গুজবকে বিশ্বাসযোগ্য করার দায়িত্ব তিনিই নিয়ে ফেলেছেন

তিনি যেটা ঘোষণা করবেন, সেটাই তথ্য। সেটাই অমৃতসমান। ইচ্ছে হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমাবেন। যদি মনে হয়, খুব কম হয়ে যাচ্ছে, তখন দয়া করে একটু বাড়াবেন। সেটাই টিভিতে দেখাতে হবে। সেটাই কাগজে ছাপতে হবে। একটু বেগড়বাই করলেই বিপদ। চ্যানেল, কাগজ নতজানু হয়ে এই ফরমান মেনেও নিয়েছে। গুজব এবার আপন নিয়মেই ছড়াবে। কারণ, সরকারের তথ্যে যে বিশ্বাস করা যায় না, সরকার নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছে। যে গুজব ছড়াচ্ছে, সে বিশ্বাসযোগ্য হলেও হতে পারে। লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।

 

মহামারী মানে লাফিয়ে লাফিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু আমাদের রাজ্যে বোধ হয় নিয়মটা একটু অন্যরকম। এখানে মৃতের সংখ্যা কমতে থাকে। কী জানি, কমতে কমতে সংখ্যাটা শূন্যে নেমে এলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আমেরিকা, ইতালি, স্পেন নানা জায়গায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমাদের এই বিশাল দেশে অবশ্য সংখ্যার জাগলারি চলছে। বিশেষ করে, আমাদের রাজ্য সবাইকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। এখানে চিকিৎসকরা ঘোষণা করেন, মৃতের সংখ্যা সাত। একঘণ্টা পরেই পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলন করতে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। তিনি জানিয়ে দিলেন, মৃত্যুর সংখ্যা মোটেই সাত নয়। ওটা হবে তিন।

ব্যাস, তিনি সুর বেঁধে দিয়েছেন। আপনি চান বা না চান, সেই সুরেই আপনাকে কণ্ঠ মেলাতে হবে। বিভিন্ন জনসভায় কার জন্য কী করেছেন, এটা বলার পরই তিনি বলে বসেন, এটা মাথায় রাখবেন। অর্থাৎ, আমি তোমার জন্য এই এই করেছি। এটা মাথায় রাখবে। ইঙ্গিতটা পরিষ্কার, মাথায় না রাখলে যা দিচ্ছিলাম, আর দেব না।

carona1

মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে গিয়েও তেমন প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে রেখেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি যে তথ্য  ও পরিসংখ্যান দেবেন, চ্যানেলে চ্যানেলে সেই পরিসংখ্যানই তিনি দেখতে চান। কাগজেও এমন পরিসংখ্যানই চান। একটু বেচাল হলেই বিজ্ঞাপন বন্ধ।

এই বাজারেও বিভিন্ন চ্যানেলে নিয়ম করে তিনি বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছেন। একশো কোটির ওপর বোধ হয় ইতিমধ্যেই বিজ্ঞাপন খাতে খরচ হয়ে গেছে। অনেকে বলেন, তিনি নিজের মুখ দেখাতে চাইছেন। তার থেকেও বড় কারণ বোধ হয় অন্য। তোমাকে দিনে এত টাকার বিজ্ঞাপন পাইয়ে দিলাম, এটা মনে রেখো। যেদিন আমার কথা শুনবে না, সেদিন থেকে এই বিজ্ঞাপন বন্ধ, এটাও মনে রেখো।

এমনিতেই বিভিন্ন দোকান, ব্যবসা বন্ধ। ফলে, বেসরকারি বিজ্ঞাপন প্রায় নেই বললেই চলে। এরপর যদি সরকারি বিজ্ঞাপনও বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে চ্যানেল—কাগজ চালানোই মুশকিল। মিডিয়া জগতের এই সমস্যাটা খুব ভাল করেই বোঝেন মুখ্যমন্ত্রী। আর এই সমস্যাটাই তাঁর কাছে মস্ত এক সুযোগ। যা খুশি তথ্য গিলিয়ে দেওয়ার। নিজেকে দারুণ প্রশাসক হিসেবে তুলে ধরার। সেইসঙ্গে অন্যা্ন্য রাজ্য ব্যর্থ, তিনি একা দারুণ সফল, তিনি করোনা রুখে দিয়েছেন, এরকম একটা বার্তা দেওয়ার জন্য এই সময়টাকে সুন্দরভাবে বেছে নিয়েছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।

গত দু তিন বছর ধরে ডেঙ্গুর সময় এই তথ্য লুকোনোর খেলাটা দেখা গেছে। কোনও হাসপাতালেরই ক্ষমতা নেই ডেঙ্গু লেখার। মৃত্যুর কারণ অজানা জ্বর। এমনকী নার্সিংহোমের ক্ষেত্রেও একই ফতোয়া। ডেঙ্গু লেখা চলবে না। বড় বড় নার্সিংহোমগুলি যে নতজানু হয়ে সেই ফরমান মেনে চলেছে, এ তো নতুন কিছু নয়। মিডিয়াও সেই সুরেই বেজেছে। ডেঙ্গুকে যতটা সম্ভব, চেপে দেওয়া গেছে। কৃষক আত্মহত্যা করলে, সেটাকে পারিবারিক বিবাদ বলেই দেখাতে হবে। কারও ক্ষেত্রে প্রেমে ব্যর্থতা, কারও ক্ষেত্রে বউয়ের সঙ্গে কাল্পনিক ঝগড়া। প্রশাসন এভাবেই গল্প ফেঁদেছে। কিন্তু করোনা নিয়েও যে মিথ্যার এই নির্লজ্জ বেসাতি শুরু হয়ে যাবে, এতটা ভাবা যায়নি।

বিভিন্ন জেলায় করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হচ্ছে। এমনকী পরীক্ষাতেও পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলেও দেওয়া হচ্ছে না। লোকালয় থেকে অনেক দূরে প্রশাসনের উদ্যোগে দাহ করা হচ্ছে। অথচ, করোনা বলে স্বীকার করা হচ্ছে না। যদি করোনা না হয়, তা হলে পরিবারের হাতে দেহ তুলে দিতে বাধা কোথায়? সাধারণভাবে সৎকার হতেই বা বাধা কোথায়? জানি না, এভাবে কতদিন তথ্য লুকিয়ে রাখতে পারবেন। সত্যি সত্যি যদি মরামারীর চেহারা নেয়, তখন এই ফতোয়া কোনও কাজে আসবে না। সরকার নিজেই নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এর ফলে, গুজব আরও বেশি করে ডালপালা ছড়াবে। সংখ্যা বাড়ানো যেমন অপরাধ, তেমনি তথ্য চেপে যাওয়াও একই অপরাধ। জনতা যদি হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে গুজব ছড়ায়, তাহলে সরকারও আমলা ও ডাক্তারদের শিখণ্ডি করে গুজব ছড়াচ্ছে।

এই মিথ্যাচারের প্রবণতা যদি চলতে থাকে, তাহলে সরকারি তথ্যে আর কারও আস্থা থাকবে না। মোবাইলে ছড়িয়ে যাওয়া গুজব গুলোই বেশি করে বিশ্বাসযোগ্য হবে। আর সেই পরিস্থিতি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই ডেকে আনছেন।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.