শুধুমাত্র নিখাদ ভ্রমণপিপাসু মনোভাবে ১৮৩৩ তে দিনের আলো দেখা এক ভ্রমণ প্রতিষ্ঠান সুদীর্ঘ ৮৫ বছর অতিক্রম করে মহীরূহ বৃক্ষে পরিণত আজ। তা সে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেনের কলমে হোক বা ফেলুদার মগজাস্ত্র ‘কৈলাসে’ যাবার হোক না কেন, বাঙালির মননে ‘কুণ্ডু স্পেশ্যাল’ মানেই বাঙালিয়ানাকে চেটেপুটে উপভোগ করা। আস্ত একটা ট্রেনের কামরা বুক করে বেড়াতে যাওয়া। সঙ্গে ধাঁধুনি তো আছেই, সেইসঙ্গে লম্বা সফরে ধোপা–নাপিতও যাচ্ছেন আপনার সঙ্গে। বেড়াতে গিয়েই হয়েছে প্রেম, বিয়েও। কত অজানা কাহিনী এই কুণ্ডু স্পেশালকে ঘিরে। সেই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্ণধার সৌমিত্র কুণ্ডুর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার। তাঁর মুখোমুখি বেঙ্গল টাইমসের প্রতিনিধি অয়ন দাস।।
কুণ্ডুরা কেন ‘স্পেশ্যাল
সৌমিত্র: কুন্ডু স্পেশ্যাল আমাদের কাছে নিছক ব্যবসা নয়, আমাদের কাছে সততা, সেবা,আথিয়েতার প্রতিষ্ঠান। প্রথম থেকেই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হল কম খরচে মানুষকে ভালো জায়গায় রাখা,ভালো গাড়িতে নিয়ে যাওয়া, ভাল পরিষেবা দেওয়া। তাই আমরা মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি, তাঁরা আমাদের সঙ্গে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
কুণ্ডু ‘ভোজ’ স্পেশ্যাল
আগে একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিল-“আর কী চাই দাদা, সকালে লুচি, রাতে লুচি, এতো বাড়িতেও হয় না।’ আগে প্রতিদিন সকালে এমনকি চলন্ত ট্রেনেও গাওয়া ঘি-এর লুচি ভাজা হত। কিন্তু এখন রেলের নিয়মের কারণে কেবল হোটেলেই লুচি হয়। তবে মানুষ এখন অনেক বেশি স্বাস্থ্য-সচেতন, আর এখন অনেক নতুন নতুন মেনু থাকায় বিভিন্ন খাবার খেতে চান। আমাদের নিজস্ব রাঁধুনিরা থাকেন ট্যুরে, তাঁরাই যে যেমন খাবার পছন্দ করেন, তাই রান্না করেন। লুচি, বিরিয়ানি থেকে শুরু করে পোলাও, চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল যে ধরণের খাবারই মানুষ খেতে ভালোবাসেন তা তাঁরা কব্জি ডুবিয়ে খেতে পারেন। এমনকি যাঁদের সুগার আছে তাঁদের জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তবে আমাদের ‘খাবার’-এর ঐতিহ্যের স্বাদ চেটেপুটে নেবার জন্য কোনওরকম বাঁধন রাখেন না ওই কদিনের জন্য। এমনকি অনেক অ-বাঙালিরাও আমাদের সঙ্গে গিয়ে আমাদের সেই ‘ঐতিহ্যমণ্ডিত’ই খাবার তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন।
স্মৃতিমেদুর ‘ডানলপ পিলো’
আগে ট্রেনে শক্ত কাঠের গদিতে শোবার অসুবিধা যাতে না হয় তাই ‘ডানলপ পিলো’ দেওয়া হতো, কিন্তু এখন ট্রেনে শোবার ভালো বন্দোবস্ত থাকায় তা আর দেওয়া হয় না। তাছাড়া এখন সবাইকে হোটেলে রাখা হয়, আর মানুষও এখন ‘প্রাইভেসি’ পছন্দ করেন।
আমন্ত্রণ রইলো…..
বুদ্ধদেব গুহ তাঁর লেখায় একবার বলেছিলেন “মা আমার জন্য পাত্রী পাচ্ছিলেন না, তারপর কুণ্ডু স্পেশ্যালে বেড়াতে গেলেন, আর আমার বিয়ে হয়ে গেল।”
এরকম অনেকবারই হয়েছে কোনও ট্যুরে গিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, আবার অনেকের প্রেম হয়ে বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। বিয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে এসে যখন বলেন আপনাদের সঙ্গে গিয়ে পরিচয়, তখন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের সাফল্য নিয়ে গর্ব হয়। আমাদের বেশিরভাগ মানুষ বাঙালি হওয়ায় তাঁদের মধ্যে এই বাঙালি নস্টালজিয়াকে ঘিরে আত্মিক যোগসূত্র গড়ে ওঠে।
“পর্যটক থেমে থাকে না,এগিয়ে যায়…”.
আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন বয়সের মানুষ যান, বিভিন্ন আবহাওয়ায় তাঁরা অনেক সময়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেক্ষেত্রে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে দেখানো হয়, প্রয়োজনে হাসপাতালেও ভর্তি করানো হয়। আমাদের দুজন ম্যানেজারের অসুস্থ ব্যক্তির কাছে থাকা থেকে শুরু করে তাঁর পরিবারকে জানানো ও সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সমস্ত দায়-দায়িত্ব পালন করেন। আমরা অসুস্থতার জন্য কোনও অর্থ চাই না পরিজনদের থেকে। অপর ম্যানেজার অন্যান্য পর্যটকদের নিয়ে বাকি ট্যুর করেন। তবে অনেক সময়েই পর্যটকদের সেই স্বল্প আলাপেই এতটাই হৃদ্যতা গড়ে ওঠে তাঁরাও থেকে যান।
“আমরা আছি”
আমাদের পর্যটকদের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দেখভাল করি আমরা। প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে হেলিকপ্টারে হোক বা সে পুলিশি এসকর্ট করেই হোক মানুষদের পুরো নিরাপত্তাসহ ফিরিয়ে আনা হয়। সেই বিশেষ ব্যবস্থার জন্য আমরাই সব খরচ বহন করি।
হোর্ডিংয়ে ঢাকে না মুখ
বছর কয়েক আগে এক বৃদ্ধা দম্পতি ট্যুরের শেষে বলেছিলেন-‘আমাদের ছেলেমেয়েরাও যত না করেছে, তার থেকে বেশি তোমরা করেছ।”-এটাই তো আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপণ। আমরা বছরের পর বছর ধরে ভাল পরিষেবা প্রদান করেছি। এখন তো ট্রেন প্রায় লেট হয়, রেল থেকে খাবার দেয় না, আমাদের ম্যানেজাররা চলন্ত ট্রেনেই যথাসম্ভব খাবার জোগাড় করে মানুষকে দেন। এই বিশ্বাস, নিরাপত্তাই তো আমাদের বিজ্ঞাপণ।কুণ্ডু স্পেশ্যালে একবার গিয়ে কেউ থেমে যান না, এমনকি সব ট্যুর হয়ে গেলেও তাঁরা ট্যুর ‘রিপিট’ করেন আমাদের পরিষেবা, ঐতিহ্যকে উপভোগ করার জন্য।