কিশোরকে দিয়ে যদি হিন্দি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ানো যেত!

রবীন্দ্র চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার বদলে রবীন্দ্রনাথকে বন্দী রাখার কাজটাই করেছে বিশ্বভারতী। তাই রবি ঠাকুর বিশ্বকবি তো দূরের কথা, জাতীয় কবিও হতে পারেননি। বাঙালি হয়েই থেকে গিয়েছেন। লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী। 
হরিয়ানার কোনও কিশোর কি রবি ঠাকুরের গান গেয়ে প্রেম নিবেদন করে?‌ মহারাষ্ট্রের কোনও বৃদ্ধ কি একাকী কোনও বিকেলে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে ওঠেন?‌ বা ধরুন, মণিপুরের কোনও যুবতী। প্রেম ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণায় কি রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার নতুন দিশা খুঁজে পান?‌
হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র বা মণিপুরের কথা টেনে আনা হল। তার জায়গায় ভারতের অন্যান্য রাজ্যের কথাও আসতে পারত। বয়স বা চরিত্রগুলোও বদলে যেতে পারত। পরিস্থিতিটাও হয়ত অন্যরকম হতে পারত। বিরহের বদলে পূর্বরাগ, প্রেমের বদলে যন্ত্রণা, একাকিত্বের বদলে জনসমুদ্র। সহজ কথা, তাঁদের চিন্তায়–‌চেতনায়–‌যাপনে রবি ঠাকুরের অস্তিত্ব কতটুকু?‌
একদিকে আমরা রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি বলি। অন্যদিকে তাঁকে ভারতীয় হতে দিইনি। বাংলার গণ্ডিতেই আটকে রেখেছি। রবি ঠাকুর অনেক আক্ষেপ করে একটা কবিতায় লিখেছিলেন, ‘‌রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি।’‌ কে জানত, তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও কথাটা এমনভাবে মিলে যাবে?‌ আমরা, গায়ের জোরে তাঁকে বাঙালি করেই রেখে দিয়েছি। জাতীয় কবি বা বিশ্বকবি হতে দিইনি। আর এই ব্যাপারে সবথেকে বেশি যদি কাউকে অভিযুক্ত করতে হয়, তবে সেটা বিশ্বভারতী। কবিগুরুর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানই তাঁর চিন্তা–‌চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার পথে সবথেকে বড় বাধা হয়ে উঠেছিল।
rabindranath10
জাপানের কোনও গবেষক হয়ত শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রনাথের পল্লি চিন্তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। আফ্রিকার কোনও তরুণ অধ্যাপক হয়ত তাঁর বিরহের গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। রুশ ভাষার কোনও কবি হয়ত তাঁর কবিতার অনুবাদ করেছেন। তাঁরা ডিগ্রি পেয়েছেন, স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাতে আমজনতার কী এল গেল?‌ হরিয়ানার সেই যুবকের কাছে বা মণিপুরের তরুণীর কাছে তো রবীন্দ্রনাথ পৌঁছতে পারেননি।
নিজের গান সম্পর্কে বেশ গর্ব ও ভাল লাগা ছিল বিশ্বকবির। কিছুটা গর্ব করেই বলেছিলেন, আমার অনেককিছুই হয়ত হারিয়ে যাবে। কিন্তু আমার গান বেঁচে থাকবে। স্বীকার করুন আর নাই করুন, বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন কিন্তু ওই গানের জন্যই। কিন্তু এই গানটাই কি আমরা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি সারা দেশে?‌ এখন কপিরাইট উঠে গেছে। যে খুশি নিজের মতো করে গাইতে পারছেন, রেকর্ড করতে পারছেন। কিন্তু দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে তাকে কার্যত রুদ্ধ করে রেখেছিল বিশ্বভারতী। কেউ রেকর্ড করতে চাইলে তাঁকে মিউজিক বোর্ডের পরীক্ষায় বসতে হবে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা মান্না দে–‌র গান স্বরলিপি মেনে হচ্ছে কিনা তার বিচার করবেন এমন কেউ, যার গান পাড়ার লোকেরাই হয়ত কখনও শোনেনি।
