বুকের আগুন বাঁচিয়ে রাখাকে সন্ত্রাসবাদ বলে

 

অম্লান রায়চৌধুরী

ভূতোদা আজকাল ঠেকে বেশি আসছে না। শোনা গেছে, কোনও এক কাজে নাকি খুব ব্যস্ত। খুব নাকি পড়াশুনো করছে। তবে আমি বেশ কয়েকদিন ধরে ভাবছি যে, ভূতোদার অনুপস্থিতিতে আমি যেন একটু স্বাচ্ছন্দ বোধ করছি। ভূতোদা যেমন বুদ্ধিমান তেমনই জ্ঞানী। বুঝতে পারছি যে, বেশি বুদ্ধিমানদের সঙ্গে মেলেমেশা করলে বা বেশি সময় কাটালে নিজের বুদ্ধি ধীরে ধীরে লোপ পায়। যেমন অনেক সময়ই দেখেছি যে যে ভাবনাটা আমি ভেবেছি বা কিছুটা বলতে পারি বলে মনে করছি বলতে গেলেই ভূতোদা মাঝখান থেকে ওটাকে নিয়েই এমন বিশ্লেষণ করবে যে, আমার নিজের ভাবা উত্তর দেওয়ার আর কোনও প্রয়োজন থাকে না। আমি কেমন যেন মোহিত হয়ে শুনতে থাকি। আমার ভেতরের যে সমস্ত বিশ্লেষণী শক্তি ছিল, কাজে লাগাতে পারলাম না – ভূতোদার যুক্তি সব মেনে নিলাম – ভুলে গেলাম আমার নিজস্বতা। এটাই বুদ্ধি লোপ পাওয়ার একটা স্তর বলে মনে হয় আমার।

তা বলে তো ভূতোদা’কে বাদ দিয়ে চলবে না। তাকে আসতেই হবে। না এলে আমরা অনেক নতুন জিনিস জানব কোত্থেকে। ওঁর জ্ঞান সম্বন্ধে কোনও রকমের সন্দেহ আমার নেই – মান্যতাও দিই বা দেবই। সেন্টু অবশ্য বলল, ভূতোদা নাকি সকাল বেলায় কোথায় চলে যায়, ফেরে সেই সন্ধ্যার পরে – একটু রাত করে। চিন্তা হল আমাদের। অপেক্ষায় ছিলাম, সামনের রবিবার নিশ্চয়ই আসবে।

রবিবারের সকালে, ঠিক এগারোটায় সেই ভূতোদার আবির্ভাব। সারা ঠেকে কলরোল। নানান প্রশ্ন। এত দিনের অনুপস্থিতিতে অনেকের অনেক প্রশ্ন। শুরু করার আগে ভূতোদার সেই চিরাচরিত জায়গা, দোকানের একেবারে কোনার দিকটায় গিয়ে বসা, বসেই অসীমকে বলা একটা চা দিতে, চা আসতে আসতেই, সেন্টুর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষুণ গুম হয়ে বসে রইল। আমারা সকলেই বেশ উদ্বিগ্ন — এ বার কী নিয়ে শুরু হবে। তনুর দিকে তাকাল, আমরা জানি, তনু হল ভূতোদার প্রথম টার্গেট। বলল, তনু তুই তো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক রাজনীতি করেছিস, কত প্রতিবাদ, মিছিল, ধর্ণা, ঘেরাও করেছিস, কোনও দিন বিদ্রোহর কথা ভেবেছিস, নাকি বিদ্রোহর সঠিক মানেটাই বুঝতিস না, নাকি তোদের দলের কাছে বিদ্রোহটা শব্দ বন্ধতে আসত না।

