রবিবারের গল্প
শুভ্রা রায়
শ্যামলালকাকা তুমি এত লজ্জা পাচ্ছো কেন বলো তো? তুমিতো শার্ট প্যান্টই পরো, আলাদা কিছু পরো কি?
কাল এতো বড় ফাংশনে উপস্থিত থাকবে। তার জন্য একটা ভাল জামা প্যান্ট রেডি রাখতে হবে তো ?
—বেটি আমি তো ফি বছর ওই ফাংশনে থাকি। তখন তো আমি পিয়নের নীল পোশাকটাই পরি। আজ তুমি এত ঝামেলা করছ কেন ?
–প্রতিবছর তুমি ওই ফাংশনে পিয়ন শ্যামলাল সিং হিসাবে জল, ফাইল, খাবার সার্ভ করার জন্য থাকতে। কিন্তু কালকের ব্যপারটা অন্য। কাল তুমি সম্মানিত হবে। স্টেজে উঠে তুমি তোমার প্রাপ্য সম্মান হাতে পাবে। তাছাড়া কাকা, আমাকে তুমি এইটুকু করতে দাও। তোমার সাপোর্ট না পেলে আমি আমার ও বাকি ফিমেল কলিগদের হয়ে লড়াইটা কি লড়তে পারতাম বলো?
ঠিক আছে বেটি, তোমার যা ইচ্ছে হয় খরিদ করো। আসলে আমার লজ্জা পাচ্ছে। শ্যামলাল একটু লজ্জিত হয়ে স্মিত হেসে মাথা নিচু করলেন ।
ইমন সেলসম্যানকে ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে বলে দেয় — আপনি কাকার জন্য হোয়াইট ব্লু স্ট্রাইপ শার্ট আর ব্ল্যাক বা ব্লু ট্রাউজার দিন যেটা ভাল ফিট হয়।
কেনাকাটা সেরে ইমন তাড়াতাড়ি ক্যাব কল করল। আজ তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। রাত্রে মাসি শাশুড়ি সপরিবারে আসছেন, রাত্রে খাবার খেয়ে যাবেন। সেই করণে শাশুড়িমাকে হেল্প করার জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা। কাল আবার অ্যানুয়াল ফাংশন। তার প্রেজেন্টেশন রেডি করতে হবে।
ক্যাব বুক করার সময় শ্যামলালকাকাকে বলেছিল, কিছুদূর ছেড়ে দেবার কথা। কিন্তু শ্যামলাল সিং কিছুতেই রাজি হয়নি। বলেছেন, তিনি নিজের অবস্থান ভুলতে চান না, যতই হোক ইমন অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার আর শ্যামলাল সিং অফিসের পিয়ন ।
এই শ্যামলালকাকার জন্য আজ তার নিজের তরফ থেকে চাকরিটা টিকে গেল। না হলে ভেবেই নিয়েছিল রেজিগনেশান দিয়ে দেবে। বেঙ্গালুরুতে থাকাকালীন ওই অফিসে তার কোনও দিনই কোন অসুবিধা হয়নি। বিয়ের পর কলকাতায় ট্রান্সফার নিতে বাধ্য হয়। নতুন বিবাহিত জীবনে সংসার ফেলে, পরিবার ফেলে, এতদুর বেঙ্গালুরুতে একা পড়ে থাকবে, সেটা কোনও তরফের বাড়ির লোক মেনে নেয়নি। তাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, এমনকী যে প্রোজেক্টে কাজ করছিল সেটা ছেড়েই আসতে হয়েছিল বলে জব এক্সপিরিয়েন্স সার্টিফিকেটও হাতে পায়নি। কলকাতায় ফিরে এসে কাজের পরিবেশ তার একদমই ভাল লাগেনি। যার তত্বাবধানে নতুন প্রজেক্টের কাজ শুরু করে, সেই দেবাশিস সোম মানুষটা কামুক প্রকৃতির। একসঙ্গে কাজ করার অছিলায় অভব্য আচরণ করে চলে প্রতিনিয়ত। ইমন প্রথম প্রথম এতটা বুঝত না। ভাবত হয়তো হাত লেগে গেছে। কারণ, তার এত বছরের জব এক্সপিরিয়েন্স এই রকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি। বেঙ্গালুরুর অফিসে শুধুই কাজের পরিবেশ ছিল। কিন্তু কলকাতার অফিসে প্রথম দিন থেকেই ইমনের প্রতি দুর্বলতা দেখানো শুরু করে দেয় মিঃ সোম। বারে বারে বাইরে কফিশপে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি। অফিসের পর গাড়িতে লিফট দেওয়ার জন্য ইমোশনাল কারণ প্রদর্শন করা। এমনকী লাঞ্চের সময় ব্যাগ থেকে টিফিন বের করে শান্তিতে খাবার মুখে তোলারও অবকাশ পেত না ইমন। ঠিক ওই সময় ডেকে পাঠাতেন নিজের কেবিনে। ইমন প্রথম প্রথম না বুঝেই ভদ্রতা দেখিয়ে ফ্যালে। ব্যাস, ভদ্রতাটাই ইমনের দুর্বলতা ভেবে বসেন মিঃ সোম। কয়েকদিন যেতে না যেতেই অ্যাকাউন্টিং সেকশনের শ্রীপর্ণা ডেকে বলেন, ‘মিঃ সোম থেকে সাবধান থেকো। ফাঁকা অফিসে ওভারটাইম করতে যেও না কখনও।’ সেই থেকে ইমনের টনক নড়ে। দুদিন যেতে না যেতেই অফিস সময় শেষ হয়ে এসছে। ইমন মনিটর অফ করে ফাইলগুলো গুছিয়ে ড্রয়ারে রাখতে যাবে, তখনি ইন্টারকমে মিঃ সোমের গলা, আর্জেন্ট কল। বাধ্য হয়েই মিঃ সোমের কেবিনে যেতে হল। কেবিনে ঢুকতে যাবে, তখনই পিয়ন শ্যামলাল সিং এর সঙ্গে দেখা — ‘ম্যাম আপনি এখনও অফিসে! আপনার সেকশনে অনেকেই বেরিয়ে পড়েছে।’
— হ্যাঁ কাকা আমি বেরোচ্ছি। মিঃ সোম কেন ডাকলেন বুঝতে পারছি না।
ঘরে ঢুকতেই ইমন দেখে মিঃ সোম চেয়ারে মাথা হেলিয়ে বসে আছেন। ইমন বাড়তি কথা না বলেই জিজ্ঞাসা করল — ‘স্যার ডেকেছিলেন?’
