সেই গড্ডালিকা প্রবাহেই ভেসে গেলেন

নন্দ ঘোষের কড়চা

 

nanda ghosh logo

নন্দ ঘোষ। সবকিছুকেই তিনি দেখেন বাঁকা চোখে। বেঙ্গল টাইমসের পাঠকেরা নন্দ ঘোষের কড়চার সঙ্গে বেশ পরিচিত। এবার তাঁর ইচ্ছে হয়েছে ফিল্ম নিয়ে কিছু লিখবেন। পুজো পেরোতেই তিনি গুমনামি দেখে ফেললেন। রিভিউ লিখলেন বেঙ্গল টাইমসে।

 

পুজো এলেই এদের যেন হিড়িক পড়ে যায়। নতুন জামাকাপড়ের মতো নতুন এক বাতিক হয়েছে, ছবি বানাতে হবে। সবাই এক পিস করে নামিয়ে দিচ্ছে। আরে বাপু, লোকে পুজো দেখবে না তোদের ছবি দেখবে!‌ একসঙ্গে হাফডজন ছবি বেরোলে যা হয়!‌ কোনওটাই ঠিকঠাক দেখা হয় না। এই সবজান্তারা বুঝলে তো!‌

এই বাংলায় এক অতি পুচ্ছপাকা পরিচালক আছেন। তাঁর নাম সৃজিত মুখুজ্জে। প্রতিবার তিনি একটি করে অশ্বডিম্ব প্রসব করেন। এবার তাঁর নতুন অশ্বডিম্ব হল গুমনামি। ছবিটা নিয়ে ইতিমধ্যেই সাড়ে চুয়াত্তরখানা ইন্টারভিউ দিয়ে ফেলেছেন। অনেকদিন ধরেই হইচই চলছে। চলারই কথা। বাঙালি কী খায়, কোনটা নিয়ে হইচই করে, এই লোকটি বিলক্ষণ জানেন। কখনও অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিকে প্ল্যানচেট করে নামিয়ে আনেন। কখনও ভাওয়াল সন্ন্যাসীকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করেন। এবার পেয়েছেন মোক্ষম একটি বিষয় গুমনামি, থুড়ি নেতাজি। মাঝে মাঝেই পরিচালকের মুখে ‘‌লার্জার দ্যান লাইফ’ কথাটা শোনা যায়। আর এই ছুতোয় প্রসেনজিৎকে নিয়ে ফেলেন। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি মানে প্রসেনজিৎ, কাকাবাবু মানে প্রসেনজিৎ, নেতাজি মানেও প্রসেনজিৎ। কোনদিন মাদার টেরিসাকে নিয়ে ছবি বানাবেন। সেখানেও হয়ত বিচিত্র মেক আপ করিয়ে প্রসেনজিৎকে নিয়ে ফেলবেন। বলবেন, বুম্বাদার একটা লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ আছে। তাই এই চরিত্রে বুম্বাদা ছাড়া ভাবাই যায় না। ‌এই বিশ্ব আঁতেল পরিচালক প্রসেনজিৎকে যাত্রাপালার সেই ‘‌শান্তি গোপাল’‌ বানিয়ে ছাড়লেন।

gumnami1

গুলতানি মারা স্বপ্নবিলাসি বাঙালি এখনও বিশ্বাস করে, নেতাজি একদিন ঘোড়ায় চড়ে আসবে। দেশের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। খুব ছোট থেকেই বাঙালি জেনে এসেছে, নেতাজি ভাল, গান্ধী–‌নেহরু খুব খারাপ। এখন তো স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকদের ঠেলায় রোজ মেসেজ ঢুকেই চলেছে। কেউ বিশ্বাস করে, নেতাজিকে খুন করা হয়েছে। কেউ মনে করে তিনি সাধু হয়ে গিয়েছিলেন। এইসব গাঁজাখুরি বিষয়ের ওপর নানা রকম বই আছে। রিসার্চের নামে ইতিহাসের পিন্ডি চটকানো আছে। সেই চিরাচরিত রাস্তাতেই হেঁটেছেন পুচ্ছপাকা পরিচালক।