adda
তনু একটু হতচকিত হয়ে বলে উঠল, প্রতিবাদ বা আন্দোলন যে শ্রেণী করে, তারা বিদ্রোহ করে না – সঙ্গে হয়ত থাকে। কিন্তু বিদ্রোহের আঁচে নিজেদেরকে মেলায় না। ঠেকের সবাই চমকে উঠল, সবাই ভূতোদার দিকে তাকিয়ে আছে তার রিপারকেশনটা কী দেখার জন্য।
সেন্টু কিছু বলতে যাচ্ছিল তনুকে, ভূতো দা থামিয়ে দিয়ে বলল তনু, জায়গাটা ঠিকই ধরেছিস। একটু খোলসা করে বল দেখি ব্যাপরটা কী। দেখি কেমন শিখেছিস এত দিনের রাজনীতি থেকে। তনু বলতে আরম্ভ করল, দেখো ভুতো দা, প্রতিবাদী লোকজন দু প্রকার। উচ্চবর্ণীয় – ভদ্রলোক, তারা সমাজ–‌সংসারের নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকে – প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নানা ক্ষমতায় জড়ানো, কিছু ক্ষেত্রে ভাগীদারও হয়, সুযোগ তো নেয়ই। তারা বিদ্যে ভরা ভদ্রলোক। প্রখর বুদ্ধিমান। কিছু ব্যতিক্রম আছে, সেগুলোকে বাদ দিলে তারা মোটামুটি শাসকের প্রিয় হয়। আর এটা বুঝতে পারে বলে – অন্তত প্রকাশ্যে শাসকের অপ্রিয় হতে চায় না। এই ভদ্রলোকেরা কখনও বিদ্রোহ করে না, তবে আন্দোলন করে, প্রতিবাদী আন্দোলন। তার নানা ধরন–‌ ধর্ণা, অবস্থান, প্ল্যাকার্ড, অনশন, মিছিল, এমন কী ঘেরাও। সবই হয় গণতন্ত্রের কাঠামোকে মান্যতা দিয়ে। তবে রাস্তার দুপাশে দর্শক থাকতেই হবে। আন্দোলন আর প্রতিবাদের ভাষা মাঝে মধ্যে একটু কর্কশ হয়ে যেতে পারে, তবে যত যাই–‌ই হোক, তার একটা নিয়ম শৃঙ্খলা থাকতেই হবে, মানে একটা ছক – শাসকের চেনা ছক, পাবলিকেরও ।

নিম্নবর্ণীয় বা ছোটলোক–এরা আন্দোলন করে না, তাই বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ কোনও শৃঙ্খলা মানে না, মুক্ততা বা স্বতস্ফূর্ততা থেকে, গভীর তাড়না থেকে উঠে আসা — যেখানে মরণ বাঁচনটাই প্রধান। তাই লড়াইটাতে জান লড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার – ওটাই বিদ্রোহ। হ্যাঁ, ওই বিদ্রোহে কিছু জনসাধারণ থাকে – যারা লেংচে লেংচে যোগদান করে, কারণ তারা দ্বিধাগ্রস্ততার নাগপাশ থেকে কোনও দিনই মুক্ত হতে পারে না। যেমন সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, তিতুমির, নকশাল বিদ্রোহ। তাতে কিছু ভদ্রলোক সামিল হতেও পারে। অনেকে ভাবে নকশাল বিদ্রোহ ছাত্র যুবাদের বিদ্রোহ, অথচ তা যে মুলত কৃষক বিদ্রোহ বা আসলে নেহাতই ছোটোলোকদের বিদ্রোহ – সে কথা তারা ভুলে যায়। আমরা দেখি যে, জঙ্গলে আর পাহাড়ে দর্শক নেই, তাই ছত্তিশগড়ের আদিবাসীরা আন্দোলন করে না, বিদ্রোহ করে। সব বিদ্রোহ সফল হয় না। বিদ্রোহের রেকর্ডে–কোনও তাৎক্ষণিক সাফল্য নেই, তাদের তাৎপর্য ভবিষ্যতের আলোচনায় বা অবস্থানিক পরিবর্তনে। সেরকমই সব প্রতিবাদী আন্দোলনও সফল হয় না। রাষ্ট্রও বিদ্রোহকে সমীহ করে, কিন্তু আন্দোলন কে করে না। বরং কিছু ক্ষেত্রে চায় জিইয়ে রাখতে – এতে নাকি দৃষ্টির পরিধি বাধা পায়, সব দেখতে পায় না, রাষ্ট্রের কাছে এটা একটা বড় পাওয়া। জিইয়ে রাখা আন্দোলনে দর কষাকষির সুযোগ থাকে, কিছু ছাড়া কিছু পাওয়ার রাস্তাটা বেশ খুলে যায়। তাই সমীহ করে না।

