এক লেখক অন্য লেখকের লেখা পড়ছেন কই ?

পোশাকি নাম সবিতেন্দ্রনাথ রায়। বইপাড়ায় জনপ্রিয় নাম ভানুবাবু। নববর্ষ মানেই তাঁর দোকানে লেখকদের জমজমাট আড্ডা। অনেক স্মৃতি সযত্নে আগলে রেখেছেন। তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি আলাপচারিতায় স্বরূপ গোস্বামী।।

কখনও এসে গান ধরেছেন দাদাঠাকুর। কখনও আপন মনে কবিতা বলে চলেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তরুণদের উৎসাহ দিচ্ছেন তারাশঙ্কর। আবার খুব সঙ্কোচে নিজের নতুন লেখার কথা শোনাচ্ছেন শঙ্কর। কখনও হাজির হেমন্ত্ মুখোপাধ্যায়, তো কখনও আসর জমিয়ে দিচ্ছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।  পুরাতনী টপ্পা ধরছেন বুদ্ধদেব গুহ, নীরব শ্রোতা লীলা মজুমদার। নববর্ষ মানেই টুকরো টুকরো এমন নানা মুহূর্ত। নববর্ষ মানেই মিত্র অ্যান্ড ঘোষ-এর সেই জমজমাট আড্ডা। দুপুর গড়িয়ে যেত বিকেলের দিকে, সন্ধে গড়িয়ে যেত রাতে। এক প্রজন্মের সঙ্গে দিব্যি মিশে যেত আরেক প্রজন্ম। কিন্তু এসব আড্ডার কথা কে আর শোনাবেন! পুরনো মানুষেরা একে একে সবাই প্রায় চলে গেছেন। কিন্তু পুরনো অনেক স্মৃতি আগলে বসে আছেন এক প্রবীণ প্রকাশক।

হ্যাঁ, তিনি মিত্র অ্যান্ড ঘোষ-এর কর্ণধার সবিতেন্দ্রনাথ রায়। প্রকাশনার জগৎ যাঁকে একডাকে চেনে ভানুবাবু নামে। বয়স আশির গন্ডি ছাড়িয়েছে অনেকদিন। বয়স এখনও সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি স্মৃতিতে। এখনও উঠে পড়েন সাতসকালে। নানারকম বই, ম্যাগাজিন পড়তে থাকেন। নিজের হাতে প্রুফ দেখেন। বারোটা বাজতে না বাজতেই হাজির হয়ে যান কলেজ স্ট্রিটের মিত্র অ্যান্ড ঘোষ-এ। লেখকরা আসেন, পাঠরাও আসেন। অনেক নতুন পান্ডুলিপি পড়তে হয়। সন্ধে পর্যন্ত সেখানেই কেটে যায়। ফিরে এসেও বসে পড়েন বই নিয়ে। ভদ্রতা বা সৌজন্যে কোনও কার্পণ্য নেই। ফোন করে এক সন্ধেয় হাজির হয়েছিলাম তাঁর ঢাকুরিয়ার বাড়িতে। বাড়ি নয়, যেন জীবন্ত এক ইতিহাস। কত কিংবদন্তি সাহিত্যিকের স্মৃতি বিজড়িত সেই ঘর। কথায় কথায় নববর্ষের আড্ডা। কখনও নববর্ষকে ছাপিয়ে উঠে এল প্রকাশনা জগতের অনেক অজানা কথা। সেই আলাপচারিতার কিছুটা নির্যাস বরং তুলে ধরা যাক।

bhanu babu chhobi 3

প্রশ্নঃ  বাংলা নববর্ষ মানেই তো আপনার দোকানের সেই জমজমাট আড্ডা।

ভানুবাবুঃ হ্যাঁ, দেখতে দেখতে সেই আড্ডার বয়স সাতষট্টি বছর হয়ে গেল। মিত্র অ্যান্ড ঘোষ-এর পথ চলা শুরু ১৯৩৪-এ। খুব অল্প বয়সেই আমি এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। তবে নববর্ষের আড্ডা বলতে যা বোঝায়, তা শুরু হয় ১৯৪৯ নাগাদ। তখন থেকেই বিভিন্ন সাহিত্যিকরা আসতেন। যত দিন গেল, সেই আড্ডার কথা ছড়িয়ে গেল। সেই সময়ের অধিকাংশ বড় বড় লেখকই একবার না একবার ঢুঁ মেরে যেতেন সেই আড্ডায়। তবে পয়লা বৈশাখ খুব ভোরেই যাই দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে বারোটা নাগাদ যাই দোকানে। তখন থেকেই সাহিত্যিকদের আসা যাওয়া শুরু। একেক সময় একেকজন আসতেন। আড্ডা চলত রাত নটা-দশটা পর্যন্ত।

প্রশ্নঃ  সেই আড্ডায় নাকি দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পন্ডিতও আসতেন। তিনি আসা মানেই অনেক মজার মজার ঘটনা। সেগুলো মনে পড়ছে ?