একটা কথা আছে, অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর। এই ছবিটা তার একটা সার্থক নমুনা হতে পারে। শুরুতে বলছিলেন, নেতাজিকে নিয়ে তিনটে থিওরির কথা বলা হয়েছে। নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন, নেতাজির রাশিয়ায় মৃত্যু হয়েছে, নেতাজি গুমনামি বাবা হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, দর্শক নেবেন। দর্শককে আর সিদ্ধান্ত নিতে দিলেন কোথায়!‌ নেতাজি যে গুমনামি বাবা হয়ে ফিরে এসেছেন, এটা তো প্রায় গিলিয়ে ছেড়েছেন। যেটার পক্ষে সবথেকে জোরালো যুক্তি, সেটাকে বুড়ি ছোঁয়া ছুঁয়ে গেছেন। আর পুরোটা জুড়েই গেলানো হয়েছে গুমনামি তত্ত্ব। ইতিহাস না পড়া বাঙালি যেটা শুনতে চায়, চায়ের দোকানে যে গুলতানিটা করতে চায়, সেই দিকেই তাকে আরও খানিকটা এগিয়ে দিলেন।

gumnami2

ছবি বেরোনোর আগে পরিচালকের যুক্তি ছিল, নেতাজির অন্তর্ধান নিয়ে নাকি এতদিন সেভাবে আলোচনা হয়নি। আমি চাই, এই ছবি সেই আলোচনাটাকে ফিরিয়ে আনুক। ও হে মহাপণ্ডিত, বাঙালি নেতাজির জীবন নিয়ে কবে আর আলোচনা করল! তাঁর কাজকর্ম কবে আর জানার চেষ্টা করল!‌‌ সে তো নেতাজির মৃত্যু নিয়ে মেতে থাকতেই ভালবাসে। তার কাছে নেতাজি মানেই মৃত্যু। তার কাছে নেতাজি মানেই গান্ধী–‌নেহরু ভিলেন। আজাদ হিন্দের চারটে ব্রিগেড ছিল। তার মধ্যে একটি ব্রিগেডের নাম গান্ধী ব্রিগেড, একটি ব্রিগেডের নামে নেহরু ব্রিগেড। গান্ধীজিকে ‘‌জাতির জনক’ উপাধিটা নেতাজিরই দেওয়া। কিন্তু সেইসব ইতিহাসকে ফের গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে যুদ্ধ, কাশ্মীর, পাকিস্তান নিয়ে হাজার হাজার মেসেজের পাশাপাশি নেতাজি নিয়ে দু চারটে গপ্পও খাইয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্যটা সেই এক। তাদের হাতেই তামাক খেলেন এই ‘‌বুদ্ধিজীবী’‌ পরিচালক!‌ অরবিন্দ সাধু হয়েছিলেন, নেতাজি কেন হবেন না?‌ কীসব যুক্তি!‌ কোনদিন শোনা যাবে, রত্নাকর যদি বাল্মীকি হতে পারেন, তাহলে দাউদ ইব্রাহিম কেন হতে পারেন না!‌

বলা হয়েছে, মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে নাকি ছবিটা বানানো। মুখার্জি কমিশন যে গুমনামী তত্ত্বটাকেই খারিজ করে দিল, সেটাকেই গেলাতে এত ব্যাকূল কেন?‌ বলা হল, মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট নাকি সরকার খারিজ করেছে। এটাও ডাঁহা ভুল তথ্য। নেতাজির ফাইল ওপেন করাটাও বিরাট সাফল্য বলে দাবি করা হয়েছে। সেখান থেকেই বা কি অশ্বডিম্ব বেরিয়ে এল!‌

যাঁর জীবন এত বর্ণময়, তাঁর মৃত্যু নিয়ে এত আলোচনা হয় কেন?‌ নেতাজি মানেই কি শুধু মৃত্যু!‌ তাঁর জীবনের এত ত্যাগ, লড়াই, সাহস, দৃঢ়তা, পড়াশোনা— এগুলোর কোনও মূল্য নেই?‌ কিন্তু গড়পড়তা বাঙালি মৃত্যু ছাড়া কিছুই বোঝে না। নেতাজিকে মহান করতে গেলে গান্ধীজি–‌নেহরুকে ছোট করতেই হবে, এই ইতিহাস চর্চাই বাঙালি করে গেছে। বিস্তর গবেষণা করিয়া গবেষকরা আবিষ্কার করিলেন, গরু ঘাস খায়। বিস্তর গবেষণা করিয়া বিশ্ব আঁতেল সৃজিত মুখুজেও সেই গড্ডালিকা প্রবাহেই গা ভাসালেন।

 

বেঙ্গল টাইমসের নতুন ই ম্যাগাজিন। এই ছবিতে ক্লিক করলেই পড়তে পারবেন। ক্লিক করুন। পড়ে ফেলুন।
বেঙ্গল টাইমসের নতুন ই ম্যাগাজিন। এই ছবিতে ক্লিক করলেই পড়তে পারবেন। ক্লিক করুন। পড়ে ফেলুন।

https://www.bengaltimes.in/BengalTimes-OctoberIssue.pdfhttps://www.bengaltimes.in/BengalTimes-OctoberIssue.pdf

 

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.