ভদ্রলোক বা উচ্চ বর্ণীয়রা সব সময়েই সুবিধাবাদী, এটা প্রমাণিত সেই আদি কাল থেকে। সুবিধাভোগী হিসাবে ব্রাহ্মণ কুলদের নিয়ে, যারা আজকের যুগের কর্পোরেট এক সুন্দর গল্প বলা যেতে পারে এই প্রসঙ্গে– সুলতানি যুগে ব্রাহ্মণরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও তাঁরা ছিলেন সুবিধাভোগী শ্রেণি। যেমন, তাঁদের জিজিয়া কর দিতে হত না। (যেমন দিত না নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী সৈনিকরা)। ফিরুজ তুঘলক ছিলেন গোঁড়া। তিনি ব্রাহ্মণদেরও জিজিয়ার আওতায় নিয়ে আসেন। সামস ই সিরাজ আফিফের লেখা তারিখ-ই-ফিরুজশাহি-তে উল্লেখ আছে। এর প্রতিবাদে দিল্লির ব্রাহ্মণরা আন্দোলনে নামেন এবং আত্মাহুতির হুমকি দেন। ফিরুজ তাতেও পিছপা না হলে নিম্নতর বর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের হয়ে জিজিয়া কর প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণরা এতে খুশি হয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। ফিরুজও তখন জিজিয়ার হার কিছুটা কমিয়ে দেন। এটা এক ধরণের নিম্নবর্গীয় লোকেদের উদারতা বা ভয় পাওয়া, কারণ তখনকার দিনে ব্রাহ্মণদের যেমন চটিয়ে নিস্তার পাওয়া যেত না, তেমনই আজকের দিনেও কর্পোরেটদের চটিয়ে রাষ্ট্রও চালানো সম্ভব নয় ।

student

ভদ্রলোক বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের এখনও সেই ব্রাহ্মণই ভাবে। এটা ঠিক যে, এই তথাকথিত ছোটোলোকেরা যতদিন এই বুদ্ধিমানদের পরামর্শ মেনে চলবে অন্ধের মতন, প্রভাবিত হবেন, ততদিনই তাদের বুদ্ধির লোপ পেতে থাকবে – এটা রাষ্ট্রের জানা এবং বোঝা। এর প্রমাণ আমরা দেখি যখন ওই শ্রেণীর বুদ্ধিতে প্রণোদিত হওয়া কোনও আন্দোলন দানা বাঁধে, রাষ্ট্র পাত্তা দেয় না – কোনও রকমের দুশ্চিন্তায় থাকে না। কারণ, রাষ্ট্র জানে যে ওই বুদ্ধির আসল উদেশ্য সামনে এলে, সেটা বুদ্ধিভ্রংশাবস্থাতে গিয়ে ঠেকতে বেশি সময় লাগবে না – কাজেই চিন্তার কিছু নেই।
ভূতোদা অবাক হয়ে শুনছিল এতক্ষুণ। বলল, বলে যা আজকে তোর কাছ থেকেই শুনব। তনু বলল, না ভূতোদা, যে প্রসঙ্গটা নিয়ে এই আলোচনা ওটার শেষটা তুমিই টানো। ভুতোদা শুরু করল, যে প্রসঙ্গটা নিয়ে এই লেখার অবতারণা সেটা হল, এই যে সামাজিক গঠন এবং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যেকার এই যে অবস্থা , তাতে ছাত্র সমাজের কাছে খুব একটা ইম্প্যাক্ট এসেছে কি – যদিও ছাত্রেরা এই নানা শেণীর থেকেই উঠে আসা। সেটা বোঝার চেষ্টা করা তাদের নানাবিধ কাজকর্ম দেখে।

রাষ্ট্র ছাত্রদের ভয় পায় তাদের এই বিদ্রোহী মনোভাব দেখে – উদ্দামতা দেখে , সারল্য দেখে, আবেগের টান দেখে। এগুলো ছাত্রদের এক রক্তের তরলতা ও বহমনতার সুন্দর মেলবন্ধনের উপহার হিসাবে ভাবা যেতে পারে। খুবই স্বাভাবিক। অবশ্য আমরা দেখি যে অতি বুদ্ধিমান ছাত্ররা বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ কোনওটাই করে না। বড় হয়ে বুদ্ধিজীবী হয় – শাসক আশ্রিত হতেই হয় আত্মপরিচিতির তাগিদে। হয়ও। তখন আবার তারাই ছাত্রদের বলে এভাবে সম্ভব নয়, একটু ভাবতে হবে, তবেই এগোতে হবে। হঠকারিতা কর না। যেমন তারা হঠকারিতা করেনি, নিজেদেরকে সুস্থ ও স্থিত করতে পেরেছে কেবল দূর থেকে আন্দোলন বুঝে, বুদ্ধিটাকে গুপ্ত ও পোক্ত রেখে।