প্রশ্ন শুনেও মিঃ সোম চুপ করে আছেন দেখে ইমন আবারও প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে। এবার মিঃ সোম আঃ উঃ করতে করতে সোজা হয়ে বসবার উপক্রম করেও আবারও চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলেন।
—উঃ বড্ড মাথা যন্ত্রণা করছে মিসেস মিত্র। আর পারছিনা। খুব পেইনফুল।
—মেডিসিন নিয়ে নিন স্যার, ঠিক হয়ে যাবে।
— উঃ, মেডিসিন এখন কোথায় পাবো? একটু যদি মাথাটা টিপে দিতেন, তাহলে একটু আরাম পেতাম। মিসেস মিত্র, আর পারছি না খুব কষ্ট হচ্ছে।
মিঃ সোমের আবদার শুনে ইমনের সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। সে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। আবারও যখন মিঃ সোম বলে উঠলেন — ‘প্লিজ মিসেস মিত্র ….’।
‘প্লিজ’ কথাটা শুনেই ইমনের মাথাটা দ্যপ করে জ্বলে উঠল, ‘স্যার, এই কাজে আমি অভ্যস্ত নই, আগে কখনও করিনি। আমি কাছের মার্কেট থেকে মেডিসিন এনে শ্যামলাল সিংয়ের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেলেই ঠিক হয়ে যাবেন।’
ইমনের কথা শুনে মিঃ সোম ভড়কে গেলেন, ভাবতেই পারেননি যে ইমন এরকম একটা চাঁচাছোলা জবাব দেবে।
একটা নিদারুণ ব্যর্থতায় মিঃ সোম গর্জে উঠলেন, আমার পেইন হচ্ছে, তাই আপনাকে বললাম। ঠিক আছে । …
‘আসছি স্যার।’ বলেই ইমন দরজাটা টেনে বেরিয়ে গেল। ইমন বেরিয়ে যেতেই মিঃ সোম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রাগে, আক্রোশে যেন কাঁপতে থাকেন তিনি। মনে করেছিলেন এই টোপে শিকার জালে উঠে আসবে। সেটা না হওয়ায় মুখোশের আড়াল থেকে পশুর আসল চেহারাটা যেন বেরিয়ে আসে। মিনিট কুড়ি পর শ্যামলাল সিং ওষুধ নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলে মিঃ সোম গেট আউট বলে ধমকে শ্যামলালকে বের করে দিলেন।
এর পরের দিন ছিল শনিবার। সেদিন মিঃ সোম শরীর ভাল নেই বলে অফিসে আসেননি। অথচ ফেসবুক স্টেটাসে অন্য কথা বলছে। সেদিন ইমনের অফিস টাইমটা খুবই নিশ্চিন্তে কাটে। পরেরদিন রবিবার। ইমন সারাটাদিন পরিবার, স্বামী এদের সাহচর্য ও সান্নিধ্যে সময় কীভাবে যে পার হয়ে যায়, বুঝতেই পারে না । সোমবার সকালে উঠে বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে চা বানাতে যাবে তখনি পিছন থেকে শাশুড়ি মা ইমন কে ডেকে বললেন —‘রোজই তো ফর্মাল পোষাকে অফিসে যাও। আজ নাই বা গেলে। তোমার জ্যাঠামনি ও জ্যাঠশ্বশুর বাড়িতে আছেন। দুদিন শাড়ি পরে অফিসে যেও। তারপর ওনারা চলে গেলে আবার আগের মতোই যেতে পারবে।’
ইমন কোনও দ্বিমত দেখায়নি। আজ সে পেস্তা রঙের একটা জর্জেট শাড়ি পরে অফিসে যায়। অফিসে ঢুকতেই সবার মুখে একই কথা, ‘নাইস লুক’ ‘ওসাম লুক’ শুনতে শুনতে ইমন নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়। কলিগদের তো জনে জনে বোঝতে পারছে না যে ভাল লাগার জন্য শাড়ি পরেনি, বিশেষ কারণে বাধ্য হয়েছে শাড়ি পরতে। লিফটে ওঠার সময় শ্রীপর্ণার সঙ্গে দেখা। তাকেই একমাএ কারণটা খুলে বলতে পেরেছে। শ্রীপর্ণা শুনে হেসে উঠেছে, ‘শান্তিতে একটু শাড়ি পরার জো নেই দেখছি। পরলে দোষ না পরলেও দোষ।’
সেদিনের শুরুটা যেমন তেমন কাটলেও ইমন যতটা সম্ভব মিঃ সোমকে এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু সেকেন্ড হাফে প্রোজেক্টের বিভিন্ন নোটস ভেরিফাই করতে গ্রুপ ডিসকাশনে ইমন মিঃ সোমের কেবিনে যেতে বাধ্য হয়। মিঃ সোম নিজের সিটের দুপাশে ভার্গভ আগরওয়াল ও দীপক বক্সীকে বসিয়েছেন। টেবিলের উল্টো দিকে ইমন বসে কম্পিউটারের মনিটরে চোখ রেখে কাজ করে চলেছে। সেই সুযোগে মিঃ সোমের লোভাতুর চোখ ইমনকে নিরীক্ষণ করে চলেছে। বুকের কাছে শাড়ির পাড় অন্যমনস্কতার কারণে হাফ ইঞ্চি খানেক নেমে আসাতে কামাতুর দৃষ্টি যেন নিবন্ধ হয়ে আছে ওই স্থানে।
