সরল বিশ্বাস
রাজ্য সরকারের লিখে দেওয়া ভাষণ রাজ্যপাল পড়েন। ঠিক যেমন কেন্দ্রের লিখে দেওয়া ভাষণ পড়তে হয় রাষ্ট্রপতিকে। তাই আলাদা করে এটাকে রাজ্যপালের ভাষণ হিসেবে না দেখাই ভাল। এটা আসলে, রাজ্যের ভাষণ।
কিন্তু এবারের ভাষণের মধ্যে একটা আলাদা তাৎপর্য আছে। রাজ্যের ইতিহাসে এই প্রথম রাজ্যপালের ভাষণকে ঘিরে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। রাজ্যপাল আদৌ রাজ্য সরকারের লেখা ভাষণ পড়বেন কিনা, তা নিয়েই সংশয় ছিল। এর আগে কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। যদি তিনি সরকারের তৈরি করা ভাষণ না পড়েন, যদি তিনি অন্য কোনও লাইন ঢুকিয়ে দেন, তাহলে কী করা হবে, সেইসব নিয়ে গত কয়েকদিনে অনেক চর্চা হয়েছিল। রাজ্যপালের ভাষণে বিরোধীরা বাধা দেয়, চিৎকার করে, এমনটা আগেও দেখা গেছে। কিন্তু সরকারপক্ষ বিক্ষোভ দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমনটা আগে দেখা যায়নি। মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। স্পিকার আগাম জানিয়ে দিচ্ছেন, রাজ্যপাল অন্যকিছু বললে তা রেকর্ডে থাকবে না। এমন পরিস্থিতি এর আগে কখনও হয়নি।
এর আগে রাজ্যপাল একবার বিধোনসভায় এসেছিলেন। সেবার তাঁকে খুবই অপমানিত হতে হয়েছিল। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রায় কেউই ছিলেন না। কোনও এক রহস্যজনক কারণে সবাই ভ্যানিস হয়ে গিয়েছিলেন। এর আগে কোনও রাজ্যপাল এভাবে বিধানসভায় এসে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে জানা নেই। এমনকী, এর জন্য সরকারি তরফে কোনও অনুশোচনাও ছিল না। বরং, রাজ্যপালকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল। বিধানসভা রাজ্যপালকে তাঁর ভাষণের জন্য ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি সেদিনের লাঞ্চনার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনাও করুক।
শেষমেষ কী সূত্রে রফা হল, জানি না। কেন রাজ্যপাল এত বিদ্রোহ দেখানোর পর এমন সুবোধ বালক হয়ে গেলেন, তাও জানি না। শোনা যায়, দিল্লি থেকে নাকি বিশেষ নির্দেশ ছিল, তিনি যেন সরকারকে বিড়ম্বনায় না ফেলেন। রাজ্যপাল দিল্লির কথা রেখেছেন। ঠিক যেমন ওপর থেকে নির্দেশ এলেই সিবিআই মাঝে মাঝে তদন্ত গুটিয়ে নেয়।
এবারের ভাষণে দেখা গেল, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তেমন জোরালো কোনও লাইন নেই। সিএএ, এনআরসি নিয়ে রাজ্যজুড়ে এত প্রতিবাদ, তার তেমন প্রতিফলন এই ভাষণে নেই। দেশজুড়ে যে হিংসার আবহ, যেভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ চলছে, তা যে বাংলাকেও দূষিত করছে, সে ব্যাপারে তেমন উদ্বেগ নেই।
এই রাজ্যের বর্তমান অবস্থা কেমন, সেটা আর বিরোধীদের বলতে হবে না। রাজ্যের রাজ্যপাল নিজেই খুব ভাল করে জানেন। তিনি মাঝে মাঝেই বলেন, রাজ্যে আইনের শাসন নেই। রাজ্যে অরাজকতা চলছে। প্রায় রোজ নিয়ম করে তিনি তাঁর ক্ষোভ জানান। তাঁর সেই কথাগুলোকে সত্যি ধরব নাকি এই লিখে দেওয়া ভাষণকে সত্যি ধরব?