ভানুবাবুঃ  দাদাঠাকুর মানেই এক বর্ণময় চরিত্র। তিনি বেশ কয়েকবার এসেছেন এই আড্ডায়। আর তিনি থাকা মানে তিনিই হয়ে উঠতেন মধ্যমণি। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একবার ব্র্যবোর্ন রোডে তাঁর সঙ্গে দেখা। বললাম, যাবেন না ? বললেন, হ্যাঁ, তোদের ওখানে তো একবার যেতেই হবে। আমি বললাম, দাঁড়ান, একটা ট্যাক্সি ডেকে আনি। উনি বললেন, ‘ট্যাক্সির দরকার নেই। দা আছে দুটো, কুড়ুল আছে একটা। কাটতে কাটতে চলে যাব।’ দা-কুড়ুল মানে বুঝলাম না। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ওরে, আমার নামের শুরুতেই দাদা, অর্থাৎ দুটো দা। আর ঠাকুরকে একটু উল্টেপাল্টে দিলেই কুঠার হয়ে যাবে। পায়ে হেঁটেই চলে এলেন। এসে একাই জমিয়ে দিলেন। গান ধরলেন কলকাতা ভুলে ভরা। আড্ডায় সজনীকান্ত দাসও হাজির। তিনি দাদাঠাকুরকে বললেন, ‘দাদাঠাকুর, কোথায় যাবেন, বলুন। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। আপনাকে ছেড়ে দেব।’ দাদাঠাকুর বললেন, ‘সারা জীবনে অনেক পাপ করেছিস, আমাকে গাড়ি চাপিয়ে একটু পুণ্যি সঞ্চয় কর।’ সজনীকান্ত বললেন, কেন, কী পাপ করেছি ? দাদাঠাকুর বললেন, ‘কত নিপাতনে সিদ্ধ লেখককে মেরে ফেলেছিস। দিকপাল সব লেখককে কত গালমন্দ করেছিস। এটা পাপ নয় !’

প্রশ্নঃ  আর কারা আসতেন ?

ভানুবাবুঃ কাকে ছেড়ে কার কথা বলব ? তারাশঙ্কর থেকে নীহাররঞ্জন গুপ্ত। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত থেকে প্রমথনাথ বিশী, সজনীকান্ত দাস, লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, শঙ্কর, নিমাই ভট্টাচার্য, নলিনীকান্ত সরকার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার। এখনও সেই আড্ডা বসে। এখন এই প্রজন্মের লেখকরা আসে। ভগীরথ মিশ্র তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, বাণী বসু, প্রচেত গুপ্তরা একবার না একবার ঠিক আসে। বুদ্ধদেব গুহ নিয়মিত আসতেন। পুরাতনী টপ্পা গাইতেন। কিন্তু স্ত্রী ঋতু গুহ মারা যাওয়ার পর থেকে আসেননি। কেউ প্রবীণ, কেউ আবার তখন সবে সাহিত্য জগতে পা রেখেছেন। নবীন-প্রবীণ মিলে যেত ওই একটা দিনে।

প্রশ্নঃ শুধু লেখকরা ? অন্য জগতের লোকেরা আসতেন না ?

ভানুবাবুঃ হ্যাঁ, তাও আসতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন। সবাই গান গাওয়ার আবদার করল। হেমন্তবাবু বললেন, গান করতে তো আসিনি। এসেছি গজেন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। সবাই মিলে কত আড্ডা হচ্ছে, এই তো ভাল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তো প্রতিবারই আসতেন। তিনি থাকলে যা হয় ! একাই আসর জমিয়ে দিতেন। একবার ভানু বাবু একটা বইয়ে্র ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেন। আমি বললাম, কাউন্টারে যাবেন নাকি ! ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বই কিনব ? ক্ষেপেছিস ? আমাকে বই কিনতে দেখলেই লোকজন গালাগাল দেবে। বলবে, এই দেখ, শালা ভানুও বই পড়ছে। উত্তম কুমার বই পড়লে ক্ষতি নেই। আমি বই পড়লেই যত দোষ। যেন আমার বই পড়ারও যোগ্যতা নেই।’ একবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে নিয়ে এক সমস্যা। বীরেনবাবুর সঙ্গে ছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। তিনি এসেই বললেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অভদ্র। এক ট্রামে একসঙ্গে এলাম। কোনও কথাই বলল না। যা জিজ্ঞেস করলাম, শুধু হুঁ হুঁ করে গেল। এ কেমন ভদ্রতা ? তখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, ‘মুখ খুলে কি বিপদ বাড়াব ? মুখ খুললেই তো আওয়াজ শুনে লোকে বুঝে যেত, বীরেন্দ্র ভদ্র যাচ্ছে। এরকম নানা টুকরো টুকরো ঘটনা। সব একসঙ্গে মনেও পড়ে না।