দীপক বক্সী কিছু একটা জিজ্ঞাসা করাতে ইমন মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে দীপক বক্সীকে উত্তরটা দিতে যাবে, তখনই ইমনের চোখে পড়ে যায় মিঃ সোমের লোভাতুর চাউনি। ইমন ঝট করে বুকের শাড়ি ঠিক করে নিয়ে দীপক বক্সীকে তার প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে দেয়। ইমনের কথা শেষ হওয়া সঙ্গে সঙ্গেই মিঃ সোম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রিভিউ পয়েন্ট গুলো হাইলাইট করে আবারও বিবৃতি দিতে লাগলেন। সিটের চারদিকে ঘুরে ঘুরে তিনি তাঁর প্রেজেন্টেশন দিয়ে যাছেন। কখনও ভার্গভের চেয়ারের পিছনে এসে ভার্গভের কাঁধে হাত দিয়ে কম্পিটারের মনিটরে চোখ বোলাছেন। কখনও দীপকের কাছ থেকে ফাইল টেনে নিয়ে ইউনিট নম্বরটা দেখে নিছেন। ভাবখানা এমন যেন প্রোজেক্টটা সিরিয়াসলি দেখছেন এবং কলিগদের সঙ্গে কতই না বন্ধু সুলভ আচরণ করছেন। ফাইল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মিঃ সোম এবার ইমনের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। পরক্ষণেই ইমনের ঘাড়ের কাছে মাথা নামিয়ে ইমনের ল্যাপটপের তথ্যের সঙ্গে ফাইলের তথ্য মিলিয়ে দেখতে থাকেন। ইমন যতটা সম্ভব মাথাটা সরিয়ে মিঃ সোমকে মনিটর দেখার সুযোগ করে দেয়। চেয়ারের পিছনে ভর দিতে গিয়ে হাতটা ইচ্ছাকৃত ভাবে ইমনের অনাবৃত পিঠ ছুঁয়ে যায়। ইমন স্পষ্টই বুঝতে পারে মিঃ সোম ইচ্ছাকৃত ভাবে এটা করেছেন। তবু কলিগদের সম্মুখে সংকোচে নিরুত্তর থাকে। ভেরিফাই করতে গিয়ে বেশ কিছু পার্ট প্রজেক্টের ভুল ধরা পড়ে, আর সেই প্রজেক্ট পার্ট ছিল ইমনের দায়িত্বে। মিঃ সোম সেই ভুলের সুযোগ নিয়ে ইমনকে সরাসরি দোষারোপ করে চলেছেন। ভার্গভ ও দীপকের দ্বায়িত্বে যেটুকু কাজ ছিল, অনেকটাই ঠিক হয়েছে বলে বাকি কাজটা কীভাবে করবে, সেটা মিঃ সোম ওদের বুঝিয়ে দিয়ে ওদের নিজেদের ডেস্কে পাঠিয়ে দিলেন। ইমনও ওদের সঙ্গে উঠে যেতে যাবে তখনই মিঃ সোম বললেন, ‘মিসেস মিত্র, আপনি রেক্টিফিকেশান করেই না হয় যাবেন।’
ইমন বাধ্য হল পুনরায় চেয়ার টেনে বসতে। মিঃ সোম চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কীভাবে ইমন রেক্টিফাই করছে, দেখছেন। নজর মনিটর ছেড়ে অনেক আগেই ইমনের অনাবৃত কাঁধ ও পিঠের অংশটুকুতে উঠে এসেছে। ঝুঁকে সামনের বক্ষদেশে দেখার প্রবল আগ্রহ আর দমিয়ে রাখতে না পেরে কাঁধের কাছে মুখ এনেছেন। ভারী গরম নিঃশ্বাস ইমনের কাঁধে পড়ছে। ইমন কুঁকড়ে চেয়ারে বসে আছে। ‘স্যার, এইভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে আপনি পাশের চেয়ারটায় বসুন প্লিজ।’ ইমনের বলা শেষ হতে না হতেই মিঃ সোমের মোবাইল বেজে ওঠায় মিঃ সোম টেবিলের অপর প্রান্তে রাখা মোবাইলটা নিতে যান। ইমন ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। মিঃ সোম মোবাইলে হ্যাঁ হুঁ জবাব দিয়ে ফোন কল শেষ করে ইমনের কাছে ফিরে আসেন।
—‘এ কী! মিসেস মিত্র, এর মধ্যে সব হয়ে গেল?’
— না হয়নি, এমনি মানে ….
— খুব ক্লান্ত লাগছে আপনাকে মিসেস মিত্র ….কথাটা বলেই মিঃ সোম হঠাৎই ইমনের একদম কাছে এসে হাত দিয়ে ইমনের মুখের উপর পড়া চুল গুলি সরিয়ে দিতে যান।
ইমন আপত্তি করে ওঠে, ‘কী করছেন স্যার! গায়ে হাত দিছেন কেন?
—কেন, হাত দিলে কী হবে? আমার হাত দেওয়া তো আপনার ভাল লাগে। তখন পিঠে হাত দিলাম, আপনার তো ভালই লাগলো।
—এই সব কী বলছেন স্যার!
