সুমিত চক্রবর্তী
বাঙালির পুরী যাওয়া নিয়ে একটা কথা খুব চালু আছে। সে পাঁচ–ছদিন থাকে। উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, ধবলগিরি, কোনারক, চিল্কা, নন্দনকানন— যা যা আশেপাশে আছে, সব দেখে ফেলে। শুধু পুরীটা দেখাই বাকি থেকে যায়। সকালে বেরিয়ে পড়া। বিস্তর ঘুরে, ছবি–টবি তুলে সন্ধে নাগাদ ফিরে আসা। তারপর কেউ ডুবে যায় গ্লাসে। আবার কেউ বা টিভির পর্দায় মন সঁপে দেয় সিরিয়ালে। বড়জোর ক্লান্ত শরীর নিয়ে সন্ধেতে একটু বিচে গিয়ে বসা। এসব করতে গিয়ে পুরীটাই আর দেখা হয় না।
আমি একেবারেই উল্টো পাবলিক। আমি যতবার যাই, পুরীতেই থাকি। আশপাশের অনেককিছুই তাই না দেখাই থেকে গেছে। বেঙ্গল টাইমসে ভ্রমণের টুকরো টুকরো বিষয় উঠে আসছে। মনে হল, পুরীর ফরেনার ঘাট নিয়ে নিজের অনুভূতি তুলে ধরা যাক। প্রথমবার গিয়েছিলাম বছর দশেক আগে। তারপর গেছি আরও তিনবার।
প্রথম হদিশ দিয়েছিল এক অটোওয়ালা। জানতে চেয়েছিলাম, এখানে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। সে বেশ কয়েকটা জায়গার কথা বলেছিল। সেসব জায়গায় ঘোরানোর পর বলল, আরও একটা ভাল জায়গা আছে, যাবেন? তবে, সেখানে বেশ কিছুক্ষণ থাকতে হবে। আপনাদের নামিয়ে আমি চলে যাব। পরে ফোন করে দেবেন। আমি এসে নিয়ে যাব। নইলে সমুদ্রের পাড় ধরে হেঁটেও চলে যেতে পারেন।
সে আমাদের ফরেনার ঘাটে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল। মনে হচ্ছিল না, ওটা পুরী। মনে হচ্ছে, যেন গোয়ার সি বিচ বা বিদেশে কোথাও বসে আছি। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিদেশিরা। শীতের রোদ গায়ে মেখে ওরা সমুদ্রের পাড়ে। কে কোন দেশ থেকে এসেছে, বোঝা মুশকিল। কেউ আপন মনে বই পড়ছে। কেউ ল্যাপটপ নিয়ে লিখেই চলেছে। কেউ আবার গিটার হাতে গান গাইছে। কেউ একা একাই রোদে শুয়ে আছে (সান বাথ)। কোথাও কয়েকজনের জটলা চলছে। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে।
কয়েকজন আবার ইসকনের ভক্তও আছে। তারা তিলক কেটে, ধুতি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে অনেকের সঙ্গেই ইসকন বা ধর্মের তেমন সম্পর্ক নেই। তারা আপন মনেই বসে আছে। বেশ কয়েকজনকে ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলতে দেখেছি। কাউকে গিটার হাতে রবি ঠাকুরের গান গাইতেও শুনেছি। অনেকেই আসার পথে কলকাতা বা দার্জিলিং হয়ে এসেছে। সবমিলিয়ে দারুণ এক অনুভূতি।
সেই অনুভূতির টানেই আরও তিনবার গেছি। তার মধ্যে একবার গরমের দিকে। সেবার তেমন বিদেশির দেখা মেলেনি। আরও একবার গিয়েছিলাম বৃষ্টির মাঝে। সেবারও অনাবিল আনন্দে তাদের বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেছি। কেউ দৌড়ে গিয়ে জলে ঝাঁপ দিচ্ছে। কিছুক্ষণ ঢেউ নেওয়ার পর আবার ফিরে এসে রোদে গল্প জুড়ে দিচ্ছে। আবার কিছুক্ষণ পর হয়ত আরও একবার জলে ঝাঁপ। কখনও অমলেট, কখনও ডাবের জল চলছে। এমনকী মশলা মুড়িও দিব্যি উপভোগ করছে সেই বিদেশি পর্যটকরা।
আসার সময় হেঁটে হেঁটেই সমুদ্রের পাড় ধরে দিব্যি ফিরে আসা যায়। এমনকী, যাওয়ার সময়েও অটো না করে আপনি হেঁটেও চলে যেতে পারেন। বাঁ দিকে পাড় ধরে দু আড়াই কিমি হাঁটলেই পেয়ে যাবেন। যাঁকে জিজ্ঞেস করবেন, সেই দেখিয়ে দেবে। সবমিলিয়ে ফরেনার ঘাট সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা বেশ ভালই। কিন্তু যাঁরাই পুরী যান, তাঁদের অধিকাংশই ওদিকে পা মাড়ান না। হয় জানেন না। অথবা জানলেও তেমন আগ্রহ দেখান না। আশপাশের জায়গাগুলো তো রইলই। শীতের দুপুরে একবার ফরেনার ঘাট থেকে ঢুঁ মেরে আসতেই পারেন। পুরীর মধ্যে অন্য একটা পুরী আপনার মনে ছাপ ফেলতেই পারে।
(ভ্রমণের লেখা মানেই কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন মার্কা ছকে বাঁধা লেখা নয়। তার বাইরেও লেখার একটা বিরাট পরিসর থেকে যায়। বেড়ানোর টুকরো টুকরো কিছু ঘটনা বা চরিত্রও লেখার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। শুধু সেটুকুই উঠে আসতে পারে আপনার লেখায়। আপনার অনুভূতি ভাগ করে নিন অন্যদের সঙ্গে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: bengaltimes.in@gmail.com)