প্রশ্নঃ সেদিন এত লেখককে সামাল দিতেন কী করে ? সবাই কি মাটিতেই বসতেন ?

ভানুবাবুঃ দোকানে বসার জায়গা কোথায় ? দোকান তো বইয়ে ঠাসা। পয়লা বৈশাখ বিক্রি একটু বেশি হয়। ফলে, আরও বেশি বই রাখতে হত। এর মাঝে আলাদা করে বসার আয়োজন করা মুশকিল হয়ে যেত। তারই মাঝে কিছু চেয়ার, কিছু টুল থাকত। অনেকে মাটিতেও বসতেন। তাছাড়া, সবাই তো একসঙ্গে থাকতেন না। কেউ হয়ত দুপুরে এসে ঘণ্টাখানেক থেকে চলে যেতেন। কেউ আসতেন বিকেলের দিকে। সবমিলিয়ে কুলিয়ে যেত। সমস্যা হত না। আসলে, কে টুলে বসলেন, কে বইয়ের উপরে বসলেন, এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কেউ মাথাও ঘামাতেন না। সবাই একসঙ্গে হই হুল্লোড় করতেন, সেটাই আসল কথা।

প্রশ্নঃ নিশ্চয় খাওয়া দাওয়ার আয়োজন থাকত। লেখকদের কী উপহার দিতেন ?

ভানু বাবুঃ সকাল থেকেই শুরু হয়ে যেত খাওয়া দাওয়ার পর্ব। সারাক্ষণই চলত। কখনও মিষ্টি, কখনও নোনতা। আলুর দম, ফুচকা, চুরমুর, সব ব্যবস্থাই থাকত। আর দফায় দফায় চা, কফি, শরবত তো আছেই। কেউ ভোজনরসিক, তিনি হয়ত একটু বেশি খেলেন। কেউ বাড়ি থেকে খেয়ে আসতেন। তিনি দু একটা মিষ্টি মুখে তুলতেন। কেউ প্যাকেটে করে বাড়ি নিয়ে যেতেন। সবমিলিয়ে একটা উৎসবের পরিবেশ থাকে। লেখকদের নানারকম উপহার দেওয়া হয়। দামি পেন, ফোল্ডার, বই তো থাকেই। বিভিন্ন বছরে নানারকম উপহার। তবে উপহার যা দেওয়া হবে, সবাইকে একইরকম। বই দেওয়া হলে, সবাইকে একইরকম বই দেওয়া হয়। তবে জীবিত লেখকদের বই সাধারণত দেওয়া হয় না। এক লেখকের বই দেওয়া হলে অন্য লেখকের খারাপ লাগতে পারে। তাই মৃত লেখকদের বইই দেওয়া হয়। একবছর দিয়েছিলাম ‘খেয়ালখুশির খাতা।’

প্রশ্নঃ  খেয়াল খুশির খাতা! সেটা আবার কার লেখা ?

ভানুবাবুঃ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লেখকরা এসে একটা খাতায় যা খুশি লিখে রাখতেন। নানা মজার মজার মন্তব্য । সমস্ত দিকপাল সাহিত্যিকদের নানা মজার কথা আছে এই খাতায়। একটা ঐতিহাসিক দলিলও বলতে পারেন। সেই মন্তব্যগুলোই দু বছর আগে বইয়ের আকারে প্রকাশ করা হয়েছিল। সাহিত্যের অনেক অজানা দিক সেখানে আছে।

প্রশ্নঃ শুনেছি, পয়লা বৈশাখ নাকি লেখকদের সম্মান দক্ষিণাও দেওয়া হয়। আপনার এখানেও কি সেই ট্রাডিশন আছে ?