—ঠিকই বলছি …বলেই মিঃ সোম ইমনের কোমরটা দুহাতে জড়িয়ে টেবিলে ঠেসে ধরেন, যাতে ইমন পালাতে না পারে।
— এ কী করছেন স্যার? ছাড়ুন আমায়, ছাড়ুন বলছি …
—ছাড়বো বলে তো ধরিনি ….মিঃ সোম ইমনের কোমর থেকে একটা হাত নামিয়ে ইমনের নিতম্বপরে বক্ষদেশে হাত দিয়ে জোর জবরদস্তি করে চুম্বন দিয়ে যান। ইমন চিৎকার করে উঠে মিঃ সোমকে ধাক্কা দিতে থাকে। কিন্তু গায়ের জোরে পেরে ওঠে না। তখনই দরজা খুলে শ্যামলাল সিং কেবিনে ঢোকেন, হাতে কফির কাপ — ‘স্যার জি, আপনি কী করছেন ইমন বেটির সাথে? ওকে ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন! ’
মিঃ সোম বাধ্য হন ইমনকে ছেড়ে দিতে।
এরপর তিনি শ্যামলালকে বকাঝকা করে কেবিন থেকে তাড়িয়ে দেন। তবুও শ্যামলাল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটা দেখে মিঃ সোম এবার ক্ষেপে ওঠেন। তিনি ইমনকে শাসিয়ে এক ধাক্কা দিয়ে দরজার দিকে ঠেলে দেন ।
ইমন নিজের ডেস্কে এসে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। পিছনে শ্যামলাল এক গ্লাস জল নিয়ে এসে দাঁড়ায়। গ্লাসের জল ইমনের দিকে বাড়িয়ে তারপর বলেন, ‘বেটি তুমি কাঁদছো? কেঁদে কী হবে বলো? এখন মেয়েরা আর্মিতে কাজ করে। ফাইটার প্লেন চালায়। আর তুমি চোখ দিয়ে জল ফেলছো। সাহস করো ওই লুমড়িটাকে সবার সামনে বেইজ্জত করো। ভয় কীসের?
—কিন্তু কাকা কীভাবে? জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। উনি আমাকে এই প্রোজেক্ট থেকে ডিসমিস করে দেবেন বলে ভয় দেখিয়েছেন। আগের প্রোজেক্টটা ইনকমপ্লিট রেখে এসেছিলাম। এটা থেকে ডিসমিস করলে আর ভাল কাজ পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে। প্রোজেক্ট সাবমিটের পর আমিই রিজাইন দিয়ে দেব।
—নকরি ছাড়বে যখন ঠিক করেছো, তখন আর ভয় কী? চলো এমন ইন্তেজাম করি ওই সোম আর মুখ দেখাতে পারবে না। আমি যেখানে থাকি, সেখানে একটা চোস্ত ছেলে আছে যে কোনও ইলেকট্রনিক কাজ চুটকিতে করে ফেলে। এমনকী কম্পিউটার হ্যাক পর্যন্ত করতে পারে। তাকে কাজে লাগাবে?
—সে কী করবে আমার জন্য?
—কেন, মিঃ সোমের রুমে যে ক্যামেরা আছে, তার তসবির অর ভিডিও তো আছে। ওই গুলো বার করো। ওই ভিডিও উপর ওয়ালা বসদের দেখিয়ে দাও। ওনার ওয়াইফ এঁর মোবাইলে পাঠিয়ে দাও। বেটি বুঝতে পারছো, আমি কী বলছি ?
ইমন চোখের জল মুছে হাঁ করে শ্যামলাল সিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না
—কাকা, এ তো ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া! ভিডিও ফুটেজতো কন্ট্রোল রুমে থাকে। আবার মিঃ সোমের কম্পিউটারে সেটা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু এটা জানাজানি হয়ে গেলে তোমার চাকরি চলে যাবে।
—এই বয়সে এসে নকরির পরোয়া করি না। আমার চারঠ লেড়কির সাদি হয়ে গেছে। আমারও আর নকরি ভাল লাগছে না। ভাবছি মজফরপুর দেশে চলে যাব। আমার ঘরওয়ালি হর রোজ চলে আসার জন্য বলে।
ইমন শ্যামলাল সিংয়ের কথা শুনে হাতে যেন চাঁদ পেল। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।
—কাকা তুমি আমার জন্য এটা করতে পারবে ?
