খোলা মনে ‘‌চীন’‌ দেখালেন বুদ্ধদেব

চীনের ভাল, চীনের মন্দ। কোনওটাই তাঁর নজর এড়ায়নি। তথ্য, যুক্তি হেঁটেছে হাত ধরাধরি করে। একপেশে মনোভাব নিয়ে নয়, বিশ্লেষণ করেছেন খোলা মনে। অসুস্থ শরীর নিয়েও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বুঝিয়ে দিলেন, কেন তিনি অন্যদের থেকে আলাদা। অন্ধকার বইবাজারেও দেখালেন আলোর দিশা। লিখেছেন কুণাল দাশগুপ্ত।

 

buddha babu16

মার্ক্সবাদকে ঘিরে এযাবৎকাল পর্যন্ত যত প্রচার কিম্বা অপপ্রচার সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে একটি হল তার রিজিডিটি। কখনওবা মৌলবাদের সঙ্গে একই আসনে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও চলেছে। অথচ, মার্কসবাদই জীর্ণ, পুরাতন ধ্যানধারণা ভেঙে ফেলে আগামীর পথ প্রশস্ত করেছে। পদে পদে মুক্ত মন গড়ার শিক্ষা দিয়েছে। মুক্তমনা না হলে বস্তাপচা অশিক্ষার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা যায় না। মার্কসবাদী হওয়া তো দূর অস্ত।
রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেটাই আবার প্রমাণ করলেন তাঁর লেখনি দিয়ে। প্রগতির পরিপন্থী সংস্কৃতির পথে হাঁটা এই রাজ্যের জন্য উপহার দিলেন ‘‌স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা।’‌ বুদ্ধবাবু যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটি যেমন কোনওদিনই মস্কোর আজ্ঞাবাহী ছিল না। তেমনই ‘‌চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’‌ ধারণাটিও কোনওকালে সমর্থন করেনি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই গ্রন্থের বিষয় চীন। আধুনিক চীনকে ঘিরে কৌতুহল বিশ্বজুড়ে। একদিকে যেমন মার্কিন মুলুকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজের ভূখণ্ডের আর্থিক বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে, অন্যদিকে উদারবাদের ফাঁক ফোকর গলে পুঁজিবাদি জীবাণুও ঢুকে পড়ছে ‘‌লাল’‌ চীনে। গ্রন্থের শুরুতে লেখক প্রাচীন চীনের সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তুলে ধরেছেন। এসেছে সামন্তপ্রভু, জমিদারদের কার্যকলাপ। আরও এসেছে চীনের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অপরিসীম আগ্রহ এবং আফিম যুদ্ধ। এখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিও দিয়েছেন —
‘‌চীন কাঁদিয়া কহিল, আমি অহিফেম খাইব না। ইংরেজ বণিক কহিল, সে কি হয়?‌ চীনের হাত দুটি বাঁধিয়া তার মুখের মধ্যে কামান দিয়া অহিফেম ঠাসিয়া দেওয়া হইল। দিয়ে কহিল, যে অহিফেম খাইলে, তাহার দাম দাও।’‌
কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি চীনের সামন্ততন্ত্রের গর্ভে ধীরে ধীরে পুঁজিবাদের জন্ম দিল, অসুস্থ শরীর নিয়েও অসাধারণ দক্ষতায় বুদ্ধবাবু সেটা তুলে ধরেছেন। এই পুঁজিবাদই যে চীনে শ্রমিক শ্রেণিক উদ্ভব ও বিকাশের পটভূমি তৈরি করেছে, সেটিও সুন্দরভাবে তুলে ধরলেন তাঁর লেখায়।

