‘‌দিদি’‌কে বলতে হবে কেন?‌

স্বরূপ গোস্বামী

গত কয়েকদিন ধরে বাংলার রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নতুন এক হুজুগ— দিদিকে বলো। তৃণমূল যে এটা নিয়ে মেতে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিরোধীরাও এটা নিয়েই চর্চায় ব্যস্ত। মূলস্রোত মিডিয়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, অফিস থেকে চায়ের দোকান সর্বত্রই জোর চর্চা।

জেলায় জেলায় তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীরা সাদা রঙের টি শার্ট পরে প্রেস কনফারেন্স করছেন। মিছিল করছেন। গায়ে লেখা ‘‌দিদিকে বলো’‌। গেঞ্জিতে লেখা ফোন নম্বর। দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা ফোন নম্বর লেখা টি শার্ট পরে মিছিল করছেন। একবারও বুঝছেন না এটা তাঁদের পক্ষে কতটা অপমানজনক।

১)‌ প্রথম আপত্তি হল সম্বোধনে। দিদিকে বলো। তার মানে, সবাইকে ‘‌তুমি’ বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। যাঁরা ফোন করবেন, তাঁদের কাউকেই ‘‌আপনি’‌ সম্বোধন করা হচ্ছে না। ‌সত্তর–‌আশি বছরের প্রবীণরাও পড়ে যাচ্ছেন এই তালিকায়। তাঁদেরও অবলীলায় ‘‌তুমি’‌ বলে সম্বোধন। বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে যাঁদের ন্যূনতম যোগাযোগ আছে, তাঁরা বুঝবেন সার্বিকভাবে এই সম্বোধনটা কতটা অপমানজনক। একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিচারপিতকেও বলা হচ্ছে ‘‌তুমি’‌। কতটা স্পর্ধা থাকলে এমন স্লোগান তোলা যায়!‌

২)‌ দিদিকে বলো মানেটা কী?‌ যা সমস্যা, তা দিদিকেই জানাতে হবে। অর্থাৎ, পাড়ার রাস্তা খারাপ, কলে জল পড়ছে না, সব বলতে হবে দিদিকে। তাহলে পাড়ার কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত প্রধানরা কী জন্য আছেন?‌ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ, পুরসভা— এসবের কোনও ভূমিকা নেই?‌ ওসি, বিডিও, এসপি, ডিএম–‌দের কোনও ভূমিকা নেই?‌ এঁরা সবাই অপদার্থ, দিদি একাই যোগ্য— এরকম একটা বার্তা কি দেওয়া হচ্ছে না?‌

didike balo1

৩)‌ বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী–‌এঁদেরও কোনও ভূমিকা নেই। এঁরাও গেঞ্জি পরে, দাঁত কেলিয়ে বলে চলেছেন, দিদিকে বলো। অর্থাৎ, কার্যত মেনেই নিচ্ছেন, তাঁদের কোনও ভূমিকাই নেই। এলাকার সাধারণ সমস্যা মেটানোর ক্ষমতাও তাঁদের নেই। এমনকী শোনার যোগ্যতাও নেই। পাল্টা প্রশ্ন আসতেই পারে, দিদিকেই যদি বলব, তাহলে আপনি বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী হয়ে বসে আছেন কেন?‌ আপনার কাজটা তাহলে কী?‌ সাদা গেঞ্জি পরে ফোন নম্বর বিলি করা?‌ বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রীদের টেনে কোথায় নামালেন দলনেত্রী?‌

৪)‌ মুখ্যমন্ত্রীকেও পাল্টা প্রশ্ন করা যেতে পারে, সব যদি আপনাকেই বলতে হয়, তাহলে এমন অপদার্থদের বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী বানিয়েছেন কেন?‌ এমন লোকেদের পঞ্চায়েত প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বা জেলা পরিষদের সভাধিপতি বানিয়েছেন কেন?‌ মেনেই নিলাম, আপনি সব সমাধান করতে পারেন। কিন্তু আপনি এই অযোগ্য এবং অকর্মন্যদের নেত্রী। এটা ভেবে লজ্জা হয় না?‌