—হাঁ বেটি, আমি করব। অফিসে ইয়াং ছেলে মেয়ে থেকে বুড়া, সবাই আমাকে শ্যামলাল বলে ডাকে। স্রেফ তুমি আমায় কাকা বলে ডাকো। আজ মিঃ সোম তোমার সাথে যা করেছে তার সাজা ও পাবেই। তুমি আমাকে বলো মিঃ সোম এর মধ্যে কি বাইরে যাবে? ও যখন কেবিনে থাকবে না, তখনই এসি মেশিন সার্ভিসিংয়ের নাম করে আফতাবকে অফিসে নিয়ে আসব আমি। তুমি শুধু আফতাবের নাম কাউকে বলো না। ওর বউ–বাচ্চা আছে।
—ওফ! কাকা, ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া। তুমি ছেলেটাকে ভাল করে বুঝিয়ে বলো। ওর এর জন্য যা টাকা চাইবে, আমি তাই দেব। একবার ওই ভিডিও ক্লিপিংস আমি হাতে পাই। মিঃ সোমকে আমি বরবাদ করে দেব। কাকা, মিঃ সোম কালই ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছে অফিসের কাজে। তুমি কালকেই ছেলেটিকে আনার চেষ্টা করো।
####
ইমন পেরেছে সমস্ত ভিডিও ক্লিপস জোগাড় করতে। বিনিময়ে আফতাব ছেলেটি কিছুই চায়নি। তবুও ইমন খামে ভরে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে আফতাবের হাতে। ইমন পেনড্রাইভ নিজের অফিসের ডেস্কের তলায় লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে আটকে রেখেছে। বাড়িতে পেনড্রাইভ নিয়ে রাখা নিরাপদ নয়। ঘুণাক্ষরেও যদি অর্ণব জানতে পারে, আর একমুহূর্ত অপেক্ষা করবে না। ইমনকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করবে। ইমন চাকরি এমনিতেই ছাড়বে, কিন্তু আত্মসম্মান টিকিয়ে রাখার লড়াইটা লড়ে। অ্যানুয়াল বোর্ড মিটিংয়ে যেদিন প্রোজেক্ট ডিসপ্লে করা করা হবে, সেদিনই কোম্পানির সিইও, ডিভিশনাল ম্যানেজার সবাই আসবেন। সেদিন প্রজেক্টরের মাধ্যমে অন স্ক্রিন দেখিয়ে দেবে তার ওপর হওয়া সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট। কপালে যা আছে দেখা যাবে সেদিন।
আজ সেই মহার্ঘক্ষণ, ইমন ডেস্কের তলা থেকে পেনড্রাইভ বের করে ট্রাউজারের পকেটে রেখেছে। ইমন মনে মনে ছটফট করছে কীভাবে আজ এই পেনড্রাইভ প্রোজেক্টের সঙ্গে ডিসপ্লে করবে। কারণ, ফাইল রেডি করার দায়িত্বে ইমন ও দীপক বক্সী ছিল। কিন্তু প্রজেক্টরের ডিসপ্লে ভার্গভ আগরওয়ালের দায়িত্বে ছিল। ইমন আর থাকতে না পেরে ভার্গভকে বলেই বসে, ‘ভার্গাভ, আপনি অন স্ক্রিন ডিসপ্লে রিচেক করেছেন? আমরা তো কিছুই দেখলাম না। একবার ভেরিফাই করে নিলে হত না? মিঃ সোম ফাইল ফাইনাল চেক করতে ডেকেছেন। দীপক গেছে ফাইল নিয়ে মিঃ সোমের কেবিনে।’
—আমি তো কয়েকবারই দেখেছি। নিজের তৈরি হয়তো তাই কোনও ভুল চোখে পড়ছে না। মিসেস মিত্র আপনি একটু চেক করে নিন প্লিজ। আমি বরং লাঞ্চটা সেরে ফেলি। আর তো লাঞ্চ করার সময় পাবো না। চারটে থেকে মিটিং শুরু হয়ে যাবে।
ইমন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। বিনয়ের স্বরে তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে যায় ভার্গভের প্রস্তাবে। প্রতিদিনের সহ্য করা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের সমীচীন জবাব দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আজ আত্মসম্মানের লড়াইটা লড়ে জিততে হবেই তাকে। শয়তান কামুক নারী লোভী অমানুষটা যে কোনও মহিলাকে সহজলভ্য মনে করে। প্রত্যেক মহিলারই কর্মক্ষেত্রে আত্মসম্মানের সঙ্গে কাজ করার অধিকার আছে সেটা মিঃ সোমের মুখোশ টেনে খুলে দেখানোর প্রয়োজন আছে। নিজের ঘরে মা স্ত্রী ওনারা দেবী হয়ে থাকবেন আর ঘরের বাইরের বাকি মেয়েরা
বিনোদনের বস্তু? অন্য বাড়ির সম্মানকে নগ্ন করার আনন্দ বড়ই উপভোগ করেছেন মিঃ সোম। এবার যথার্থ সময় এসেছে মিঃ সোমকে অফিসে ও সমাজের সামনে নগ্ন করার। ইমন পকেট থেকে পেনড্রাইভটা বের করে চট জলদি প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়।
সেই সন্ধিক্ষণ হাজির। ইমন ভয় কাটিয়ে উদগ্রীব হয়ে আছে কখন ভার্গভ প্রজেক্টর চালু করে অন স্ক্রিন প্রোজেক্ট দেখাবেন। মিঃ সোম আর দীপক বক্সী প্রোজেক্ট সমন্ধে বিস্তারিত আলোচনার দ্বারা বোর্ড মিটিং উপস্থিত কোম্পানির সিইও, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, কমিটির মেম্বারদের বোঝালেন। সবাই প্রোজেক্ট সমন্ধে খুবই আশাবাদী।