বিদ্রোহী ছাত্ররা বুদ্ধিদীপ্ত – চৌখস – সপ্রতিভও বটে কিন্তু তারা বুদ্ধিজীবী নয়। মানে, সহজ কথাটা তারা শক্ত করে উপস্থাপিত করার কৌশল গুলো জানে না বা জানার প্রয়োজন মনে করে না। তারা যেটা করে, বুকের টান থেকে করে, সে আন্দোলনই হোক কিংবা বিদ্রোহই হোক। তাদের আন্দোলনে শৃঙ্খলা থাকে, গণতান্ত্রিকতায় বাঁধাও থাকে, কিন্তু তাদের আন্দোলনে যেটা থাকে তা এক মারাত্মক বার্তা রাষ্ট্রের কাছে – যেখানে লুকিয়ে থেকে প্রতিহর্তার বীজ – নিবারক বা প্রত্যাঘাতকারীর লুকানো ভাবনা। তাই রাষ্ট্র চিন্তিত। রাষ্ট্র ওই প্রতিহর্তার দাবানলকে ভয় পায়, কেননা সেখানে চালাকির সুযোগ কম, দরদস্তুরের পাঁয়তারা কষার অবকাশ কম। যেটা সাধারণ ভাবে অন্যশ্রেণীর আন্দোলনে আসে না।

দুনিয়া জুড়ে সব ছাত্র আন্দোলনেই এই দৃশ্য দেখা যায় । এই অবস্থা সমস্ত রাষ্ট্র কেই দেখতে হয়েছে বহুকাল ধরে — সর্বত্রই ছাত্র আন্দোলনের বা বিদ্রোহের ইতিহাস এমনই। সেই আন্দোলন দেখতে পথের দুপাশে দর্শকের ভীড়ের তোয়াক্কা তারা করে না, মিডিয়া নিজের দায়ে তাদের সঙ্গে মেশে, জানে, শোনে, গল্প বানায় — নিজেদের টিআরপি–‌র খোঁজে।
আমাদের দেশে এটা দেখে একটা ব্যাপারে এখনও আমাদের নিশ্চিন্তি আছে যে তারা সেই আগের কথার ছোটলোক শ্রেণী – তাই এত সাহস, স্পর্ধা – তাদের বুদ্ধি যে এখনও লোপ পায়নি বুদ্ধিমানদের পাল্লায় পড়ে – এটা সুখের। তাই তাদের এই সাম্প্রতিক কালের রাষ্ট্রের চেহারা আর কার্যকলাপ তাদেরকে করে তুলেছে বিদ্রোহী, প্রতিবাদী।

বহু মানুষ বা দল মুখিয়ে আছে তাদেরকে নিজেদের বলে দাগিয়ে দিতে । তারা কারুর নয় এটা প্রমাণিত । তারা কোনও আচ্ছাদন চায় না, এটাও সত্যি। তারা নিজেদের মতো করে বুঝছে অবস্থাটা, যেটা আর পাঁচটা মানুষও বুঝছে – এটা এক ধণাত্মক দিক বলা যায়, এটাই তাদেরকে সাহস জুগিয়েছে।

কিন্তু এই প্রতিবাদের ধরনে কিছু ছক বা শাসক প্রীতি আন্দোলনের চিরাচরিত ধারার সঙ্গে মিল না খাওয়ার সব গুণই বর্তমান বলে কারুর কারুর মন্তব্য শোনা গেছে। তাদের এই প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ যাই ই বলিনা কেন, কতটা সংবিধানযোগ্য, কতটা ব্যকরণ সম্মত তাদের আচরণ — এই নিয়ে অনেকেই সরব। কিন্তু ছাত্ররা যদি ভাবে যে, জনজীবন এক বন্দীদশার মধ্য দিয়ে চলছে। এই প্রসঙ্গে মিচেল ফুকোর – Discipline and Punish বইটা সম্বন্ধে দুচার কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। ফুকো দেখিয়েছেন যে – এক জেলের আকার বা ব্যবহার বা শাস্তির ধরণ কেমন হবে, যেটা আজ সারা দেশেই বা সারা পৃথিবীতেই প্রচলিত। ১৯৭৫ এ লেখা এই বইটি দেখিয়েছে এক আধুনিক জেলখানার মতন এক সমাজ কে – যেখানে, জেরেমি বেন্থামের তৈরি করা – ‘প্যানোপটিকন’-এর সঙ্গে তুলনা করেন, যা তার আদিরূপে ব্যবহৃত না হলেও অত্যন্ত প্রভাবশালী।

