স্বরূপ গোস্বামী
মাস তিনেক আগেও তাঁকে চিনতাম না। কারণ, তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় দীর্ঘদিন চাকরি করলেও সে অর্থে সাংবাদিক ছিলেন না। তাই বাইলাইন পড়ার সুযোগ হয়নি। টিভিতে কয়েকবার ডিবেট শুনেছিলাম। খুব একটা আহামরি কিছু মনে হয়নি। হয়ত সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে শোনাও হয়নি।
কিন্তু তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম ডিজিটাল মিডিয়ায়। মাত্র তিন–চার মাসেই তিনি দারুণভাবে ছাপ ফেলেছেন বাংলা সাবাদিকতায়। কখনও তাঁর লেখায়। কখনও ভিডিও বার্তায়। সবমিলিয়ে ডিজিটাল মিডিয়ায় তাঁর লেখা, ভিডিও বেশ জনপ্রিয়। আমার বন্ধুরা যেমন লিঙ্ক পাঠায়। তেমনি নিজেও খুঁজে খুঁজে পড়ে ফেলি। শুনে ফেলি। অপেক্ষা করি, আজ তিনি কী আপলোড করেছেন। পাঠক হিসেবে কখনও সমৃদ্ধ হই। কখনও আরও সাহস পাই। অনেকের না বলা কথাগুলোই তাঁর মুখে উঠে আসে। তাই অধিকাংশ ভিডিও ক্লিপিংসের ভিউয়ারশিপ লাখ ছাপিয়ে যায়। কোনও সংগঠিত উদ্যোগ ছাড়াই আপন নিয়মে ভাইরাল হয়ে যায়।
প্রিন্ট মিডিয়াই হোক বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া। মূলস্রোত মিডিয়া কেমন যেন থরহরি কম্পমান। আর জাতীয় স্তরের মিডিয়ার কথা যত কম বলা যায়, তত ভাল। সেখানে যেন সারাক্ষণ যুদ্ধ চলছে। আর রাজ্যে তো কে কত স্তাবকতা করতে পারে, তার এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলে। এই আবহে তাঁর কণ্ঠস্বর বেশ স্বতন্ত্র। শিক্ষার ছাপ আছে। যুক্তির ছাপ আছে। মার্জিত রুচির ছাপ আছে। আর বলিষ্ট প্রতিবাদ তো আছেই। যুক্তি ও শালীনতা মেনেও সমালোচনা কত প্রখর হতে পারে, প্রতিদিন তার ছাপ রেখে চলেছেন। গত তিনমাসে একের পর এক লেখায়, একের পর এক ভিডিও বার্তায় তিনি যে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, সত্যিই স্যালুট করার মতো। বেঙ্গল টাইমসও গত পাঁচ বছর ধরে লাগাতার এই প্রতিবাদের রাস্তায় হাঁটে বলেই প্রতিবাদের কদর করতে জানে।
আর ভনিতা না করে নামটা লিখে ফেলাই ভাল। সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। মূলস্রোত মিডিয়া যখন স্তাবকতার চিরাচরিত পথ বেছে নিয়েছে, সাধারণ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও তাঁদের যখন এত ভয়, তখন বুক চিতিয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন এই মানুষটি। যে মানুষটিকে কয়েক মাস আগেও বাংলার মানুষ সেভাবে চিনতেন না, মাত্র কয়েক মাসেই তাঁকে গ্রাম বাংলা থেকে সুদূর প্রবাসে থাকা সচেতন বাঙালি চিনে ফেলেছেন। তাঁর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করেন। কত অজানা কথ্য উঠে আসে তাঁর কথায়। অথচ, কখনই মনে হয় না, তিনি অতিরঞ্জন করছেন। প্রতিটি কথাই সত্যি বলে ভাবতে ইচ্ছে করে, ভরসা হয়।
সেই সন্ময়বাবুর বাড়িতে কিনা পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হল! কোন রাজত্বে বাস করছি আমরা! বিভিন্ন জেলায় তাঁর নামে এফ আই আর করানো হচ্ছে। পুলিশ এসে গভীর রাতে বাড়িতে শাসিয়ে যাচ্ছে। এ কেমন অসভ্যতা? যদি তিনি আপত্তিকর কিছু বলে থাকেন, পাল্টা লেখা যেতে পারে। এমনকী মানহানির মামলাও করা যেতে পারে। তাই বলে বাড়িতে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া! সেই পুলিশ কিনা গভীর রাতে এসে তাঁর স্ত্রীকে, তাঁর প্রবীণ দাদাকে শাসিয়ে যাচ্ছে! এতে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হল!