ভানুবাবুঃ  হ্যাঁ, এই ট্রাডিশনটা অনেকদিনের পুরানো। পয়লা বৈশাখ লেখকদের প্রাপ্য টাকা দেওয়া হয়। তবে সবসময় পুরোটা দিতে পারি না। চেষ্টা করি, ওই দিন অন্তত কিছুটা দেওয়ার। সবার পাওনা সমান হয় না। কারও হয়ত পাঁচটা বই আছে, কারও একটা। কারও নতুন বই নেই, কিন্তু পুরানো বই বাবদ রয়্যালটি আছে। তাই সবার টাকার অঙ্কটা সমান হয় না। যার যেমন পাওনা, সেই অনুযায়ী আলাদা আলাদা খাম তৈরি থাকে।

প্রশ্নঃ ওই দিন কি বইয়ে উদ্বোধনও হয় ?

ভানুবাবুঃ হ্যাঁ, অনেক লেখক ওই দিন বই প্রকাশ করতে চান। তবে এখন আর ঘটা করে উদ্বোধন করি না। এর একটা কারণ আছে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর লেখা পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ বইটার কথা নিশ্চয় শুনেছেন। ওই বইটা পয়লা বৈশাখ বেরিয়েছিল। দাম ছিল কুড়ি টাকা। সেদিন বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছিল। বই কেনার জন্য এমন হুড়োহুড়ি, সামাল দেওয়াই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিনে দশ হাজার কপি শেষ। কলেজ স্ট্রিটের অন্য প্রকাশকদের ব্যবসা সেদিন প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সেই থেকে আর ঘটা করে উদ্বোধন হয় না। তবে ওই দিন পাঠকদের মধ্যেও বই কেনার একটা বাড়তি তাগিদ থাকে। অন্যান্য দিনের তুলনায় কিছুটা ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। তার থেকেও বড় আকর্ষণ, ওই দিন দোকানে এলে লেখকদের হাতের কাছে পাওয়া যায়। তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যায়। তাঁদের দিয়ে বইয়ে সই করিয়ে নেওয়া যায়।

bhanu babu boi 2

প্রশ্নঃ সেদিনের পয়লা বৈশাখ আর এদিনের পয়লা বৈশাখ। তফাতটা কোথায় ? সেই জৌলুস কি আর আছে ?

ভানুবাবুঃ সবকিছুতেই তো জৌলুস কমছে। পয়লা বৈশাখের আড্ডাও তার ব্যতিক্রম নয়। এখনও আড্ডা হয়। এই সময়ের অনেক লেখক আসেন। কিন্তু সেই প্রাণটা যেন থাকে না। আসলে, এখন সবাই বড় ব্যস্ত। আগে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিক নতুন‌ লেখকদের লেখা পড়তেন। উৎসাহ দিতেন। এখন সেই পড়ার আগ্রহ দেখি না। একজন আরেকজনের লেখা না পড়লে সেই একাত্মতা আসে না। সেই বর্ণময় চরিত্রও নেই। সেই আড্ডা দেওয়ার অবসরও নেই। আগে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হত। এখন তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিতে হয়।

প্রশ্নঃএখনকার লেখকরা তাহলে পড়ছেন না !

ভানুবাবুঃ সবার সম্পর্কে এমনটা বলা হয়ত ঠিক হবে না। কিন্তু সার্বিকভাবে বলতে গেলে, পড়ার আগ্রহটা সত্যিই কমেছে। ভাল লেখা না পড়লে নিজের লেখাও সমৃদ্ধ হবে না। জীবনকে আরও গভীরভাবে দেখতে হয়। যে বিষয়টি নিয়ে লিখছেন, সেটি আরও ভালভাবে জানতে হয়। এই জানার চেষ্টাটাই অনেকের মধ্যে দেখি না। কিন্তু একজনের নাম বলতেই হবে, সমরেশ মজুমদার। ও কিন্তু কোনও বিষয়ে লেখার আগে সেটা ভালভাবে জেনে নেয়। অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতেও ওর কোনও সঙ্কোচ নেই। মাঝে মাঝেই ও ফোন করে অনেককিছু জানতে চায়। যেটা জানি, সেটা বলি। অন্যদের কাছেও জানতে চায়। কিন্তু এই অভ্যেসটা বাকিদের মধ্যে দেখি না। তারা হয়ত ভাবে, কিছু জানতে গেলে হয়ত ছোট হয়ে যাবে।

প্রশ্নঃ শুনেছি, প্রকাশকদের নাকি লেখকদের থেকেও অনেক বেশি পড়তে হয়।

ভানুবাবুঃ  হ্যাঁ, লেখকদের না পড়লেও চলে। কিন্তু প্রকাশককে পড়তেই হয়। তার কোনও ফাঁকিবাজি চলবে না। বইয়ের পান্ডুলিপি পড়েই বুঝতে হয়, এই বই চলবে কিনা। চললে, কখন চলবে। শুধু লেখকের নামে তো বই কাটে না। ভাল বিষয়ও থাকতে হয়। আবার অনামী লেখকের ভাল বইও অনেক সময় মানুষের কাছে পৌঁছয় না।

প্রশ্নঃ এখন যদি কোনও লেখকের উপর বাজি ধরতে হয়, কার উপর ধরবেন ?

