স্বরূপ গোস্বামী
বয়স হয়েছিল ৮৩। তার ওপর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন প্রায় দেড়মাস। যে কোনওদিন মৃত্যু সংবাদ আসতে পারে, এমন মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। এমনিতেই কিংবদন্তিদের ৮০ পেরোলেই অবিচুয়ারি তৈরি থাকার কথা। তার ওপর দেড় মাস ধরে ভর্তি। মুখে অনেকে বলছিলেন, আরোগ্য কামনা করি, দ্রুত সেরে উঠুন। কিন্তু সেটা যে হওয়ার নয়, তাঁরাও জানতেন। বিশেষ করে, খবরের কাগজকে অনেক বেশি বাস্তববাদী হতেই হয়। আগে থেকে তৈরি থাকতে হয়।
তারপরেও পিকে ব্যানার্জির মৃত্যু পর বাংলা কাগজের কভারেজ বেশ ম্যাড়মেড়ে। এই করোনার আবহেও মৃত্যু সংবাদ চাপা পড়ে যায়নি। প্রথম সারির সব কাগজই দু পাতা, তিন পাতা করে বরাদ্দ করেছে কিংবদন্তি ফুটবলারের জন্য। অর্থাৎ, জায়গার ক্ষেত্রে তেমন কার্পণ্য ছিল না। কিছু লেখা আগাম তৈরিও ছিল (থাকাই উচিত)। কিন্তু, গলদটা ছিল ভাবনায় ও উপস্থাপনায়। মেধা, প্রস্তুতি পরিশ্রম, আন্তরিকতা সব বিভাগেই বড় ঘাটতি। পিকে এমন একটা চরিত্র, যাঁকে নিয়ে তিন পাতায় কিছুই হওয়ার নয়। তিরিশ পাতাও বোধ হয় কম পড়ে যায়। কিন্তু তিন পাতার ঠিকঠাক সদ্ব্যবহার হল কী? বুদ্ধি আর আবেগের ঠিকঠাক প্রয়োগ হল কী? অনেক ফাঁক থেকে গেল।
পিকে নিছক একজন বড় ফুটবলার ছিলেন না। নিছক একজন বড় কোচ ছিলেন না। নিছক ভোকাল টনিকের কারিগর ছিলেন না। নিছক টেকনিকের কচকচানি করা লোক ছিলেন না। পিকে নামটার ব্যপ্তি তার থেকে অনেক বেশি। কিন্তু কাগজ পড়লে মনে হবে, সুব্রত ভট্টাচার্য, গৌতম সরকার, সমরেশ চৌধুরি, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, শ্যাম থাপা, বিকাশ পাঁজি — এরকম কয়েকজন ফুটবলার তাঁর কোচিংয়ে খেলেছেন। তাঁদের কিছু ম্যাড়মেড়ে স্মৃতিচারণ। কেউ মারা গেলে যেমন টুইটে কেউ কেউ শোক জানান, তেমনই যেন কেউ কেউ নিছক নিয়মরক্ষার টুইট করেছেন। কয়েকটা ফাইল ছবি। আর কিছু পরিসংখ্যান। এভাবে পিকে–কে মাপা যায়!
তিনটে লেখা মোটামুটি মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। আনন্দবাজারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর সংবাদ প্রতিদিনে সুভাষ ভৌমিক। মৃত্যুর আগের দিনে এই সময়ে তুলসীদাস বলরাম। বাকি সব কাগজের প্রত্যেকটি লেখা, প্রত্যেকটি লাইন, প্রত্যেকটি শব্দ পড়ার পরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আর কোনও লেখাই মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো হয়নি। নিছক কিছু প্রাণহীন আইটেম। সিনেমায় ওই নাচগানের অর্থহীন আইটেম সঙের মতোই।
আর দশজন দিকপাল ফুটবলারের সঙ্গে পিকের তফাত কোথায়, এই স্পিরিটটাই অনেকে ধরতে পারেননি। অন্য কেউ বাঙালির জীবনে এভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন! ফুটবল জগতের কথা ছেড়েই দিলাম। নেহরু থেকে বিধান রায়, রবিশঙ্কর থেকে সত্যজিৎ রায়, উত্তম থেকে সৌমিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেইজ থেকে যোগেন চৌধুরি, সুনীল গাঙ্গুলি থেকে সৌরভ গাঙ্গুলি, জয় গোস্বামী থেকে শ্রীজাত, অমিতাভ বচ্চন থেকে দিলীপ কুমার, প্রসেনজিৎ থেকে পরমব্রত, সুপ্রিয়া থেকে পাওলি, ববি মুর থেকে লেভ ইয়াসিন, গ্যারি সোবার্স থেকে গাভাসকার, ধ্যানচাঁদ থেকে মিলখা সিং, জ্যোতির্ময়ী শিকদার থেকে পিঙ্কি প্রামাণিক, রমাপ্রসাদ গোয়েঙ্কা থেকে