ধরেই নিলাম, এর পেছনে মুখ্যমন্ত্রীর হাত নেই। কেউ কেউ তাঁকে খুশি করার জন্য অতি সক্রিয়তা দেখাচ্ছে। কিন্তু এতে কার মুখ পুড়ছে? মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তিনিষ্ঠ সমালোচনা করলে এমন হেনস্থার শিকার হতে হবে? এ কোন গণতন্ত্র? আসলে, বাংলার কাগজ বা চ্যানেলে মুখ্যমন্ত্রীকে সেভাবে বিরোধীতার মুখোমুখি হতে হয়নি। মূলস্রোত প্রায় সব কাগজকেই তিনি দাক্ষিণ্য দিয়ে, এটা–ওটা পাইয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন। সবাইকে তাঁর সুরেই গান গাইতে হয়। তাই সামান্যতম সমালোচনাও হজম করতে পারেন না।
পঞ্চায়েতে প্রতিটি জেলায় সীমাহীন সন্ত্রাসের ফল মানুষ ভোটবাক্সে বুঝিয়ে দিয়েছেন। পুলিশ নির্ভর দল চালানোর মাশুল হাড়েহাড়ে পেয়েছেন। পাহাড় থেকে জঙ্গল মহল নির্মমভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এর পরেও কোনও শিক্ষা হল না? এরপরেও কোনও আত্মসমীক্ষা হবে না?
অবাক লাগে প্রেস ক্লাবের ভূমিকা দেখে। এই সংস্থাটিও একটি নির্ভেজাল পেটোয়া সংস্থায় পরিণত হয়েছে। সন্ময়বাবুর পরিবারকে এমন হেনস্থা করার পরেও এক লাইনের বিবৃতি দেওয়া গেল না! এত এত সেলিব্রিটি সাংবাদিক আছেন। কারও মনে হল না এই ন্যক্কারজনক আচরণের নিন্দা করা উচিত! আজ যে আঘাত সন্ময়বাবুর ওপর নেমে এসেছে, কাল তা অন্যদের ওপরও নেমে আসতে পারে।
বলতে দ্বিধা নেই, এই মুহূর্তে সন্ময়বাবুই বাংলা সাংবাদিকতার রবিশ কুমার। তাঁর কণ্ঠস্বরকে, তাঁর প্রতিবাদকে বাঁচিয়ে রাখা সত্যিই খুব জরুরি। অনেকেই হয়ত তাঁর পাশে আছেন। কিন্তু আরও বেশি মানুষের পাশে থাকা দরকার। নৈতিক সমর্থন নয়, সোচ্চারভাবে পাশে থাকা। প্রেস ক্লাব বা দিকপাল সাংবাদিকরা কী ভূমিকা পালন করেন, দেখার ইচ্ছে রইল। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী কী ভূমিকা নেন, সেটাও দেখার ইচ্ছে রইল। যে পুলিশের দল তাঁর বাড়িতে গিয়ে হেনস্থা করে এসেছেন, তাঁদের কে নির্দেশ দিল, সেই নাম প্রকাশ্যে আনা হোক। নইলে বুঝতে হবে, এর পেছনেও ‘অনুপ্রেরণা’ আছে। তাঁর ‘অনুপ্রেরণা’ যে নেই, এটা প্রমাণের দায় মুখ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে।