‌রামায়ণের হাত ধরে ফিরে আসুক সেই হারানো কৈশোর

সজল মুখার্জি

লকডাউনের বাজারে এই গৃহবন্দিত্বের মাঝে একটু হলেও খুশির খবর। টিভির পর্দায় আবার ফিরে আসছে সেই রামায়ণ। প্রথম যখন লকডাউন ঘোষণা হয়, মনে হয়েছিল, এ আর কী এমন ব্যাপার। একুশ দিন তো দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই বোঝা যাচ্ছে, বন্দিদশা কতখানি ভয়ঙ্কর। কিশোর কুমারের একটা গানের লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে, দিন ভি ইঁয়া তো লাগে বরষ কে সমান। অর্থাৎ, একেকটা দিন যেন একেকটা বছরের মতো।

মনে হয়েছিল, ভালই হল। এই সুযোগে অনেক বই পড়ে ফেলব। অনেক বই কেনা হয়েছে। কিন্তু জমে আছে। নানা কারণে পড়া হয়নি। পুজো সংখ্যাও অনেক বাকি থেকে গেছে। বা যেগুলো পড়েছি, সেগুলোও ভুলে গেছি। আরও একবার পড়তে মন্দ লাগবে না। একসময় বই নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারতাম। মনে হত, বই পড়াটাই সেরা বিনোদন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বই পড়াটাও আর বোধ হয় খুব সহজ নয়। সেই আগের মতো ধৈর্য থাকছে না। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, মোবাইল নামক যন্ত্রটা অনেকটাই দায়ী।

ramayan1

এরই মাঝে হঠাৎ খবর পেলাম, দূরদর্শনে আবার সেই পুরনো রামায়ণ ফিরে আসছে। এই ঢালাও ইউটিউবের যুগে রামায়ণ দেখা হয়ত কোনও ব্যাপার নয়। যখন তখন দেখা যায়। কিন্তু গত কয়েক বছরে চেষ্টা করেছি বলে তো মনে পড়ছে না। অথচ, একসময় এই রামায়ণকে ঘিরে কী উন্মাদনাই না ছিল!‌ রবিবার সকাল হলেই বাজার ফাঁকা হয়ে যেত। সবাই রামায়ণ দেখেই বাড়ি থেকে বেরোতো। তারপর চলত রামায়ণ নিয়েই নানা আলোচনা। অমিতাভ না ‌মিঠুন, কে সেরা তাই নিয়ে তখন আমাদের জোরদার বিতর্ক। কিন্তু এই রামায়ণ যেন সেই বিতর্ককেও পেছনের সারিতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। অমিতাভ, মিঠুনদের মতো অরুণ গোভিলরাও আমাদের বড় কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন।

 

তখনও কেবল টিভি নামটার সঙ্গে বাঙালির পরিচয় হয়নি। টিভি বলতে সবেধন নীলমণি সেই দূরদর্শন। তাও সব ঘরে টিভিও ছিল না। মফস্বলে যার ঘরে টিভি থাকত, তার ঘরে রবিবার সকাল থেকে ভিড় লেগে যেত। বাড়ির বাইরে কত চটি যে জমা হত! সকাল আটটা থেকেই চলত জায়গা দখলের পর্ব।‌ কেউ কেউ চা খাওয়াত। কেউ মিষ্টি খাওয়াত। পাড়ার লোকে টিভি দেখার জন্য ভিড় করছে বলে খুব একটা বিরক্ত হতে দেখিনি। আসলে, সেই সময়টাই ছিল অন্যরকম। ছোট ছোট আনন্দগুলো সবাই মিলে ভাগ করে নিত। এখন কারও বাড়িতে এত লোক ভিড় করলে গৃহকর্তা হয়ত পুলিশে ফোন করবেন।

ramayan2

এবারের এপিসোডে কী দেখানো হবে, দু তিন দিন আগে থেকেই আলোচনা শুরু হয়ে যেত। কেউ কেউ বড়দের কাছে গল্প শুনে নিত। কেউ আবার সেই সুযোগে রামায়ণ পড়ে নিত। তারপর কী হবে, আগাম ভবিষ্যদ্বানী করত। যদি মিলে যেত, তাহলে বন্ধুমহলে কদর বেড়ে যেত। রামের কী করা উচিত, লক্ষ্মণের কী করা উচিত, তা নিয়ে কত লোক কতরকমের জ্ঞান দিত। অরুণ গোভিল বা দীপিকা চিকলিয়াকে সত্যি সত্যিই রাম আর সীতাই মনে হত। এখনও যখন তাঁদের দেখি, সেই পুরনো মুখটাই ভেসে ওঠে। রাম আর সীতা বলেই মনে হয়। কত টুকরো টুকরো স্মৃতি, কত নস্টালজিয়া জড়িয়ে আছে সেই ছেলেবেলার রামায়ণের সঙ্গে।

পরে বিভিন্ন চ্যানেলে রামায়ণ–‌মহাভারত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো মনকে স্পর্শ করতে পারেনি। রামায়ণ মানে এখনও সেই রামানন্দ সাগরের রামায়ণই মনে ভাসে। আবার সে ফিরে আসছে। এমনিতেই দূরদর্শন দেখার অভ্যেস চলে গেছে। চ্যানেলটা কোথায় আছে‌, অনেকে হয়ত খুঁজেও পাবেন না। এই রামায়ণের হাত ধরে আবার সেই দূরদর্শনে ফিরে যেতে মন্দ লাগবে না। আর রবিবারের জন্য অপেক্ষা নয়, রোজই সকাল নটায়। সকালে মিস করলে রাত নটায় ফের দেখার সুযোগ। তবু সেই আগের জনপ্রিয়তা কি পাবে? রামায়ণকে ঘিরে আগের সেই উন্মাদনা কি তৈরি হবে?‌ ‌ সম্ভাবনা কম। কারণ, সময়টাই বদলে গেছে। তবু এই লকডাউনের বাজারে আবার যদি সেই হারানো কৈশোরকে ফিরে পাই, মন্দ কী!‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.