স্বরূপ গোস্বামী
আরও একটা সুযোগ পাওয়া গেল, ক্ষিতি গোস্বামীকে গালমন্দ করার। যথারীতি সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন ফেসবুকের বীরপুরুষরা। দিন কয়েক আগে, ক্ষিতি গোস্বামীর কন্যা যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। ব্যাস, আবার বিপ্লব শুরু হয়ে গেল। যে ফিসফিসানি প্রায় দুই দশক ধরে চলে আসছে, আবার একবার বিপ্লবিয়ানা জাহিরের সুযোগ এসে গেল। দাঁত, নখ সব বেরিয়ে পড়ল।
প্রায় দুই দশক ধরেই শুনে আসছি, ক্ষিতি গোস্বামী তো তৃণমূলের দালাল। যে কোনওদিন তৃণমূলে চলে যাবেন। কেউ কেউ নাম দিয়েছিলেন ‘ক্ষতি গোস্বামী’। সিপিএমের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এমনটা বলেননি ঠিকই, তবে নিচুতলায় এই জাতীয় প্রচার অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। উঁচু তলার নেতারা অংশ নেননি, তবে সেই প্রচার থামানোর খুব আন্তরিক চেষ্টা করেছেন বলেও মনে হয় না। তাই তখন চর্চা ছিল চায়ের দোকানে, এখন তা এসে দাঁড়িয়েছে ফেসবুকে।
সিঙ্গুর–নন্দীগ্রাম পর্বের পর এই প্রচার আরও বেড়েছে। যেন মমতা ব্যানার্জি নন, ক্ষিতি গোস্বামীরাই বামফ্রন্টের সবথেকে বড় শত্রু। জোর প্রচার ছিল, শরিকরা নাকি বামফ্রন্ট ছেড়ে তৃণমূল শিবিরে চলে যাবে। বাজারি কাগজ হাওয়া তুলত। কী আশ্চর্য, তাতে দিব্যি সুর মেলাত সিপিএমের স্বঘোষিত ‘ডেডিকেটেড’ কর্মীরাও। শরিকদের যে কোনও বিকল্প বক্তব্য থাকতে পারে, তাঁদের যে মৃদু প্রতিবাদ থাকতে পারে, এসব ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়নি। সবসময়ই দেখা হয়েছে বাঁকা চোখে। সবচেয়ে বেশি কটাক্ষ হজম করতে হয়েছে ক্ষিতি গোস্বামীকেই। এমনকী ফরওয়ার্ড ব্লকের বর্ষীয়াণ রাজনৈতিক সন্ন্যাসী অশোক ঘোষও নিস্তার পাননি এই সন্দেহ আর আক্রমণ থেকে।
সরকার বদলের পরেও এই অপপ্রচার থামেনি। যেন যে কোনওদিনই তৃণমূলে চলে যেতে পারেন। এমন সময় ক্ষিতি গোস্বামীর স্ত্রী মহিলা কমিশনের চেয়ার পার্সন হলেন। ব্যাস, আবার শুরু হয়ে গেল। কী বলেছিলাম ! বউকে পাঠিয়ে দিল, এবার নিজে চলে যাবে। এই প্রচারটা আট বছর ধরে চলেছে। এই আট বছরে ক্ষিতি গোস্বামী কিন্তু তৃণমূলে যাননি। একবুক অভিমান নিয়ে পৃথিবী থেকেই বিদায় নিলেন।
মৃত্যুর পরেও বিরাম নেই। প্রোফাইলে লাল পতাকা সাঁটানো, নেতাদের পাশে ছবি তোলা অনেকেই যেসব মন্তব্য লিখলেন, তাঁদের অন্তত বাম মনষ্ক বলা যায় না। যেন একজন বিশ্বাসঘাতক চলে গেলেন। যেন বাম আন্দোলনে বিরাট ক্ষতি করে দেওয়া একজন চলে গেলেন। যেন বাম সরকার পড়ে যাওয়ার জন্য আর কারও কোনও দায় নেই, একা সব দায় ক্ষিতি গোস্বামীর। একজন বা দুজন এই জাতীয় মন্তব্য করলে না হয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায়। তাকে না হয় উপেক্ষা করা যায়। মুশকিলটা হল, অনেকেই এই প্রচারে শামিল হয়েছেন। অনেকে বিকৃত আনন্দ পেয়েছেন। অনেকে এই জাতীয় মন্তব্যে লাইক মেরেছেন। অনেকে নীরব সমর্থন করেছেন। সেই ওয়ালে পাল্টা প্রতিবাদ সেভাবে উঠে আসেনি। একজন মানুষের মৃত্যুর পরেও এভাবে নিম্নরুচির প্রচার বাম আন্দোলনকে কতখানি এগিয়ে দেবে, কে জানে!