রুশ ভাষায় বা স্প্যানিশ ভাষা অনুবাদ হওয়ার থেকেও বেশি জরুরি ছিল হিন্দি ভাষায় অনুবাদ। ধরা যাক, জাভেদ আখতার বা গুলজারের মতো মানুষকে বলা হল, রবীন্দ্র সঙ্গীতের হিন্দি লিরিক লিখতে। এর জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিকও দেওয়া হল। সব গান না হোক, প্রাথমিকভাবে হয়ত দুশো বা তিনশো গানকে বাছা যেত। সেই অনুবাদগুলোকে সুর অক্ষুন্ন রেখে যদি রফি, লতা, কিশোদের দিয়ে গাওয়ানো যেত!‌ যদি সঙ্গীত পরিচালকদের অনুরোধ করা যেত হিন্দি ছবিতে এইসব গান ব্যবহার করুন। কিছুই কি ফল হত না?‌ কিশোর বা রফির কণ্ঠে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারত রবি ঠাকুরের গান। ধরা যাক, ইয়ারানা ছবির ছুঁ কর মেরে মনকো/‌ কিয়া তুনে ক্যা ইশারা। এই গানটা মনে মনে গান। তারপর গেয়ে দেখুন ‘‌তোমার হল শুরু, আমার হল সারা।’‌  অভিমান ছবির সেই গানটা— তেরে মেরে মিলন কিয়ে র‌্যায়না। তারপর মনে মনে সুর করে গান— যদি তারে নাই চিনি গো সেকি। কিশোরের গাওয়া আরও একটি গান— ম্যায় প্যাসা তু সাওন। এবার মনে মনে গান— এ মণিহার আমায় নাহি সাজে। এমন কত গানে রবীন্দ্র সুর লুকিয়ে আছে। সেগুলো জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু লোকে জানলই না এই গানগুলো রবীন্দ্রনাথের গানের আদলে তৈরি।
rabindranath thakur
এভাবেই যদি জনপ্রিয় গায়ককে ব্যবহার করা যেত, আলাদা অ্যালবাম করা যেত, তাহলে হরিয়ানার সেই কিশোর বা মণিপুরের সেই তরুণীর কাছে অনায়াসেই পৌঁছে যেতে পারত রবীন্দ্রসঙ্গীত। দরকার হলে এইচএমভি বা এই জাতীয় রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তিও করা যেত। এতে গানগুলোও জনপ্রিয় হত। বিশ্বভারতীর ভাঁড়ারে কিছু অর্থও আসত। কিন্তু বিশ্বভারতীর যাঁরা কর্তা ছিলেন, তাঁরা আদৌ এমনটা ভেবে ছিলেন?‌ তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে আগলে রাখতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
১৯৯১ সালেই কপিরাইট উঠে যাওয়ার কথা। বিশ্বভারতী আবেদন জানিয়ে আরও দশ বছর সেই মেয়াদ বাড়িয়ে নিল। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথকে আরও দশ বছর খাঁচায় বন্দী রাখল। অবশেষে সেই কপিরাইট শেষ হল ২০০১ সালে। তারপর থেকে যে কোনও ক্যাসেট কোম্পানি চাইলেই রবীন্দ্রনাথের গানের অ্যালবাম করতে পারেন। শান থেকে শানু, বাবুল থেকে হাবুল— অনেকেই করছেন। সেই ক্যাসেট কজন শুনছেন। দু একবার এফএমে বাজছে। হারিয়ে যাচ্ছে।
বড্ড দেরি করে ফেলেছে বিশ্বভারতী। ট্রেনটা মিস হয়ে গেছে। আজ আর চাইলেও সে উপায় নেই। অনুবাদ হয়ত করানো গেল। লতা এসে গিয়েছেন জীবনের পশ্চিম সীমান্তে। আপনার হাতে আর একটা কিশোর কুমার আছে?‌
Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.