চীনে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম অবশ্যম্ভাবী ছিল। ১৯২১ সালে ৫০ জন পার্টি সদস্যের ১২ জন প্রতিনিধির সম্মেলন হয় সাংহাইতে। আফিমের ঘোরে থাকা চীনের সমাজতন্ত্রে উন্নীত হতে বিস্তর ঝড়ঝাপটার সম্মুখীন হতে হয়। এই সংগ্রামে মাও জে দঙের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি বলেছিলেন, চীনা বিপ্লবে চীনা শ্রমিক শিল্পের সর্বহারাই বিপ্লবের অগ্রণী শক্তি। শ্রমিক সমাজ হল তাদের মৈত্রীমেলা। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের থিওরি ঠিক যেমনটা বলে। বুদ্ধবাবু সুনিপুণভাবে চীনের গেরিলা যুদ্ধ ও লং মার্চের ছবিটি এঁকেছেন। তার ফলশ্রুতি হিসেবেই কুও মিন তাংয়ের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের জয় এবং জাপানিদের চীন থেকে পলায়ণ। ১৯৪৯ সালে চীন গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসেবে ঘোষিত হল।
নতুন চীন গঠনের পর থেকেই একদিকে যেমন ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতার মানের উন্নতি হয়, অন্যদিকে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত বিপদও ডেকে আনে। ইস্পাত শিল্প গড়ে তুলতে গিয়ে ঘরে ঘরে ইস্পাত উৎপাদনের সিদ্ধান্ত ব্যাপক ক্ষতি করে চীনা অর্থনীতির। এরই মধ্যে গোল বাঁধে প্রবাদপ্রতিম নেতা মাও জে দঙের ভাবনাকে ঘিরে। তিনি চাইলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লব। কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচজনকে নিয়ে গঠন করলেন একটি বিশেষ কমিটি। তার মধ্যে তাঁর স্ত্রী জিয়াং কিংও ছিলেন। বিশেষজ্ঞ, শিক্ষকদের বদলে দেশ গড়া ও সমাজতন্ত্রে পৌঁছনোর জন্য বেছে নিলেন ছাত্রদের। হাতে তাদের রেডবুক। আর তারা পরিচিত হল রেডগার্ড নামে।

mao se tung
দেশের অগ্রগতি হোঁচট খেতে লাগল। বন্ধ হল গবেষণাগার। এমনকী ‘‌সাচ্চা কমিউনিস্ট হবে কী করে’‌ গ্রন্থের রচয়িতা লিও সাউকিকেও উপেক্ষা করা হল। স্বর্গের নিচে বিশৃঙ্খলার আরেকটা কারণ হিসেবে বুদ্ধবাবু মস্কো বনাম বেজিং দ্বন্দ্বের কথাও উল্লেখ করেছেন। একপেশে ধারণা নিয়ে নয়, সবকিছুই খোলা মনে বিশ্লেষণ করেছেন। সেই কারণেই চীন সংক্রান্ত আর দশটা বইয়ের তুলনায় এই বইটা অনেকটাই স্বতন্ত্র।
অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয় বেনজিয়াও পিং নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর লেখক বলছেন, এরপরই দেশে ব্যক্তিপুঁজি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়। আইএমএফের সঙ্গেও যুক্ত হয় চীন। চীন সফরকালে লেখক যেমন হাসপাতালে চিকিৎসক আর ঝাড়ুদারের মধ্যে বেতনের ফারাক খুব কম দেখেছেন, দেখেছেন সাম্যের উদাহরণ, তেমনই আবার ‘‌লাল’‌ চীনে দেহব্যবসায় জড়িত রমনীও দেখেছেন।
তবুও ও দেশের রাস্তাঘাটে ভিখিরি, ভবঘুরে, সাধুসন্তদের আনাগোনা নেই। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল চীন আজ চোখ রাঙাচ্ছে পুঁজিবাদে সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছনো দেশগুলিকে। আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে থেকেও দেশপ্রেমিক হওয়া যায়, তারই উদাহরণ চীনের মানুষেরা। ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট করেননি বুদ্ধবাবু। তবে তিনি সমাজতন্ত্রের বিষয়ে পুরোদস্তুর ইতিবাচক।
তবে হ্যাঁ, শারদ সাহিত্যের যখন এক আধার দশা চলছে, বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের কপালের ভাঁজ স্পষ্ট হচ্ছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বই তাঁদের অক্সিজেন জুগিয়ে দিল। মতবাদ, মতাদর্শ এবং নিজের প্রতি সৎ থাকলে উৎকৃষ্ট লেখা আজও কদর করেন সাধারণ মানুষ। স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা তারই উদাহরণ। অন্ধকারাচ্ছন্ন বইবাজারে আলো জ্বাললেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

 

স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
ন্যাশনাল বুক এজেন্সি
৬০ টাকা

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.