অরিজিৎ চৌধুরি
গত কয়েকদিন সবথেকে বেশি কোন শব্দটা উচ্চারিত হয়েছে? একটা যদি করোনা হয়, অন্যটা নিশ্চয় লকডাউন। এই শব্দটার মানে কী, বাঙালি কয়েক মাস আগেও বোধ হয় ঠিকঠাক জানত না। ব্যবহারিক জীবনে শব্দটার তেমন প্রয়োগও ছিল না। কারখানা বন্ধ হলে লক আউট শব্দটা ব্যবহার হত। কেউ ফেরার হয়ে গেলে লুক আউট নোটিশের কথা শোনা যেত। মেল চেক করার পর বা ফেসবুক দেখার পর লগ আউট শব্দটাও শোনা যেত। কিন্তু লক ডাউন শব্দটা বাঙালির জীবনে সেভাবে আসেনি।
ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, অনেকেই গৃহবন্দি। কেউ চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। কেউ বই পড়ছেন। কেউ মোবাইলেই মগ্ন। হয় ফেসবুকে, নয় সিনেমায়। কেউ এই সুযোগে প্রিয়জনদের ফোন করছেন। কেউ আবার শখের রান্নায় হাত পাকাচ্ছেন। কিন্তু এই সুযোগে যদি কয়েকটা চিঠি লেখা যায়, তাহলে কেমন হয়! অনেক কিছু বন্ধ থাকলেও পোস্ট অফিস কিন্তু খোলা। টুকটাক সবজি, মাছ কেনার জন্য তো বাইরে যাচ্ছেন। আরেকটু হেঁটে আপনার পোস্ট অফিসেই না হয় পৌঁছে গেলেন। কতদিন পোস্ট অফিসে যাননি, তাই না! এই সুযোগে না হয় ডাকঘরে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল। ডাকবাক্সে ফেললে সেই চিঠি পৌঁছবে কিনা, গ্যারান্টি নেই। তবে, স্পিড পোস্টে পাঠালে নিশ্চিতভাবেই পৌঁছবে।
কত চিঠি লেখে লোকে, কত সুখে প্রেমে আবেগে স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে। সেই কতকাল আগে লেখা সুকান্তর কবিতা। কিন্তু এখন যেন চিঠি লেখার রেওয়াজটাই হারিয়ে যাচ্ছে। ডাকবাক্সগুলো প্রায় ফাঁকাই পড়ে থাকে। শেষ আপনার বাড়িতে কবে চিঠি এসেছে, মনে করে দেখুন। ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিল দিতে পিওন মাঝে মাঝে আসে ঠিকই। কিন্তু ব্যক্তিগত চিঠি শেষ কবে এসেছে?
আচ্ছা, আপনি নিজে শেষ চিঠি কবে লিখেছেন? দু লাইনের ইমেল বা হোয়াটস আপ, ফেসবুক চ্যাটের কথা বাদ দিন। কাগজে কলমে চিঠি। কবে সেই চিঠি খামে ভরে ডাকবাক্সে ফেলেছেন? ছোট ছোট অনুভূতিগুলো আমরা কেমন যেন হারিয়ে ফেলছি।
সত্যজিৎ রায় রোজ ভোরে উঠে কী করতেন? সবার আগে তিনি চিঠি লিখতে বসতেন। অনেক চিঠি জমে থাকত। শুটিং চলাকালীন লেখা হত না। তবে একটু ফুরসত পেলেই বসে যেতেন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সেইসব চিঠি নিয়ে। একের পর এক চিঠির উত্তর লিখতেন। কাউকে হয়ত নিজে থেকেই লিখলেন। রোজ তিনটে বা চারটে চিঠি লিখতেন। তখনও বাড়ির অন্য কেউ হয়ত ঘুমিয়েও ওঠেননি। তারপর কাজ শুরু করতেন।
সারা জীবন রবি ঠাকুর যে কত চিঠি লিখেছেন, তার হিসেব নেই। কিছু চিঠির হয়ত নমুনা পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক চিঠির কোনও কপি নেই। বুদ্ধদেব গুহর লেখার একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে এই চিঠি। চিঠি কেন্দ্রিক বেশ কিছু উপন্যাসও আছে। সেগুলি পড়তে পারেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন চিঠির রোমাঞ্চ কতটা।
অনেকে ভাবেন, লেখালেখির অভ্যেস তো নেই। তাই চিঠি লিখতে পারব না। একবার চেষ্টা করেই দেখুন না। আপনি তো আর দেশ পত্রিকায় লেখা পাঠাচ্ছেন না। নিকট কোনও বন্ধুকে চিঠি পাঠাচ্ছেন। তাহলে এত সংকোচ কীসের? প্রথম প্রথম হয়ত জড়তা থাকবে। দেখবেন, আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। তখন আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন।
যতই নেটের যুগ আসুক, যতই হোয়াটস আপ বা ফেসবুক আসুক, চিঠির কোনও বিকল্প হয় না। এখনও চিঠি লেখা ও চিঠি পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, তা অন্য কোনও মাধ্যমে নেই। যে এই রোমাঞ্চ পেয়েছে, একমাত্র সেই বোঝে এর মর্ম। তাহলে, আর দেরি কেন? আপনিও শুরু করে দিন। কাল থেকে নয়, সম্ভব হলে আজ থেকেই। লকডাউনকে এতসুন্দরভাবে সেলিব্রেট করার সুযোগ হাতছাড়া করবেন কেন? যাঁকে পাঠাচ্ছেন, তাঁরও অখণ্ড অবসর। সম্পর্কের মাঝে কত অভিমান, কত ধুলো জমে আছে। একটা আন্তরিক চিঠি পারে সেই ধুলো মুছে দিতে।