তাঁরা অন স্ক্রিন প্রজেক্ট ডিসপ্লে করতে বলায় ভার্গভ স্ক্রিনে ডেমো বোঝতে যাবেন, তখনই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ইমনের ভিডিও ক্লিপস। ‘গুড ইভিনিং স্যার ও ম্যাডাম। এই প্রোজেক্ট করতে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। কিন্তু কতটা করেছি কেউ জানেন না, বা জানার দরকারও নেই। তবুও বলছি একবার জেনেই দেখুন কর্পোরেট জগতে হৃদয়ের ছোঁয়া পাবেন। মাত্র পাঁচ মিনিটের ভিডিও আপনাদের দেখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি । ….এতটা অবধি হতেই ভার্গভ ভিডিও বন্ধ করতে তৎপর হলে কোম্পানির সিইও মিসেস মধুমিতা নাইয়ার হাত তুলে বারণ করলেন। …..ভিডিও ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে —- ‘এই দেখুন ঘড়িতে রাত সাড়ে নটা বাজে মিঃ ভার্গভ আগরওয়াল এখনও প্রজেক্টের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আজ পঁচিশে ফ্রেব্রুয়ারি মিঃ ভার্গভের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী, বাড়িতে স্ত্রী অপেক্ষা করে বসে আছেন, বিবাহ বার্ষিকীর পার্টিতে সবাই এসে গেছে। শুধু মিঃ ভার্গভ পার্টিতে
পৌঁছতে পারেননি, কারণ তিনি অফিসে প্রোজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। এই ছবি দেখানোর পর হাততালিতে ভরে গেল সভাকক্ষ। মিঃ ভার্গভ আগরওয়াল স্বগর্বে লজ্জিত মুখে সবার দিকে তাকালেন।
এবার দেখুন দীপক বক্সী। রাত নটা পয়ঁত্রিশ হয়ে গেছে। এখনও ফাইলে মুখ গুঁজে আছেন। সকালে ইনি আমায় জানিয়েছিলেন, ওঁর ছোট্ট মেয়ের খুব জ্বর। তাঁর স্ত্রী তিনবার ফোন করে রিকোয়েস্ট করেছেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতে, মেয়েকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যেতে হবে। রাত নটায় মিঃ বক্সী ওনার স্ত্রীকে একাই মেয়েকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। সেই দিন রাত্রে ছোট্ট মেয়েটির অসুস্থতা বাড়াবাড়ি হওয়ায় মিসেস বক্সী বাচ্চাটিকে নার্সিংহোমে ভর্তি করেন। মিঃ বক্সী অফিস থেকে রাত সাড়ে দশটায় নার্সিং হোমে পৌঁছন। এই ভিডিও ক্লিপস শেষ হতেই মিসেস আইয়ার ও মিঃ জুনেজা বলে ওঠেন, ‘দীপক আপনার কাজের প্রতি নিষ্ঠা দেখে আমরা গর্বিত।’ আবারও হাততালিতে ভরে ওঠে সভাকক্ষ। মিঃ বক্সীর চোখে জল এসে গেছে। তবুও তিনি টাই এর নটটা ঠিক করে ইমনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন ।
এবার আসছেন আমাদের শ্যামলাল সিং। ইনি এই অফিসে পিয়ন। ঘড়িতে সকাল নটা বাজে, গুনগুন করে গান করতে করতে সবার টেবিল মুছে সবার টেবিলে একগ্লাস ঠান্ডা জল রাখছেন। যাতে আমরা অফিসে ঢুকেই গলা ভেজাতে পারি। এই দেখুন, এখন ঘড়িতে এখন রাত নটা বাজে, আমরা যারা অফিসে আছি, আমাদের সবাইকে হাসি মুখে কফি খাওয়াছেন। ইনি হলেন আমাদের সকলের যত্নশীল শ্যামলাল সিং। এর জন্যই আমরা কাজে এতো স্ফূর্তি পাই ।
… শ্যামলাল সিং সভা কক্ষের বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে ডেকে আনা হয় এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। …শ্যামলাল আজ খুবই খুশি ম্যানেজিং ডিরেক্টররা তাঁকে আজ ডেকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বলে। দূর থেকে দুহাত তুলে সবাইকে নমস্কার জানান এবং তারপরই হাত তুলে ইমনকে আশীর্বাদ জানালেন।
এবার আসছি আমাদের স্বনামধন্য স্যার মিঃ দেবাশিস সোমের নিষ্ঠার কথায়। সেটা শুনে মিঃ সোম টাই এর নটটা ঠিক করে একটু গদগদ মুখে চেয়ারের সোজা হয়ে বসলেন। ইনি অফিসে বেশিক্ষণ সময় মোবাইলে ব্যস্ত থাকেন। তারপর স্ক্রিনে ভেসে এল ইমনের ওপর হওয়া প্রতিদিনের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের ভিডিও ক্লিপস গুলো। কখনও ইমনের কাঁধে হাত দিয়ে গা ঘেঁসে দাঁড়াচ্ছেন। ইচ্ছাকৃত ভাবে ইমনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ইমন কখনও লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে নতুবা বিরক্তি ও ঘেন্নায় ভ্রু কুঁচকে মুখ কালো করে আছে। এবার সেই ক্লিপস ভেসে ওঠে স্ক্রিনে যেদিন মিঃ সোম নিজের কেবিনে ইমনকে জোর করে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গিয়েছিলেন, ইমনের নিতম্ব ও বক্ষদেশে জোরজবরদস্তি করে হাত দিয়েছিলেন। সেই সময় শ্যামলাল সিং বন্ধ দরজা খুলে কফি দিতে এসেছিলেন। তিনি সেই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠেন, ‘স্যার জি, আপনি কী করছেন ইমন বেটির সাথে? ওকে ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন!’ শ্যামলাল এসে না বাঁচালে সেদিন কামুক মিঃ সোমের হাতে নিজের সম্মান বাঁচানো কঠিন হয়ে যেত ইমনের। তারপরের ছবি। মিঃ সোম শ্যামলাল সিংকে বকাঝকা করে দূর দূর করে তাড়াছেন কেবিনে থেকে। ইমনকে শাসাছেন, ‘এই ঘটনা পাঁচ কান করলে তোমার চাকরি খেয়ে নেব। এই প্রোজেক্টে কাজ করতে হলে আমাকে খুশি করে চলতে হবে তোমাকে। এই রকম সব অফিসেই চলে। তোমাকেও আমার খেয়াল রাখতে হবে। এই বলে ধাক্কা মেরে ইমনকে কেবিন থেকে বের করে দেন। ইমন কাঁদতে কাঁদতে নিজের ডেস্কে আসে। এতক্ষণ কাজের ছুতো দেখিয়ে মিঃ সোম ইমনকে অফিসে আটকে রেখেছিলেন। অফিসে আর তখন তেমন কেউ ছিল না যে ইমন ঘটনাটা জানাতে পারে কাউকে। শ্যামলাল সিং সেদিন ইমনকে শুধু রক্ষাই করেননি, ভরসা দিয়েছিলেন যে, এই ঘটনার একটা বিহিত করতে হবে, ম্যানেজিং কমিটিকে জানাতে হবে ব্যপারটা প্রমাণ সমেত। তাই এই ভিডিও করা হয় কন্ট্রোল রুম থেকে ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে।