৫)‌ বলা হচ্ছে, সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলুন। প্রথম দিনেই নাকি দারুণ সাড়া। একদিনেই নাকি এক লক্ষের ওপর নাকি ফোন এসেছে। যদি সত্যিও হয়, তার মানে একদিনে এক লক্ষ লোক জানালেন, আপনার স্থানীয় নেতৃত্বের ওপর তাঁদের আস্থা নেই। প্রশাসনের ওপর তাঁদের আস্থা নেই। এটা খুব গৌরবের? এটা খুব বড়াই করার মতো বিষয়?‌

৬)‌ ‌প্রচারের ঢক্কানিনাদ এমনই, মুখ্যমন্ত্রী নাকি কথা বলবেন। অনেকে সেটা বিশ্বাসও করতে শুরু করেছেন। নেতা মন্ত্রীরাও বেমালুম এরকম আশ্বাস দিয়ে চলেছেন। কজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব?‌ হয়ত দু একজনকে কল ব্যাক করবেন। হয়ত দু একটা সমস্যার সমাধান হবে। হয়ত দু একটা ক্ষেত্রে ডি এম বা বিডিও–‌র কাছে নির্দেশ যাবে। গোটাটাই মিডিয়াকে সাক্ষী রেখে। লেজুড় মিডিয়া ধন্য ধন্য করবে। সেই ধন্য ধন্য রব দিয়ে এত এত মানুষের হতাশা সামাল দেওয়া যাবে তো?‌ হাজার হাজার মানুষ সমস্যা ও অভিযোগের কথা জানাবেন। লোকদেখানো দু একটা ছাড়া অধিকাংশেরই সমাধান হবে না। এই ক্ষোভ সামাল দিতে পারবেন তো?‌ এই প্রত্যাশা ব্যুমেরাং হয়ে উঠবে না তো?‌

mamata15

৭)‌ গ্রামে গ্রামে নাকি নেতারা রাত কাটাবেন। এটাও ব্যুমেরাং হতে পারে। লোকদেখানো রাত কাটানো হবে। ছবি তোলা হবে। কিন্তু ওইটুকুই। এর নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি পড়তে পারে। ধরা যাক, নেতা গ্রামে গেলেন। তাঁকে কারা ঘিরে থাকবেন?‌ একশ্রেণির ঠিকাদার, বিনা লড়াইয়ে জেতা পঞ্চায়েত মেম্বার, বুথ দখল করা স্থানীয় নেতা, ধমকে চমকে তোলা আদায় করা উঠতি মাতব্বর। যাঁদের ওপর রাগ করে মানুষ বিজেপিতে ভোট দিয়েছেন। মন্ত্রী, বিধায়কদের এই সফরে সাধারণ মানুষ ব্রাত্যই থেকে যাবেন। স্থানীয়, অবাঞ্ছিত লোকেরা নিজেদের নম্বর বাড়াবেন। ভিআইপির সঙ্গে ছবি তুলবেন। সেই ছবি ফেস বুকে আপলোড হবে। এসব দেখিয়ে তোলার রেট বাড়াবেন। সন্ধে হলেই অনেকের বিশেষ একটি বা দুটি ‘‌গুণ’‌ আছে। সেগুলি আড়াল রাখা বড়ই কঠিন। ‘‌গুরু, একটু হয়ে যাক’‌ বলার মতো লোকের অভাব নেই। শিষ্যদের আবদার গুরু আর কী করে ফেরাবেন!‌ সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। সেইসব ‘‌কীর্তিমান’‌দের গুণকীর্তন প্রকাশ হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