ভানুবাবুঃ প্রথমেই সমরেশ মজুমদার। লেখার একটা অদ্ভুত বাঁধুনি আছে। বিষয়টাকে ভালভাবে জেনে, তারপর লেখে। যা লেখে, সবাই বুঝতে পারে। এরপর নবনীতা দেবসেন। ওর লেখার মধ্যে অদ্ভুত একটা ভ্যারিয়েশন আছে। সব ধরনের লেখাই লিখতে পারে। আর এই সময়ের লেখকদের মধ্যে বেছে নেব প্রচেত গুপ্তকে। ওর গল্প বলার কায়দাটা ভারী অদ্ভুত। অনেক ছোটখাটো বিষয়কেও লেখার গুনে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। এমন একটা আকর্ষণ আছে, যা আপনাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে।

bhanu babu boi

প্রশ্নঃ প্রকাশকের পাশাপাশি আপনি নিজেও তো একজন লেখক। কিন্তু লোকে বলে, অনেক দেরিতে কলম ধরলেন। এর জন্য আফসোস হয় না ?

ভানুবাবুঃ সে অর্থে আমি লেখক নই। আমি মূলত একজন প্রকাশক। লেখকদের সান্নিধ্যে এসে অনেককিছু শিখেছি। দোকানে অনেক দিকপাল মানুষ আসতেন। কবিশেখর কালিদাস রায় বলেছিলেন, ‘এখানে যা আলোচনা হয়, তা লিখলেই একটা ভাল বই হয়ে যায়।’ কিন্তু আমি তো আর লেখক নই। তবু যে সব ঘটনা মনে দাগ কাটত, নোট করে রাখতাম। সেইসব স্মৃতি নিয়ে লিখেছিলাম ‘কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর’। এটা আমার আত্মকথাই বলতে পারেন। এই বই পড়লে লেখকদের অনেক কথা জানতে পারবেন। পরে অনেকে বলল, বিভিন্ন লেখকদের সঙ্গে স্মৃতিকথা তুলে ধরতে। তখন লিখলাম, ‘লেখকের কাছাকাছি’।

প্রশ্নঃ  কোন বই কেমন চলবে, আগাম বুঝতে পারেন ?

ভানুবাবুঃ হ্যাঁ, পারি। অভিজ্ঞতা থেকেই পারি। এর জন্য নিজেকে পাঠক হতে হয়, পাঠকের পালস বুঝতে হয়। কোনও বই হয়ত শুরুতে তেমন ছাপ ফেলে না। কিন্তু যত দিন যায়, কদর বাড়ে। সেটাও আগাম বুঝতে হয়। আবার কোনও বই শুরুতে দারুণ বিক্রি হলেও পরের দিকে থেমে যায়। পাঠকদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের চাহিদা বোঝার চেষ্টা করি। সবমিলিয়ে একটা পালস বুঝতে পারি।

প্রশ্নঃ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়েও, এই বয়সেও নিজেই নাকি প্রুফ দেখেন।

ভানুবাবুঃ হ্যাঁ, তা দেখতে হয়। সব না হলেও কিছু তো দেখতেই হয়। লেখকরাও সবসময় প্রুফ দেখতে পারেন না। বড় লেখক হলেই নির্ভুল বানান লিখবেন, এমনটা সচরাচর হয় না। কাজটাকে ভালবাসি তো, তাই যত্ন নিয়েই করি। চেষ্টা করি, যতটা সম্ভব, নির্ভুল ছাপতে। কোথাও কোনও বানান ভুল থাকলে কষ্ট হয়। তাই, এই বয়সেও যতটা পারি, চেষ্টা করি।

(‌লেখাটি  তিন বছর আগে পয়লা বৈশাখ বেঙ্গল টাইমসেই প্রকাশিত হয়েছিল। এই পয়লা বৈশাখ আবার ছাপা হল। সাক্ষাৎকারটি এখনও একইরকম প্রাসঙ্গিক। সাহিত্য ও প্রকাশনা জগতের অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারে।)‌

বেঙ্গল টাইমসের নতুন ই ম্যাগাজিন। রয়েছে অনেক আকর্ষণীয় লেখা। ক্লিক করুন। দ্রুত পড়ে ফেলুন।

https://www.bengaltimes.in/Bengaltimes-lockdownIssue.pdf

cover.indd

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.