জামশিদকে যেন শাপমুক্ত করে গেলেন মজিদ

তিন দশক ধরে একঝাঁক প্রশ্ন তাড়া করেছে জামশিদ নাসিরিকে। মজিদ কোথায়?‌ কেমন আছেন?‌ যোগাযোগ আছে?‌ বেঁচে আছেন তো?‌ প্রশ্নগুলো সহজ। উত্তরটা কিন্তু অজানা। হাঁপিয়ে উঠেছিলেন জামশিদ। মজিদের আগমনে তাঁর অন্তত শাপমুক্তি ঘটল। আর কেউ জিজ্ঞাসা করবে না মজিদ বেঁচে আছেন কিনা। মর্মস্পর্শী এক লেখা। লিখেছেন কুণাল দাশগুপ্ত।।

দীর্ঘদিন জ্বরাব্যধিতে জর্জরিত হওয়ার পর শাপমুক্তি ঘটেছিল শাম্বর। সূর্যদেবের উপাসনার মধ্য দিয়ে। এমনই ছিল শ্রীকৃষ্ণের অভিশাপ। রামচন্দ্রের স্পর্শে শাপমুক্তি হয়েছিল অহল্যার। পুরাণ ঘাটলে এমন অনেক শাপমুক্তির হদিশ পাওয়া যাবে।

জামশিদ নাসিরির জীবনে তো এমনটাই ঘটল। সেই ১৯৭৯ সালে সুদূর ইরান থেকে কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে এসেছিলেন পড়তে। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সঙ্গী ইরানের বিশ্বকাপ দলে থাকা মজিদ বাসকার। ওই আলিগড়ই জীবনে এনে দিল অন্য বাঁক। গড়ে উঠল তাঁদের ফুটবল জীবন। কলকাতা নামক শহরটা সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু চিত্রনাট্যে কী অদ্ভুত ভাবে ঢুকে গেল এই শহরটা।

jamsid3

১৯৮০ সাল। আলিগড় থেকে সটান কলকাতায়। তাও আবার ইস্টবেঙ্গলের মতো নামী ক্লাবে। সে বছর একঝাঁক ফুটবলার আচমকাই লাল হলুদ থেকে মহমেডানে চলে গিয়েছিলেন। স্বয়ং জামশিদই কি জানতেন যে তাঁর সঙ্গী মজিদ ময়দানে এমন করে ফুটবলের ফুল ফোটাবেন!‌ ইরানি ঝড়ে দুলে উঠল ভারতীয় ফুটবল। মজিদ–‌ঘোরে আক্রান্ত ফুটবলের মক্কা। এক মহানায়কের গমন। আরেক মহানায়কের আগমন। উত্তম বিয়োগের ক্ষতে কিছুটা তো মলম দিলেনই ইরানি নক্ষত্র। মনে আছে, ইডেনে ফেডারেশন কাপের দ্বিতীয় ম্যাচে মফতলাল বনাম ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখে ফিরছি। ইরানি জুটিরও ইস্টবেঙ্গলের হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচ। সঙ্গী যাঁরা মাঠ থেকে ফিরছিলেন, সবাই ওই নবকুমারের মতোই বলছিলেন, ‘‌আহা কী দেখিলাম, জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না।’‌ না না, তাঁরা তো ভোলেনইনি, এমন গল্পকথা গেঁথে গিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে, তাঁরাও মায়াবি মজিদেই আচ্ছন্ন রয়ে গিয়েছেন। তারই ফলশ্রুতিতে গণ হিস্টিরিয়ার মতো আবেগ আছড়ে পড়েছে মাঝরাতের এয়ারপোর্টে। শেষ কবে মাঝরাতে এভাবে জনপ্লাবন দেখেছে ভালবাসার এই শহর!

jamsid5

কে ভেবেছিল যে, ইরানি সূর্য হঠাৎ একদিন মাঝ আকাশেই মিলিয়ে যাবেন!‌ ওই সেই বিখ্যাত বাংলা গানের লাইন— ‘‌একদিন মাঝপথে পথটাও ফুরিয়ে যাবে’‌–‌র মতো। রবি ঠাকুরের রহমতের মতো মজিদও মায়া কাটিয়ে ‘‌অ্যায় মেরে প্যায়ারি ওয়াতন’‌ স্মরণ করে স্বদেশ পাড়ি দিলেন। রেখে গেলেন অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু জামশিদকে। রেখে গেলেন জামশিদের জন্য এক দুরূহ অভিশাপ।

মজিদ ফিরে গেলেও জামশিদ সংসার পেতে থেকে গিয়েছিলেন কলকাতাতেই। শেষ হল তাঁর ফুটবল জীবন। বেশ নামডাকের সঙ্গেই অবসর নিলেন জামশিদ। কিন্তু সঙ্গ ছাড়লেন না মজিদ। নয়ের দশকের শুরু থেকে আজ অব্দি ‘‌মজিদ কোথায়?‌’‌ ‘‌কেমন আছে মজিদ’‌ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমনকী ‘‌মজিদ বেঁচে আছেন তো?‌’‌ এমন প্রশ্নও শুনতে হয়েছে। বেচারা জামশিদ!‌ বয়ে নিয়ে চলেছিলেন এক নাছোড়বান্দা জিজ্ঞাসা চিহ্নকে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যতবারই দেখা হয়েছে, সেই একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়ে তাঁকে। একই উত্তর। ‘‌ইরানের খোয়েরশায়ারে।’‌ তারপর?‌ সব আচ্ছা, অস্পষ্ট।

jamsid4

ভারতকে ভালবেসে কী বিপদকেই না বেছে নিয়েছিলেন তিনি। বন্ধুবান্ধব, চেনা পরিচিত, সাংবাদিককূল। পিছনে পড়েছিল এই একই প্রশ্নের উত্তর পেতে। গত তিন দশকে যত প্রশ্ন শুনতে হয়েছে, সব মজিদকে ঘিরে। তাঁর নিজের কি কোনও পরিচয় নেই?‌ মজিদের বন্ধু, শুধুমাত্র এই পরিচয়েই তাঁকে সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে!‌ নিশ্চয় মনে মনে এমনটাই ভাবতেই এই আধা বাঙালি হয়ে যাওয়া মানুষটা। হয়ত, তিনি বলতেন, যোগাযোগ নেই। অনেকেই বিশ্বাস করত না। ভাবত, জামশিদ হয়ত বলতে চাইছেন না। আবার যাঁরা বিশ্বাস করতেন, তাঁরা ভাবতেন, এ কেমন বন্ধু!‌ মজিদের জন্যই তোমার এত নামডাক, অথচ তাঁর খোঁজও রাখো না!‌ বন্ধুত্বের নামে এ কী বিড়ম্বনা!‌ আর কাকে টানা তিন দশক ধরে বন্ধত্বের এই বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়েছে!‌

প্রায় তিন দশক পর ফুটবল ভক্তদের একবুক খিদে মিটিয়ে দিলেন মজিদ বাসকার। শাপমুক্ত করলেন জামশিদকে। আর রাস্তার মোড়ে হঠাৎ কেউ প্রশ্ন করবেন না, জামশিদদা, মজিদ কোথায়?‌ কেমন আছেন?‌ বেঁচে আছেন তো?‌

শাপমোচন, সেলুলয়েডের বাইরেও।

sejuti-invitation

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.