৮)‌ যাঁরা অভিযোগ জানাবেন, তাঁদের অভিযোগের সুরাহা হওয়া তো দূরের কথা। সেই অভিযোগকারীকে উল্টে হেনস্থা করা হবে না তো?‌ তাঁর পেছনেই পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হবে না তো?‌ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মূলস্রোত মিডিয়া হয়ত সেসব ছাপবে না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে চেপে রাখা বড্ড কঠিন।

৯)‌ ধরা যাক, কেউ কয়লা পাচার, বালি পাচার বা গরু পাচার নিয়ে অভিযোগ জানালেন। এর পেছনে কোন কোন মাতব্বর আছেন, তাঁদের নামও উল্লেখ করলেন। যে এলাকায় এসব হয়, সেই এলাকার মানুষ কিন্তু খুব ভাল করেই জানেন, এর পেছনে আসল মাথা কারা?‌ লাভের গুড় কোন কোন ঠিকানায় যায়, সেটা এখন ওপেন সিক্রেট। এই সমস্ত অভিযোগ যদি জমা হয়, মুখ্যমন্ত্রীর সাহস আছে ব্যবস্থা নেওয়ার!‌ কেন শিল্প আসছে না, কেন নিয়োগ হচ্ছে না, কেন চাকরি হচ্ছে না, এসব প্রশ্ন যদি আসে!‌

১০)‌ মানুষ তাঁর মনোভাব বলতে চেয়েছিলেন পঞ্চায়েত বা পুরভোটে। শোনা হয়নি। বরং, সেই মতামত যেন ভোটের বাক্সে জমা না হয়, গুন্ডা দিয়ে, পুলিশ দিয়ে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। গোটা ব্যাপারটাই বিশেষ একজনের ‘‌অনুপ্রেরণা’‌ ছাড়া সম্ভব ছিল না। বিধানসভায় বিধায়করা বলতে চেয়েছেন। বলতে দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ বাজেট গিলোটিনে পাঠানো হয়েছে। দলের সভায় দলের নেতা মন্ত্রীরাও কিছু বলতে পারেননি। একতরফা তিনিই বলে গেছেন। বাকি সবাইকে শুনে যেতে হয়েছে। আমলারাও সত্যিকারের সমস্যাটা বলার সাহস পাননি। ঘাড় নেড়ে ‘‌ইয়েস ম্যাডাম’‌ বলে গেছেন।

আসলে, শুনতে গেলেও ধৈর্য লাগে, শিক্ষা লাগে, সুস্থ রুচি লাগে, সদিচ্ছা লাগে। যার অনেককিছুই তাঁর নেই। সবচেয়ে বড় কথা, শুনতে গেলে, শোনার আন্তরিক ইচ্ছে লাগে। কোনও এক ভাড়াটে কর্পোরেটের বুদ্ধিতে শুভবুদ্ধি আসে না। সাময়িক একটা কৌশল বা চালাকি থাকতে পারে। চমক থাকতে পারে। এই চালাকি বা চমক ঠিক ধরা পড়ে যায়।

অনেকদিন আগে গৌতম দেব একটা কথা বলেছিলেন। মমতার দলে মমতাই সবথেকে বড় সম্পদ। একদিন উনিই সবথেকে বড় বোঝা হয়ে উঠবেন। ক্রমশ সেটাই হয়ে উঠছে। এই দেওয়াল লিখনটা এখনও তিনি পড়তে পারছেন না। স্থানীয় নেতারা নন, বিপর্যয়ের সবথেকে বড় কারণ তিনি নিজে, এই সহজ সত্যিটাই বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই, ভুল শোধরানোর কোনও সদিচ্ছাই নেই। বরং, ভুলের পরিসর বাড়ছে। নিজেকে ক্রমাগত হাসির খোরাক করে তুলছেন। নিশ্চিত থাকুন, সব বিপর্যয়ের দায় প্রশান্ত কিশোরের ঘাড়েই চাপানো হবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.