সুব্রত রায়, রতন টাটা থেকে হর্ষ নেওটিয়া, মতি নন্দী থেকে অশোক দাশগুপ্ত। তালিকা কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, বলা মুশকিল। এত এত মানুষের সঙ্গে তাঁর জীবন জড়িয়ে ছিল। নিছক চেনাজানা বা অনুষ্ঠানের আলাপ নয়। তার থেকে অনেক বেশি কিছু। যে কোনও কারও সঙ্গে তাঁর কথোপকথন নিয়ে একেকটা আস্ত বই হয়ে যায়। সেইসব বইয়ের সম্মিলিত কলেবর অনায়াসে রবীন্দ্র রচনাবলীকে ছাপিয়ে যেতে পারে। নিজের জগতের বাইরে আর কোন বাঙালির এই ব্যপ্তি ছিল? নিছক কয়েকজন প্রাক্তন ফুটবলারের স্মৃতিচারণে সেই ব্যপ্তিকে ধরা যায়! ছোঁয়াও যায় না।
পিকে এমন একজন মানুষ, যাঁকে নিয়ে আগামী একমাস ধরে ফলো–আপ হতে পারে। রোজ তিনটে করে পাতা বরাদ্দ করা যেতে পারে। কিন্তু মৃত্যুর পরেরদিনটাই যদি এমন বিবর্ণ প্রতিবেদনে ঠাসা থাকে, তাহলে পরের দিনগুলো না জানি আরও কতটা বিবর্ণ হতে পারে। যে ফিচারগুলো অনিবার্য ছিল, সেই বিষয়গুলো উঠেই এল না।
সমস্যাটা আসলে কোথায়? দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতা। শুধুই ফুটবলের পরিসরে তাঁকে বেঁধে রাখা। পিকে নামের ক্যানভাসটা যে অনেক বেশি প্রসারিত, সেটা দেখার মতো চোখ এই প্রজন্মের স্পোর্টস এডিটরদের নেই। তাই ব্যপ্তিটাকে ধরা তো দূরের কথা, স্পর্শ করাও যায়নি। তাই লে আউট আর ছবির চাকচিক্য দিয়ে পাতা ভরানোর চেষ্টা। পাঠকের কাছে যার তেমন গুরুত্বই নেই।
আরও একটা বিষয়। অনুলিখন। সেলিব্রিটিদের নামটা ব্যবহার হয় ঠিকই, কিন্তু আড়াল থেকে সাংবাদিকদেরই আসল কাজটা করতে হয়। নিজেকে নিংড়ে দিয়ে অনুলিখন করতে হয়। নিজের বাইলাইনের লেখাটা লিখতে সাংবাদিকরা যতটা যত্নশীল, অনুলিখনের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই যেন দায়সারা। তাই লেখাগুলো সেভাবে প্রাণ পায়নি।
সৌমিত্রর লেখা নিশ্চয় যত্ন নিয়ে অনুলিখন হয়েছে। সুভাষ ভৌমিকের ক্ষেত্রে অনুলেখকের বিশেষ কিছু করার থাকে না। প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন। তাই তাঁর লেখাটাও প্রাণ পেয়েছে। বাঁকে বাঁকে সংবেদনশীল হৃদয়ে মোচড় দিয়েছে। আগেরদিন তুলসীদাস বলরামের অনুলিখনেও সেই আবেগ, সেই যত্নের ছাপ ছিল। বাকিগুলো সেভাবে প্রাণ পেল না কেন, এই আত্মসমীক্ষা খুবই জরুরি।
বাংলা ক্রীড়া সাংবাদিকতায় এখনও অনেক দিকপাল সাংবাদিক আছেন। কেউ কেউ হয়ত অবসর নিয়েছেন, কিন্তু এই বিশেষ দিনে তাঁদের ব্যবহার করাই হল না। এমন দিনে অশোক দাশগুপ্ত, শ্যামসুন্দর ঘোষ, রূপক সাহা, জয়ন্ত চক্রবর্তী, মানস চক্রবর্তী, দেবাশিস দত্ত, ধীমান দত্ত, অরুণ সেনগুপ্তদের স্মৃতিচারণধর্মী লেখা খুবই দরকার ছিল। তাঁদের কি কেউ লেখানোর চেষ্টা করেছিলেন? হয়ত লেখায় কিছুটা ‘আমিত্ব’ আসত। আসুক না, ক্ষতি কী? তিরিশ–চল্লিশ বছর পিকে–র সান্নিধ্যে থেকে যদি অল্পবিস্তর ‘আমিত্ব’ এসেও পড়ে, সেটা উপভোগ্যই হত। অনেক অজানা দিক উঠে আসত। এমন বিশেষ দিনগুলোয় যদি এই দিকপালদের না লেখানো হয়, তবে আর কবে লেখানো হবে!
টুইটার, ফেসবুক সর্বস্ব সাংবাদিকতা বোধ হয় হৃদয়টা হারিয়ে ফেলেছে। দেখার চোখটাও হারিয়ে ফেলেছে। তাই পাঠকের ভাবনার জগৎ থেকে সে অনেকটাই দূরে, একেবারে আইসোলেশন ওয়ার্ডে। মিডিয়া ফ্রেন্ডলি পিকে পর্যাপ্ত সুযোগ দিয়েছিলেন মিডিয়াকে তৈরি থাকার, মেলে ধরার। কিন্তু বাংলা মিডিয়া পাসমার্কটুকুও বোধ হয় তুলতে পারল না।