ফেসবুক করতেন না। চ্যানেলের স্টুডিওতে আসতেন না। তাই, নিজের কথা বলার সুযোগ ছিল না। হয়ত তেমন ইচ্ছেও ছিল না। তবু, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে একটি ব্যতিক্রমী সাক্ষাৎকারের ভিডিও পাওয়া গিয়েছিল। এই লেখার শেষে তার দুটি লিঙ্ক দেওয়া থাকবে। চাইলে, দেখে নিতেই পারেন। কোথাও কোথাও অভিমান বা যন্ত্রণার কথা উঠে এসেছে। সেই সময়ের অনেক অজানা কথাও উঠে এসেছে। কিন্তু জীবনের পশ্চিম সীমান্তে দাঁড়িয়েও নিজের মতাদর্শে অবিচল। তাই নিশ্চিত করেই বলা যায়, মেয়ের তৃণমূলে যোগদান কখনই তাঁর সমর্থন পেত না। বরং, ভেতরে ভেতরে আরও কষ্টই পেতেন।
কিন্তু ফেসবুকের সবজান্তাদের এসব জানার কোনও দায় নেই। এবার তাঁর মেয়ে তৃণমূলে। আর যায় কোথায়! আবার শুরু হয়ে গেল। ‘বউ তৃণমূলে গেছে, মেয়েও গেল। নিজেও চলে যেত। নেহাত তার আগেই ফুটে গেল।’ এই জাতীয় ভাষা একজন বাম কর্মী ব্যবহার করতে পারেন! এটাও একজন বা দুজন নয়, গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন ‘প্রগতিশীল’ এর মুখে শোনা গেল। যেন সিপিএম থেকে কেউ কখনও বিজেপি বা তৃণমূলে যায়নি! রাধিকারঞ্জন প্রামাণিক, লক্ষ্মণ শেঠ, জ্যোতির্ময়ী শিকদার, মইনুল হাসান, ঋতব্রত ব্যানার্জি, ব্রতীন সেনগুপ্ত, রেজ্জাক মোল্লা, আবু আয়েশ মণ্ডল, তাপস চ্যাটার্জি, আইনুল হক–এঁরা যেন কাল্পনিক চরিত্র। তালিকাটা চাইলে আরও বাড়ানো যায়। এঁদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন লোকসভার সদস্য, তিনজন রাজ্যসভা সদস্য। দুজন ছিলেন এসএফআই–এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, একজন ডিওয়াইএফআই–এর সর্বভারতীয় নেতা। অর্থাৎ, শুধু শরিক থেকে তৃণমূল বা বিজেপিতে গেছে, এমনটা নয়। কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত দল না ছেড়েও দোষটা হয় শুধু ক্ষিতি গোস্বামীর। অদ্ভুত বিচার!
নীরবে এইসব কুৎসা হজম করে গেছেন প্রবীণ মানুষটি। আঘাত পেয়েছেন, ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তবু শিবির বদলের কথা ভাবেননি। তিনি যদি দলবদল করতে চাইতেন, রেজ্জার মোল্লার মতো উদ্যান পালন দপ্তর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হত না। হয়ত পূর্ত বা আরও কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বই পেতেন। এমনকী একসময় মমতা প্রকাশ্যে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করার কথাও বলেছিলেন। একসময় ক্ষিতিবাবু বামেদের যে ভুলের কথা বলতেন, পরবর্তীকালে সেই ভুলের কথাই তো জ্যোতিবাবু থেকে বুদ্ধবাবুরাও বললেন। তিনি বিচক্ষণ, তাই দেওয়াল লিখনটা আগে পড়তে পেরেছিলেন, তফাত এটাই। মিডিয়ায় হাওয়া গরম করেননি। তার আগে বামফ্রন্টের মিটিংয়ে বলেছেন, ক্যাবিনেটে বলেছেন। গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং তাচ্ছিল্য করা হয়েছে, শত্রু ভাবা হয়েছে।
তাঁর স্ত্রী মহিলা কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার পরেও কম আক্রমণ ধেয়ে আসেনি। শুনতে হয়েছে, বউকে তৃণমূলে পাঠিয়ে দিলেন, এবার নিজে যাবেন। এই আক্রমণটাও নীরবে হজম করেছেন। কজন জানেন, তার পর থেকে গত আট বছর তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন না! প্রবীণ বয়সে স্বামী–স্ত্রীর বন্ধন আরও দৃঢ় হওয়ার কথা। পারস্পরিক নির্ভরতা আরও বাড়ার কথা। সত্তর বছর বয়সে কজনের ছাড়াছাড়ি হয়! ক্ষিতি গোস্বামীর হয়েছিল। দৃঢ়ভাবেই নিজের স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, তুমি তোমার মতো সিদ্ধান্ত নিতেই পারো। কিন্তু এতবড় মতপার্থক্য নিয়ে একছাদের তলায় থাকা সম্ভব নয়। তুমি থাকতে পারো, আমিই বরং বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তাঁকে যেতে হয়নি, তাঁর স্ত্রীই অন্য ঠিকানা খুঁজে নিয়েছেন। শেষ আট বছর এভাবেই কেটেছে। একদিনের জন্যও তাঁরা আর কখনও কাছাকাছি আসেননি। কজন এই দৃঢ়তা দেখাতে পারবেন? অথচ, কখনও এটা গলা ফাটিয়ে বলতে যাননি। রাজনৈতিক আদর্শের কারণে দাম্পত্যের বিচ্ছেদকেও নীরবে মেনে নিয়েছেন। যাঁরা অহরহ ক্ষিতি গোস্বামীকে গালাগাল দেন, তাঁদের কজন জানেন এই রক্তক্ষরণের কথা? কজন জানেন এই দৃঢ়তার কথা!
সবজান্তা বিপ্লবীদের এসব জানার কোনও দায় নেই। আসুন, এই সুযোগে আরও একবার ক্ষিতি গোস্বামীর মুণ্ডপাত করা যাক। মৃত মানুষটার গায়ে আরও কিছু তকমা সাঁটিয়ে দেওয়া যাক। ফেসবুকের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
*****
পুনশ্চ: মৃত্যুর আগে শেষ সাক্ষাৎকার। দুটি লিঙ্ক। চাইলে শুনে নিতে পারেন।
1 comment
Very good article.