প্রশান্ত কিশোর কি পারবেন মমতাকে টেনে তুলতে?‌‌

সুগত রায়মজুমদার

কয়েক মাস হল, আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজের জন্য একজন নির্বাচন পরামর্শদাতা নিয়োগ করেছেন। তাঁর নাম প্রশান্ত কিশোর।তিনি পি কে বলেই পরিচিত ভারতের নির্বাচনে। গত লোকসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস খারাপ ফল করায় একজন পরামর্শদাতার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। জানি না, তাঁর জন্য কত টাকা বরাদ্দ।‌ এই টাকা কে জোগান দিচ্ছে।‌ তবে বিরোধী দলের নেতাদের ধারণা,  ৪০০–‌৫০০ কোটি  টাকার মতো।

অতীতে, ২০১৪ সালে বিজেপি তাঁর ওপর ভরসা রেখেছিল। তারও আগে, গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন মোদি ভরসা রেখেছিলেন। হাতেনাতে ফলও পেয়েছিল বিজেপি। বিহারের বিধানসভা ভোটে নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদ জোটের পক্ষেও তিনি কাজ করেছিলেন।এখানেও দেখা গিয়েছিল প্রশান্ত ম্যাজিক।আবার ব্যর্থতাও আছে। এবার তাঁকে কাজে লাগাতে চাইছেন মমতা। ২০২১ এ কি আবার ক্ষমতায় আসতে পারবেন?

গত লোকসভা ভোটের সময় মমতা যেভাবে মুসলিম অধ্যুষিত জেলায় ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেছেন এবং যেভাবে বিজেপি দলের কেউ যদি তাঁকে ‘‌জয় শ্রীরাম’‌ বলে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করত,  সেখানে তিনি সব জায়গায় রিঅ্যাক্ট করতেন বিশ্রীভাবে। যা জনমানসে খুবই খারাপভাবে প্রতিফলন পড়েছে। খুবই সস্তা মনে হয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। কিন্তু পিকে–‌র অনুশাসনে গিয়ে মমতা এখন নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন। গুরুর দেওয়া মন্ত্র অনেকটাই মেনে চলছেন।এখন তিনি সহজে রাগছেন না। তবে কিছু কিছু জায়গায় এখনও নিজেকে সামলাতে পারছেন না। যেমন, এন আর এস হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রথমে খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য করেছিলেন। তবে তৎপর ছিলেন পিকে। পিকে তৎক্ষণাৎ নিশ্চয়ই ভাল ডোজ দিয়ে সেই বিষয়টা সামলেছেন। মমতা ব্যানার্জি প্রথমে যেমন গোঁ ধরেছিলেন, জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বসবেন না এবং সেই ঘটনাতে দমন নীতি প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন,  সেটা নিশ্চয়ই পিকে করতে দেননি। এর পরের ঘটনা সকলের জানা। তিনি শেষ পর্যন্ত জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন এবং সেই ইস্যুটা ঠাণ্ডা মাথায় মিটিয়েছেন। যা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি কখনই কারও কাছে মাথা নত করতে চান না। মমতা প্রধানমন্ত্রীকেও প্রকাশ্যে জঘন্যভাবে তিরষ্কার করেন। যা জনগণের মধ্যে খুব খারাপ প্রভাব পড়েছিল। পিকে এখন তাঁর দায়িত্ব নিয়ে সেই উন্নতিটাই করিয়েছেন। তাঁর মানসিকতায় অনেকটাই ভারসাম্য আনতে পেরেছেন। যা দেখে তাঁর দলের প্রথম সারির অনেক নেতাই বিস্মিত হয়েছেন।

prashant kishore

এখন প্রশ্ন উঠছে  রাজনৈতিক মহলে, সামনের ২০২১–‌এর বিধানসভা ভোটের ফল কী হতে পারে?‌  লোকসভা ভোটে যতটা খারাপ ফল হয়েছে, এখন সেটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। মমতার মধ্যে তাঁর নিজের তৈরি করা কর্মসূচির ওপর অগাধ আস্থা ছিল। সেটা হয়নি। তাঁর ধারণা, দলের নেতাদের ও কিছু কর্মীর জন্যই সেটা ফলপ্রসূ হয়নি। বেশ কিছু ও কিছু কর্মীর মধ্যে কাটমানি খাওয়ার প্রবণতা এই খারাপ ফলের অন্যতম কারণ। এখন নিজের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ করার জন্য প্রশান্ত কিশোরের অনুশাসনে দলের নেতাদের বিরুদ্ধেও লেলিয়ে দিয়েছেন। নেতারা পড়েছেন বেকায়দায়। অনেক জায়গায় তাঁরা জনগণ দ্বারা আক্রান্ত। নেতাদের বক্তব্য, তাঁরা যে টাকা পেয়েছেন, তা তো ওপর মহলেও খেয়েছে। তিনি পুলিসকর্তাদের ও জেলা প্রশাসনকেও প্রকাশ্যে ভর্ৎসনা করছেন। সেই সব কর্তারাও তাঁর ওপর রুষ্ট হচ্ছেন। মমতা আর দেখছেন না, কে এই কাটমানির টাকা খাচ্ছেন। তাঁকে ঠিক খবর দেয়নি প্রশাসন। আর সেই নেতারা ভয়ে নেত্রীকে খুশি করতে গিয়ে সত্য গোপন করতেন। তাই বেশ কয়েকটি জেলায় সাংগঠনিক রদবদল করেছেন।

বিজেপি যেভাবে আমাদের রাজ্যে নিজেদের দল বিস্তার করছিল, তা এখন কিছুটা স্তিমিত। সেটা প্রশান্ত কিশোরের অনুশাসনের ফলেই সম্ভব হয়েছে। এখন ভাঙন মেরামতি চলছে। তবে এই দল ভাঙার কাজটা মমতাই শুরু করেছিলেন। মুর্শিদাবাদে প্রশাসনকে প্রয়োগ করে যেভাবে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে এনেছেন, এতে বিরোধী দলগুলি এককাট্টা হওয়ার সুযোগ নিয়েছে। এর পর হয়তো আসন্ন পুরসভা ভোট ও বিধানসভা ভোটেও বিরোধী দলগুলি এই পথই কি অনুসরণ করবে, না নিজেদের জেতার ওপর জোর দেবে?‌ তা সময়ই বলবে। তবে মনে হয়, বিরোধী দলগুলি লোকসভা ভোটে এককাট্টা হয়েছিল, তার পরিবর্তন হবে না। কারণ, সিপিএম, কংগ্রেসের প্রধান শত্রুই তৃণমূল। মানুষই এর সদ্ব্যবহার করে দেবে। এতে সিপিএম বা কংগ্রেসকে দোষারোপ করে লাভ নেই। এটাই শিক্ষিত দলের কাজ। তারা বিকল্প খোঁজে। পথ মসৃণ হবে না তৃণমূলের। যেভাবে দিনদিন তৃণমূলে ভাঙন বাড়ছে, তা প্রতিহত করতে পারবে না। এ ছাড়া বিজেপি কেন্দ্রের শাসকদল। তাদের ক্ষমতা অনেক। আর্থিক ও রাজনীতিতে বিজেপি সারা দেশে সুসংগঠিত। তারাও নানা কৌশল প্রয়োগ করবে। এ ছাড়াও গত পঞ্চায়েতে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে ফল পেয়েছে হাতেনাতে। এই ফল আরও ত্বরান্বিত হতে পারে আগামী পুরসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে। সুতরাং মমতাকে টেনে তোলা পিকের পক্ষে সম্ভব হবে না ।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.