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে অনেক ঢাক পেটানো হয়েছে। অথচ, আইন শৃঙ্খলার এমন অবস্থা, খোদ রাজ্যপালকেই কেউ পাত্তা দিচ্ছেন না। জেলার ডিএম, এসপি রা রাজ্যপালকে দিনের পর দিন এভাবে অসম্মান করার স্পর্ধা পাচ্ছেন কোথা থেকে? আর কেউ না জানুক, রাজ্যপাল বেশ ভালবাবেই জানেন। তাঁর প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানানোটা উচিত কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু তাঁর ক্ষোভ যে সঙ্গত, এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আমরাও রাজ্যপালের এই উদ্বেগের শরিক।
শিক্ষার ব্যাপারেও রাজ্যপালের ভাষণে অনেক বড় বড় দাবি রয়েছে। আসল ছবিটা কেমন, রাজ্যপাল নিজেই বারবার চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রকাশ্যেই বারবার বলেছেন, এই রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। আচার্যর ক্ষমতা খর্ব করার জন্য বিশেষ বিল পাস করানো হয়েছে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল যেতে পারছেন না। স্বয়ং শাসক দল বাধা দিচ্ছে। উপাচার্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন, রাজ্যপাল এখানে অবাঞ্ছিত। এমন অরাজক পরিস্থিতি এই রাজ্যে কখনও তৈরি হয়েছে? চাকরি বাঁচাতে উপাচার্যদের ছুটতে হচ্ছে রাজনৈতিক দলের ধর্নায়। শিক্ষামন্ত্রীর চারপাশে পেটোয়া দলীয় কর্মীর মতো তাঁদের বসতে হয়েছে রাজনৈতিক সমাবেশে। এমন ছবি এই রাজ্যে আগে কখনও দেখা গেছে! এসএসসি, প্রাইমারি রাজ্য থেকে প্রায় উঠেই গেছে। কবে শেষ পরীক্ষা হয়েছে, স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীও অফিসারদের না জিজ্ঞেস করে বলতে পারবেন না। আর নিয়োগ নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভাল। যে পারছেন, টাকা তুলে যাচ্ছেন। গ্রামগঞ্জে গেলেই ছবিটা আরও স্পষ্ট বোঝা যায়।
শিল্প আর কর্মসংস্থানের ব্যাপারে গত ৯ বছর ধরেই অদ্ভুত একটা লুকোচুরি। রাজ্যপালের ভাষণে যা বলা হয়, বাজেটে যা বলা হয়, তার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্কই থাকে না। কাল্পনিক, মন গড়া কিছু তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। শিল্পে নাকি ঢালাও বিনিয়োগ আসছে। সেই ৯ বছর ধরে আসছে, আসছে শুনে আসছি। এল, এমনটা আর শোনা যায় না। ঘটা করে শিল্প সম্মেলন হয়। ভেজাল শিল্পপতি এনে জড়ো করা হয়। তাঁরা শেখানো বুলি বলে যান। কিন্তু বিনিয়োগের সময় তাঁদের আর দেখা যায় না। মুখ্যমন্ত্রী হাজার হাজার দুর্গাপুজো উদ্বোধন করেছেন, কালীপুজো উদ্বোধন করেছেন, সরস্বতী পুজো উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু নতুন কোনও কারখানা উদ্বোধন করেছেন, এমন ছবি কাগজে দেখা যায় না। এক হাজার কোটির বিনিয়োগ হয়েছে, এমন একটা কারখানার নাম বলুন। দেখতে দেখতে সরকারের ৯ বছর হয়ে গেল। এখন আর আশ্বাস নয়, কী হয়েছে, সেই খতিয়ান শুনতে চাই। যদি সৎসাহস থাকে, পরিষ্কার করে বলুন, কোথায় কী বিনিয়োগ হয়েছে। কোন কোন কারখানা তৈরি হয়েছে। কোথায় কতজনের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর আগেও এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রতিবারই সরকার পাশ কাটিয়ে গেছে। জানি, এবারও পাস কাটিয়ে যাবেন। কারণ, সত্যি কথা বলার মতো সৎসাহস অন্তত এই সরকারের নেই।