি ‘‌গণশত্রু’‌, পারিবারিক অস্থিরতার এক বাস্তব চিত্র ‘‌শাখাপ্রশাখা’‌ এবং অগাধ জ্ঞানের অধিকারী এক ব্যক্তি যিনি একটি পরিবারে অনাহুত অতিথি হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন-সেই রহস্যাবৃত গল্প ‘‌আগন্তুক’‌—তিনটি ভিন্নধারার ছবির মাধ্যমে সত্যজিৎ রায় প্রমাণ করেছিলেন তিনি কতটা আধুনিক এবং প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী ছিলেন।

utpal dutta

তাঁর চোখ এমনভাবে কলাকুশলীদের চিনতে পারত যে সেই চরিত্রে অন্য কোনও অভিনেতাকে ভাবাই যেত না। ভাবুন তো ‘‌সোনার কেল্লা’‌য় মন্দার বোসের ভূমিকায় অখ্যাত কামু মুখোপাধ্যায় এবং তার দোসর ভবানন্দের ভূমিকায় অজয় বন্দ্যোপাধ্যয়ের অভিনয়। বা “জ়য় বাবা ফেলুনাথ” এ ভণ্ড সন্ন্যাসী মছলিবাবা রূপী মনু মুখার্জির অভিনয়। সীমাবদ্ধ ছবিতে “বরুণ চন্দ” বা “জনঅরন্যের” প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে? ‘‌আগন্তুক’‌ এ মনমোহন মিত্রের চরিত্রটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের খুব পছন্দ ছিল। করতেও চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের স্নেহধন্য এই অভিনেতা। কিন্তু উৎপল দত্তকে নেওয়ার পেছনে সত্যজিতের যুক্তি ছিল, উৎপল দত্তকে খলনায়ক চরিত্রে দর্শক সাদরে বরণ করে নিয়েছে। তাই ‘‌অনাহুত অতিথি’‌ বা ‘‌জাল দাদুর’‌ ভূমিকায় উৎপল দত্তই আদর্শ। কী অসামান্য দূরদর্শিতা!
আর বাঙালির ম্যাটিনি আইডল? উত্তমকুমার তো ‘‌মহানায়ক’‌ হয়েছিলেন সত্যজিতের হাতে ‘‌নায়ক’‌ ছবিতে অভিনয় করেই! তাই শতবর্ষেও তিনিই ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘‌মহারাজা’‌। তাঁর কথার রেশ ধরেই বলতে ইচ্ছে করছে, মহারাজা, তোমারে সেলাম।‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.