তোকে আমরা কী দিইনি, শক্তি?

আজ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। তাঁর লেখা অনেক কবিতা ঘোরাঘুরি করবে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু এখানে তাঁকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা। কবির প্রয়াণের পর এই কবিতা লিখেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। বাংলায় লেখা অন্যতম সেরা এপিটাফ। বেঙ্গল টাইমসের পাঠকরা পড়ে ফেলুন। কবিতার শেষে ভিডিও লিঙ্কও দেওয়া আছে। সেই আবৃত্তি শুনে ফেলতে পারেন।

 

shakti chattopadhyay

ঝমাঝম মাদল হয়ে বাজবি বলে তোকে দিয়েছি
চাইবাসার প্রত্যেকটা ফ্লুরোসেন্ট রাত।
যথেচ্ছারের সুখে মাতাল হাতির মতো ঘুরবি বলে
তুলে দিয়েছি জলদাপাড়ার জঙ্গল।
দেদার ঘুমের জন্যে গোটা জলপাইগুড়ি জেলাটাকেই
বানিয়ে দিয়েছি তোর মাথার বালিশ।
মুখে যাতে মাছি না-বসে,
ভুবনেশ্বরের দুপুরগুলো চামর দুলিয়ে গেছে সারাক্ষণ।
শুধু তোর জন্যই হাওড়া স্টেশনে
জিরোতে দিইনি দূরপাল্লার কোনও ট্রেনকে।
স্টিমারে স্টিমারে ভোঁ বাজিয়ে জাহাজ, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিনদের বলেছি,
সরে যাও, শক্তি এখন সাঁতার কাটবে সমুদ্রে।
ভূমিকম্পের আগে সতর্কতা জানাতে
কলকাতার সমস্ত সাইরেন উপুড় করে দিয়েছি তোর মুঠোয়।
ভারতবর্ষের যে-কোনও ডাকবাংলোর
কনকনে কালো রাতগুলোকে বলা ছিল,
ও কখন আসবে ঠিক নেই, কিন্তু আসবেই,
কেয়ারটেকার যেন লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে রাখে।
তোকে আমরা কী দিইনি, শক্তি?

****
মঞ্চে সবার আগে চেয়ার পেতে দিয়েছি তোকে।
মাইকে সবার আগে তোর নাম।
লিটল ম্যাগাজিনে সবার আগে তোর পদ্য।
আড্ডায় সবার আগে তোর গান।
যখন পা টলমল, জড়িয়েছি বুকে।
যখন চোখ হারিয়েছে ঘরে ফেরার ঠিকানা,
পৌঁছে দিয়ে এসেছি সদরঘরের দরজায়।
যখন উদ্ধত, বলেছি — শান্ত হ।
যখন শান্ত, বলেছি — শোনা তোর শঙ্খস্বর।
যখন স্বেচ্ছাচারী, বলেছি — তুই কিন্তু গৃহী।
যখন গৃহস্থ, এগিয়ে দিয়েছি ট্যুরিজমের ম্যাপ।
তোকে আমরা কী দিইনি, শক্তি?
****

তুই নিখোঁজ। আমরা পাহাড়ে-মেঘে-জলস্তম্ভে
বাজিয়ে দিয়েছি কাড়া-নাকাড়া।
তুই বিপন্ন। আমরা প্রতিপক্ষের দিকে
ঘুরিয়ে দিয়েছি কামান-বন্দুকের মুখ।
তুই পুরস্কৃত, আমরা ঝনঝনিয়ে উঠেছি
ভীষ্মদেবের গলায়, জয়জয়ন্তী রাগে।
আমরা স্মৃতির অ্যালবামে সাজিয়ে রেখেছি তোর একশো রকমের ছবি।
আমাদের দৈনন্দিন হাসি-ঠাট্টা ভরাট হয়ে থাকত
তোর দুশো রকমের দস্যিপনার গপ্পে।
তুই কবিতা পড়বি, আকাশ ঝেঁটিয়ে জড়ো করেছি সমস্ত রঙের মেঘ।
তুই নাচবি। সমস্ত আসবাব সরিয়ে বিছিয়ে দিয়েছি মোলায়েম মখমল।
তোকে আমরা কী দিইনি, শক্তি?

***
বাংলা আকাদেমির প্রাঙ্গণে সেদিন তোর কী বরবেশ!
কপালে চন্দনের রাজটীকা। মনে হচ্ছিল,
চশমা খুলে উঠে বসার আগে একটু গা-এলানো বিশ্রাম বুঝি।
খানিক পরেই পড়বি শান্তিনিকেতনে লেখা নতুন কবিতা।
তখনও ভাবছি চুল্লি ভয় পাবে আগুনকে।
আগুন পড়ে নেবে শোকযাত্রীদের মুখরেখা।
শেষ বিউগল কিছুতেই বাজাতে পারবে না কলকাতার কান্না।
তখনও ভাবছি, দৈববাণীর মতো বলে উঠবি — যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?

বন্ধুরা, অনুরাগীরা, আত্মীয়েরা, যমজ ভায়েরা–‌বোনেরা
চিতার গন্ধ গায়ে মেখে, ঘরে ফিরে
শুকনো পাতার মতো পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরবে
কতদিনের আপন একটা জ্যান্ত গাছের খোঁজে।
এসব জেনেও চলে যেতে পারলি, তুই!‌
***
কবিতাটির ইউটিউব লিঙ্ক। এখানে ক্লিক করে অনায়াসে শুনে নিতে পারেন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.