… এরপরেই মিঃ সোম চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গর্জে ওঠেন, ‘এই গুলো সব মিথ্যা। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। আমার রেপুটেশান খারাপ করতে চাইছে ইমন, ভার্গভ দীপক, শ্যামলাল মিলে। আমি কিছুই করিনি।’
মিসেস আইয়ার আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে ওঠেন —- ‘একদম চুপ মিঃ সোম। যা করেছেন আমরা দেখেছি। আপনি এখুনি বেরিয়ে যান মিটিং থেকে। আমরা ম্যানেজমেন্টের তরফ থেকে পরে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি আপনার সঙ্গে কী করা হবে। সব অফিসে এটাই হয় তাই না মিঃ সোম? এবার আপনি জানতে পারবেন আমাদের অফিসে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে আপনার ওপর। এখন আপনি আসুন।’
মিঃ সোম বাধ্য হলেন কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে যেতে। মিঃ সোম বেরিয়ে গেলে ইমন নিজের সিটে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মিসেস আইয়ার ভার্গভ ও দীপককে ইশারায় ইমনের কাছে যেতে বলেন। দীপক এগিয়ে এসে ইমনকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দেয়। ইমন চোখের জল মুছে ম্যানেজিং ডিরেক্টর কমিটিকে বলে — ‘আপনাদের অনেক সময় আমি নষ্ট করলাম। কিন্তু এটা করা ছাড়া আমার আর অন্য উপায় ছিল না। আমার মনেহয় এখানে চাকরি করা আর সম্ভব নয়।’
—মিসেস মিত্র, এই ঘটনা সত্যি লজ্জাকর ও অপমানজনক। তবুও বলছি এই ঘটনার জন্য মিঃ সোমের ওপর সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা আপনাকে কথা দিচ্ছি। এই ঘটনার জন্য আপনার চাকরি ছাড়ার দরকার নেই।
—আপনি ঠিক বলেছেন মিঃ জুনেজা। আচ্ছা মিসেস মিত্র আপনাকে এই ভিডিও তৈরির জন্য কে সাহায্য করেছে? আপনার একার দ্বারায় এটা সম্ভব নয়।
—ম্যাম, ওনার নাম বললে ওনার চাকরি নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না তো?
—না, হবে না। বলুন।
—শ্যামলাল কাকা, মানে শ্যামলাল সিং। উনি সেদিন আমাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। উনি আমাকে আপনাদের ভিডিওটি দেখানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। এবং কন্ট্রোল রুমের চাবি আমাকে উনি জোগাড় করে দেন।
ইমন কথা রেখেছিল। আফতাবের নাম ভুলেও মুখে আনেনি।
সেদিনের বোর্ড মিটিংয়ে ম্যানেজিং কমিটি ঠিক করেন শ্যামলাল সিংকে তাঁর বারো বছর কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও সততার জন্য বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হবে অ্যানুয়াল ফাংশনের দিন। আর সেই ফাংশনে পুরষ্কার নিতে যাবার জন্য ইমন শ্যামলাল কাকাকে জোর করে মলে নিয়ে এসেছে একটা নতুন পোশাক কিনে দেওয়ার জন্য। এটা ইমনের আবদার বলে শ্যামলাল তার ইমনবেটিকে না করতে পারেননি ।
####
অন্ধকার রাস্তায় ইমন বুক করা ক্যবের নম্বর দেখতে পায়নি। ক্যাবটি ইমনকে পাশ কাটিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ইমন ক্যাব ড্রাইভারকে ফোন করে জানতে পারে ক্যাব এসে গেছে।
—ইমন বেটি, মনে হচ্ছে ওই তোমার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
ইমন দেখতে পেয়ে জোরে হাঁটা লাগায়।
—ও ইমন বেটি, তোমার ফাইল ছেড়ে যাচ্ছো।
ইমন ক্যাব বুক করার সময় হাতের ফাইলটা শ্যামলাল সিংয়ের হাতে দিয়েছিল, সেটাই ভুলে ক্যাব ধরতে যায়। শ্যামলাল সিং এর গলা পেয়ে ইমন পিছন ফিরে তাকাতে যাবে, তখনই অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দ্রুত গতি সম্পন্ন একটা কালো স্কর্পিও। সজোরে ধাক্কা মারে শ্যামলাল সিংকে, চোখের সামনে অতর্কিতে ঘটা অ্যাক্সিডেন্ট দেখেও কিছু বোঝার আগেই আবারও সজোরে ইমনকে ধাক্কা মেরে উড়িয়ে ফেলে দিয়ে গাড়িটা খুব দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায়। ইমন উড়ে এসে সজোরে ফুটপাতের রেলিংয়ে বাড়ি খেয়ে পড়ে। ফুটপাতের রেলিংয়ের উপর পড়ার পর মাথায় আঘাতের দরুণ তাৎক্ষণিক মৃত্যু। শ্যামলাল সিংয়ের দেহটি রক্তমাংসের ঢেলা হয়ে রাস্তা পড়ে রইল। