কুন্তল আচার্য
গোলাপি বলের দিন–রাতের টেস্টকে ঘিরে কয়েকদিন ধরেই তুমুল আলোচনা। শুধু বলের রং গোলাপি নয়। চারপাশটাই যেন মুড়ে ফেলা হচ্ছে গোলাপি আবহে। ইডেন সেজে উঠছে গোলাপি রঙে। রাস্তার দুধারের অনেক বাড়িতেও নাকি গোলাপি আলোর রোশনাই।
ঠিক এই আবহে মনে পড়ে যাচ্ছে না এক আধা–গোলাপি শহরের কথা। আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগের কথা। বাংলার একটি ছোট্ট শহর সেজে উঠছিল গোলাপি রঙে। কিন্তু পিঙ্ক সিটি খেতাবটা অধরাই থেকে গিয়েছিল। সেই শহরটি অনেকেরই চেনা। বরাকর। আসানসোল ছাড়িয়ে। বাংলা–ঝাড়খণ্ড সীমান্তে। খনি অঞ্চলের মোটামুটি পরিচিত শহর।
এখানেই থানার ওসি হিসেবে এসেছিলেন মাধব মণ্ডল। তেমন রাফ অ্যান্ড টাফ নন। কড়া ধাঁচের মানুষও নন। বরং, অনেকটাই সংস্কৃতিপ্রেমী। কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন (হয়ত এখনও লেখেন)। সাংস্কৃতিক মহলে মেলামেশা ছিল। এই মাধববাবু একবার বেড়াতে গিয়েছিলেন রাজস্থানের জয়পুরে। সেখানে চারদিকে গোলাপি বাড়ি দেখে ঠিক করে ফেললেন, ফিরে গিয়ে বরাকরকেও পিঙ্ক সিটি বানাবেন।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। ফিরে এসেই লেগে পড়লেন পিঙ্ক সিটি করার কাজে। ডাকলেন বিভিন্ন ক্লাকর্তাদের। বললেন, জয়পুরে গিয়ে দেখে এলাম, সবকিছুই গোলাপি। এতবড় শহরটা যদি গোলাপি শহর হতে পারে, আমাদের এই ছোট্ট শহরকে কেন গোলাপি শহর বানানো যাবে না?
ভাবনাটা অনেকেরই মনে ধরল। অনেকেই বলল, এমন উদ্যোগ হলে তাঁরাও পাশে থাকবেন। শুরু হল গোলাপি অভিযান। ডাকলেন কিক্সাওয়ালাদের। ফরমান জারি করলেন, সবার রিক্সায় যেন গোলাপি রং করা হয়। রাস্তার ধারে যে সমস্ত ছোটখাটো দোকান ছিল, সব দোকানদারদের বললেন গোলাপি রং করতে। এমনকি, দোকানের সামনে পাতা চেয়ার, বেঞ্চ, সিমেন্টের চাথাল— সব জায়গাতেই দ্রুত ছড়িয়ে গেল গোলাপি রং। যদি কেউ রং কিনতে না পারেন, তাঁকে বলা হল, থানায় গিয়ে রং নিয়ে আসবেন। শোনা যায়, ব্যবসায়ীদের নাকি বলেছিলেন রঙের সাপ্লাই দিতে। বরাকরজুড়ে গোলাপি–শহরকে ঘিরে নানা মজার কাহিনী ছড়িয়ে আছে। কেউ কেউ বলেন, রাতে দেখা গেল দোকানের রং নীল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সকালে নাকি দেখা গেল রং বদলে গেছে। নীল বা সবুজ বা হলুদ রং রাতারাতি গোলাপি হয়ে গেছে। কেউ বলতেন রং ছিনতাই। কেউ বলতেন গোলাপি–সন্ত্রাস।
মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে শহরের চেহারাই যেন পাল্টে গেল। অনেককিছুই গোলাপি হয়ে গেল। কোনওটা আবেদন–নিবেদনে। কোনওটা আবার হুমকিতে। কেউ কেউ বলেন, গোলাপি রং না করলে নানা সমস্যা হতে পারে, এই মর্মে হুমকিও নাকি আসত। ব্যবসায়ীদের নাকি বাধ্য করা হত থানায় গোলাপি রং দিয়ে যেতে। দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। মহালয়ার দিনেই পিঙ্ক সিটির উদ্বোধন হবে। এদিকে, শোনা যায় ব্যবাসীয়া নাকি ওসির ‘অত্যাচার’এ অতিষ্ঠ হয়ে ওপর মহলে নালিশ জানিয়েছিলেন। পিঙ্ক সিটি উদ্বোধনের আগেই সেই ওসির বদলি হয়ে গেল। পিঙ্ক সিটির স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল বরাকরের।
পুরানো লোকদের মুখে এখনও সেই পিঙ্ক সিটির গল্প শুনতে পাবেন। কোথাও কোথাও এখনও হয়ত ফিকে হয়ে যাওয়া গোলাপি রঙের চিহ্ন খুঁজে পাবেন। ইডেনের গোলাপি টেস্ট যেন সেই গোলাপি শহরের স্মৃতিকে আবার ফিরিয়ে দিল।