যাঁরা সংবিধান ভাঙছেন, তাঁদের কান মুলে সংবিধান বোঝানো হোক

আলি ইমরান (‌ভিক্টর)‌

victor10

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিষ্কার কবিতার কথা কে না জানেন!‌ সারা পৃথিবীতে এত ধুলো কেন, তা নিয়ে হবু রাজা আর গবু গবু মন্ত্রীর চিন্তার শেষ নেই। কীভাবে এই ধুলো থেকে পৃথিবীর মুক্তি দেওয়া যায়, তা নিয়ে নানা গবেষক নানা উপায় বাতলে দিলেন। কেউ বললেন, সারা পৃথিবীতে জল ছড়িয়ে দিতে। কেউ বললেন, চামড়া দিয়ে গোটা পৃথিবীটাকে যদি ঢেকে দেওয়া যায়, তাহলে কেমন হয়!‌ শেষমেশ এক মুচির বুদ্ধিতে সমাধান হল। মুচির পরামর্শ, সারা পৃথিবীটাকে চামড়া দিয়ে না ঢেকে নিজের পা দুটোকে ঢাকলেই তো পারেন। সেই থেকে জুতা আবিষ্কার হল।

ঘটা করে সংবিধান দিবস পালন দেখে সেই জুতা আবিষ্কারের গল্পটাই বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকায় শিবির করে বোঝানো হচ্ছে, কীভাবে সংবিধান রক্ষা করতে হবে। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই মুচির কথা। যে বলেছিল, নিজের পা দুটো চামড়া দিয়ে ঢাকুন। কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারকেই বলতে ইচ্ছে করছে, দেশসুদ্ধু মানষকে সংবিধান বোঝাতে হবে না। নিজেরা বুঝুন, নিজেরা মেনে চলুন, তাহলেই চলবে। যাঁরা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের হাতেই সংবিধানটা বারবার ধর্ষিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এখানে নিতান্তই অসহায়।

কেন্দ্রের কথাই ধরা যাক। মাঝরাতে রাষ্ট্রপতি শাসন উঠে গেল। ভারতের ইতিহাসে কোনওদিন শুনেছেন?‌ অনেকে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালকে দুষছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত্যাহারের নির্দেশিকা তো রাজ্যপাল জারি করেননি। মাঝরাতে এই অপকর্মটি হয়েছে খোদ রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে। ক্যাবিনেটের প্রস্তাব ছাড়াই, আইনজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াই দুম করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়!‌ মাঝরাতে রোগী ভর্তি করতে হয়, এমনটা শুনেছেন। কিন্তু অনেকদিন ভর্তি থাকার পর মাঝরাতে সেই রোগীর ছুটি হচ্ছে, এমনটা শুনেছেন?‌ রোগীর ছুটি হয় সকাল দিকে বা বিকেল দিকে, মোদ্দা কথা ভদ্রস্থ সময়ে।
ঠিক তেমনি, কোনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন উঠছে, তার মানে তো সেই রাজ্যে স্থিতাবস্থা ফিরে এসেছে। সেই ঘোষণা মাঝরাতে কেন করতে হবে?‌ সকাল ছটায় রাজ্যপাল সরকার গঠন করতে ডেকে বসলেন। আটটার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রীর শপথ হয়ে গেল। ভারতের ইতিহাসে কোনওদিন এমনটা হয়েছে?‌ এমন উদাহরণ একের পর এক তুলে ধরা যায়। অর্থাৎ, সংবিধান ভাঙা হচ্ছে একেবারে সর্বোচ্চ জায়গায় বসে।

bidhan sabha
আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। সংবিধানকে মানার কোনও দায়ই যেন সরকারের নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনে কী হয়েছে, আমরা সবাই দেখেছি। রাজ্যে এমন একটি ব্লকও ছিল না যেখানে লাঠিসোঁটা হাতে ব্লক ঘেরাও হয়নি। আগে যেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল, এখন সেটাই সার্বিক চিত্র। খোদ মহকুমাশাসকের দপ্তরেও বিরোধীদের ওপর হামলা হয়েছে। জেলাশাসক, পুলিশ সুপারদের কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকতে দেখা গেছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ‘‌অনুপ্রেরণা’‌ ছাড়া এমন সার্বিক সন্ত্রাস হওয়া সম্ভব ছিল না। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রতিটি প্রশাসনিক মিটিং ও সভা হচ্ছে সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। কোথাও কোনও নিয়ম মানা হচ্ছে না। একেবারে নির্লজ্জ স্তরের দলীয় অনু্ষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিধানসভার ক্ষেত্রেও তাই। অধিকাংশ দপ্তরের বাজেট এখানে আলোচনা হয় না। সব গিলোটিনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রশ্নোত্তর থেকে মুলতুবি প্রস্তাব, সব জায়গাতেই পক্ষপাতিত্বের ছাপটা স্পষ্ট। এখানেও ছত্রে ছত্রে সংবিধান ভাঙার প্রবণতা। অন্য দল থেকে সদস্যদের ভাঙিয়ে আনার প্রথা এখানেও চলছে। স্পিকার মশাই কোনও ব্যবস্থাই নিতে পারেননি।
আবার সেই জুতা আবিষ্কারের কথাতেই আসি। ঘটা করে সংবিধান দিবস পালন করাটা নিতান্তই প্রহসন মনে হচ্ছে। যাঁরা সংবিধান রক্ষার নামে রোজ সংবিধান ভেঙে চলেছেন, তাঁদের বরং বোঝানো হোক, সংবিধানে কী করা যায় আর কী করা যায় না। তাঁরা বুঝলেই যথেষ্ট। সারা দেশকে বোঝানোর কোনও দরকার নেই।
(‌লেখক পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার একজন বিধায়ক)
(‌বিধানসভায় দেওয়া বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন)‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.