jadavpur1

প্যানোপটিকনে, একা একজন রক্ষী অনেক কয়েদিকে দেখতে পায় যদিও তাকে দেখা যায় না। প্রাগাধুনিক পর্বের অন্ধকার কারাগার বর্তমানের আধুনিক কারাগার দিয়ে প্রতিস্থাপিত কিন্তু ফুকো এই বলে সতর্ক করে দেন যে ‘দৃশ্যমানতা এক ধরনের ফাঁদ।’
এই দৃশ্যমানতার মাধ্যমেই, ফুকো বলেন, আধুনিক সমাজ তার ক্ষমতা এবং জ্ঞানের নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখে। ফুকো ইঙ্গিত করেন, আধুনিক সমাজের ভেতর দিয়ে একটি ‘কার্সেরাল কন্টিনিউয়াম’ প্রবাহিত। দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা কারাগার থেকে শুরু করে নিরাপদ বাসস্থান, প্রবেশন, সমাজকর্মী, পুলিশ ও শিক্ষকদের মাধ্যমে আমাদের প্রতিদিনকার কাজের জায়গা আর গার্হস্থ্য জীবনেও এই প্রবাহ বহমান। এ সব কিছুই কিছু মানুষ দিয়ে অন্য মানুষদের তদারক করার মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে আছে।
এই রকম অবস্থার ক্ষেত্রে বিচলিত হওয়াটা ছাত্রদের পক্ষে খুবই যুক্তিপূর্ণ — তাই তার বিরুদ্ধে এক্ষনি বিদ্রোহ করা দরকার এটা যে তারা বুঝেছে – এটা এক সঠিক দিশা । তাহলে তারা কী করবে। আন্দোলন করবে না, বিদ্রোহর মতন পরিবেশ গড়ে উঠবে না — কার্যগুণের বিচারে তারা যে এখনও সেই ছোটলোকেরই দলে – তাই তাদের বিদ্রোহ যে ভদ্রলোক রচিত ছকের বাইরে যাবে এটা তো স্বাভাবিক। কোনও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় থেকে তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তারা ফাঁদে যেন পা না দেয়। ঠিক কথা তবে ছাত্ররা এবার নিশ্চয়ই ভাববে ফাঁদটা কীসের, যে রাজনীতির আবহে তারা বেড়ে উঠেছে সেই চিরাচরিত ক্ষমতা লোভীর রাজনীতির নাকি রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের আভাস। তারা ভাবতে শিখেছে, এই ছোটো অভিজ্ঞতাতেও বুঝতে পারে, প্রথমটি –গ্রহণীয় নয়। আর দ্বিতিয়টা তো ইতিহাসপ্রসিদ্ধ – ওটা থাকবে, তাকে নিয়েই চলতে হবে।

নতুন ভাবনা তো ছাত্রদেরই আসবে – ওটা তো তাদেরই ধর্ম, কারণ তারা প্রশ্ন করতে চায়, করেও ফেলে, এটা যুবাবস্থা কালীন প্রবণতা। কিন্তু এই সমস্ত কর্মকান্ডের পরে যে প্রশ্নটা থেকে যায় সেটা হল ‘ফল’ , যেটা চটজলদি উত্তর দেওয়া সম্ভব নয় – তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে – গবেষণা করতে হবে – গবেষণা চালু হোক – তবে প্রখর বুদ্ধিমানদের এড়িয়ে যে চলতে হবে এই গবেষণা থেকে সেটা ছাত্ররা বুঝে গেছে – কারণ তারা এগোতে চায় সেজে গুজেই, ছুরির ফলাকে সামনে রেখেই, শুধু বাট নিয়ে নয়। তারা বুঝতে পেরেছে যে সহজ বুদ্ধিরই জয় হয় সর্বত্র।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.