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত দুটো সাবলীল প্রাণ নিজেদের মধ্যে কতই না কথা বলছিল। এখন মুহূর্তে নিথর হয়ে অন্ধকার রাস্তায় বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে রইল। সামনে দাঁড়ানো ট্যাক্সির ড্রাইভার গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ওই ভয়ানক অ্যাকসিডেন্ট দেখে আবারও গাড়িতে ফিরে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে উধাও হয়ে যায়। রাস্তায় হুস হুস করে গাড়ি চলেছে, কোনও গাড়ি থামছে না। কলকাতা শহরের অমানবিক মুখ ভেসে ওঠে রক্তাক্ত অন্ধকার রাস্তায়। শ্যামলালের পুরষ্কার নিয়ে নিজের গ্রামে স্ত্রীর কাছে আর যাওয়া হল না। ইমন– অর্ণব ঠিক করেছিল অ্যানুয়াল ফাংশনের পর ওরা মরিশাস যাবে। ইমন আজই তাই মল থেকে অর্ণবের জন্য দুটো ক্যাপ্রি প্যান্ট কিনেছিল। সবই পড়ে রইল রাস্তায়। তারই উপর দিয়ে সাঁ সাঁ করে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। বুক ভরা আশা ভরসা অঙ্গীকার নিমেষের মধ্যে অনন্তলোকের যাত্রী হয়ে মিশে গেল যেন ঘোর অন্ধকারে । যে অন্ধকারে জীবন্ত নিঃশ্বাস পড়ে না, কেবলই নিথর শীতল অনুভূতি বাতাসে ঘোরাফেরা করে।
####
এই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত শুরু হয়। মিঃ সোমকে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের জন্য কোম্পানি থেকে বহিষ্কার করা হয়। সে কারণে মিঃ সোমকেও অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি। সল্টলেকের অন্ধকার রাস্তায় কোনও প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। রাস্তায় কোনও ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত অ্যাক্সিডেন্ট কেস বলে তদন্ত বন্ধ করা হয়। কিন্ত কিছু তদন্ত ফাইল পত্র ঘেঁটে হয় না। ওই অন্ধকার বাতাসে মিশে যাওয়া অপ্রাকৃতিক অনুভূতি গুলি নিজেদের মতো করে সত্য খোঁজার চেষ্টা করে চলে প্রতিনিয়ত।
এই ঘটনার পর চার বছর অতিক্রম করেছে। মাস চারেক হলো সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে একটি সফ্টওয়ার কোম্পানিতে আমিনা খাতুন নিযুক্ত হয়েছেন। আমিনা খাতুন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার, ছাব্বিশ বছর বয়স। কাজে যোগদান করা থেকে আজ অবধি অফিসের পরিবেশ তার ভাল লাগেনি। ওর কলিগ রাকেশ ভাণ্ডারি আর কল্যাণ শর্মা ছেলেদুটি প্রায়ই উত্যক্ত করে চলেছে সেই প্রথম দিন থেকে। আজ আমিনার দেরি হয়ে গেছে। প্রায় রাত আটটা বাজে। কালকেই ফাইলটা বসের কাছে হ্যান্ডওভার করে দিতে হবে বলে আজ এতক্ষণ ধরে সেটা শেষ করে তবে চেয়ার ছাড়ল। এতক্ষণ একটানা কাজ করায় ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে গেছে। আমিনা ঘাড়ে গলায় জল দেওয়ার জন্য বাথরুমের দিকে অগ্রসর হলে হঠাৎই পিছন থেকে আমিনার মুখ সজোরে চিপে ধরে হাত মুচড়ে টানতে টানতে রকেশের কেবিনে ঢোকায়। কেবিনে রাকেশ আগে থাকতেই ছিল শিকারের লোভে। আমিনা কোনওরকমে মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখে কল্যাণ তার হাত মুচড়ে ধরে আছে। আমিনা তার আর এক হাত দিয়ে বল পূর্বক নিজেকে ছাড়াতে চায় । রাকেশ এসে আমিনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনে মিলে আমিনার ওড়না দিয়ে আমিনার মুখ বেঁধে ফেলেছে। আমিনা নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। রাকেশ কল্যাণ আমিনার উপর জোরজবরদস্তি শুরু করে দেয়। তখনই টেবিলের থেকে ল্যাপটপটা প্রায় উড়ে এসে সোজা রাকেশের মাথায় সজোরে বাড়ি । রাকেশ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কল্যাণ রাকেশের হঠাৎ কী হল, দেখতে মাথা ঘুরিয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার ক্যাচ লকটা নিজে থেকে ঘুরে খুলে যায়। দরজা খুলে একটা ট্রেতে দুকাপ ফুটন্ত কফি ঢোকে। গরম কফি কেউ যেন ছুঁড়ে মারে কল্যাণের মুখে চোখে। কল্যাণ আমিনার হাত ছেড়ে দিয়ে দুহাতে চোখ চিপে মাটিতে বসে পড়ে। আমিনা ধস্তাধস্তিতে হাঁপাছে। কোনও রকমে মুখের বাঁধন খুলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। টেবিলের সামনের দুটো চেয়ার তুলে সমানে কল্যাণ আর রাকেশের উপর এলোপাথাড়ি মার শুরু হয়। কামুক যুগল মাটিতে নেতিয়ে পড়লে মার থামে।
—আরে ইমন বেটি, তুমি এখানে?
—আরে কাকা, তুমি একা পারতে সামাল দিতে? আমি ছিলাম বলেই না এই জানোয়ার দুটো মাটিতে শুয়ে আছে। কাজ শেষ, চলো যাই এবার।
1 comment
খুবই সুবিন্ত্যস্ত এবং বাস্তবধর্মী একটি গল্প । গল্পের শেষে লেখিকা তার প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছেন একটি অদ্ভুত মুন্সীয়ানায় , অশরীরী চরিত্র গঠন করে । শুভেচ্ছা রইল ।