স্বরূপ গোস্বামী
মাস দুই আগের কথা। তখনও লোকসভা ভোটের ফল সামনে আসেনি। তিন দফা বা চার দফার ভোট হয়েছে। সুদূর উত্তরবঙ্গে চা–বাগান থেকে এক ম্যানেজারের ফোন। মহুয়া মৈত্রর ফোন নম্বর চাই।
কেন, কী দরকার?
কোনও ভনিতা না রেখেই বলে ফেলল, মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি। সেটাই ফোন করে জানাব।
হঠাৎ প্রেমে পড়ার কারণ?
— মিমি–নুসরত কিচ্ছু নয়। আসল সুন্দরী যদি কেউ হয়, তবে সে মহুয়া মৈত্রই। একটা গ্রামের মেয়ে। কী স্মার্ট। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে! ইংরেজিটাও ভালই বলছে। প্রেম করলে এমন মেয়ের সঙ্গেই করা উচিত।
— মহুয়া মৈত্র গ্রামের মেয়ে! কে বলল?
— কেন, ও তো শুনেছি করিমপুরের বিধায়ক।
— এটুকুই শুনেছো! ওর পড়াশোনা আমেরিকায়। চাকরি করত অস্ট্রেলিয়ায়। ওর স্বামী ব্রিটিশ। রাহুল গান্ধীর বিশেষ অনুরোধে ভারতে ফিরেছিল। রাহুলের ব্যক্তিগত বন্ধু। আর ইংরেজি? ও স্বপ্ন দেখে ইংরেজিতে। ও ভাবে ইংরেজিতে। বলার সময় বাংলায় অনুবাদ করে।
ম্যানেজারবাবু বেশ হতাশই হলেন।— সে কী! ব্রিটিশ স্বামী! ইংরাজিতে স্বপ্ন দেখে!
মনে হল, আরেকটু চমক দেওয়া যাক। বললাম, তুমি তো চা–জগতের লোক। ইলা পালচৌধুরিকে চেন? তাঁর নাতনি।
—সে কী ? ওঁদের তো বিশাল বাগান আছে। তাঁদের বংশধর! এ তাহলে গ্রাম্য মেয়ে নয়!
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর সেই ম্যানেজারবাবু বলে উঠল, আমি কান মুলছি। আমার কোনও ফোন নম্বর চাই না। ও আমার প্রেমিকা নয়। আমি আর ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব না। আজ থেকে মহুয়া মৈত্র আমার দিদি। দেখা হলে প্রণাম করে নেব।
চাইলে বলাই যেত, এই মহুয়া সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে বাংলার অন্যতম মুখ। বলাই যেত, এই মহুয়া বাবুল সুপ্রিয়র মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নামেও এফআইআর করেছেন। অর্ণব গোস্বামীর মতো বিশ্ববাচাল অ্যাঙ্কারকে উচিত শিক্ষা দিয়েচিল। বলাই যেত, সুপ্রিম কোর্টে এই মহুয়ার মামলার জেরেই কেন্দ্রীয় সরকারের লেজে গোবরে দশা হয়েছিল। বলাই যেত, একবার জিততে দাও, দেখবে এই মহুয়া মৈত্র সারা দেশে ঝড় তুলে দেবে।
****
মহুয়া জেতার পর চা–বাগানের সেই বন্ধুর সঙ্গে আর কথা হয়নি। এমনকী সংসদে দুরন্ত বক্তৃতার পরেও আর কথা হয়নি। এখন মহুয়া গোটা দেশেই চর্চিত নাম। সংসদটা যে অর্বাচীনদের খোঁয়াড় নয়, সংসদটা যে যথার্থই শিক্ষিতদের জায়গা, প্রথম ভাষণেই সেটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলার এই নতুন সাংসদ। বলাই যায়, তোমাকে অভিবাদন, নবাগতা।
তিনি ঠিক কী কী বলেছেন, তা সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ভাইরাল হয়ে গেছে। একজন নতুন সাংসদের প্রথম বক্তৃতাতেই বেশ নাজেহাল বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসা সরকার। যা হয়! লেজুড় টিভি চ্যানেল নেমে পড়ল আসরে। জোরদার প্রচার হল, তিনি নাকি আমেরিকার একটি কাগজ থেকে টুকেছেন। হ্যাঁ, ফ্যাসিজমের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে এক প্রাবন্ধিকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সংসদে তা রেকর্ডও আছে। ফ্যাসিজমের কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলি আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তাঁর মতো করে তুলে ধরেছিলেন। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে আপনি একমত হতে পারেন, নাও হতে পারেন। কিন্তু সুন্দর যুক্তির বিন্যাসে, সাবলীল শব্দচয়নে সুন্দরভাবে নিজের বক্তব্যকে উপস্থাপিত করেছেন। হল্লাবাজির সংসদের বিতর্কে নতুন মাত্রা এনেছেন। হ্যাঁ, এই উদ্ধৃতি দিতে গেলে লেখাপড়া লাগে, বাগ্মীতা লাগে, ভাষার প্রতি দখল লাগে। যা মহুয়ার আছে। যা লোকসভার অধিকাংশ সদস্যের নেই। অন্যের উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে না, রেফারেন্স দেওয়া যাবে না, এমন ফতোয়া সংসদে কবে চালু হল!
একসময় কারা এই বাংলা থেকে সংসদে যেতেন? হীরেণ মুখার্জি, ত্রিদিব চৌধুরি, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সোমনাথ চ্যাটার্জি, জ্যোতির্ময় বসু, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, প্রণব মুখার্জি, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। সারা দেশ কুর্নিশ করত বাংলার মেধাকে, বাগ্মীতাকে। তার বদলে এখন কারা যাচ্ছেন? এমনকী শেষ লোকসভায় সৌগত রায়, সুগত বসু, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহম্মদ সেলিম ছাড়া সংসদে কে তেমন ছাপ ফেলতে পেরেছেন? সন্ধ্যা রায়, তাপস পাল, শতাব্দী রায়, মুনমুন সেন, দেব, সৌমিত্র খাঁ, অনুপম হাজরা, প্রতিমা মণ্ডল, অপরূপা পোদ্দার, ইদ্রিশ আলি— এঁরা আমাদের রাজ্যের সাংসদ! মানটা নামতে নামতে এমন তলানিতে ঠেকেছে! ভাবতেও যেন লজ্জা হত। এবারেও যে সংসদের চেহারা খুব উজ্জ্বল, এমন নয়। সুগত বসুর মতো মানুষের বদলি হিসেবে গেছেন মিমি চক্রবর্তী। আমরা ভেবে নিয়েছিলাম, এটাই বোধ হয় সংসদের আসল ছবি।
অভিবাদন মহুয়া। সেই ধারণাটা ভেঙে দিলেন। সংসদের গরিমা কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিলেন। বাংলার হারিয়ে যাওয়া সম্মান কিছুটা হলেও ফিরে এল। একা মহুয়া অন্তত দশজন ভুলভাল সাংসদের লজ্জা ঢেকে দিতে পারেন।
অথচ, এই মহুয়ার দশ বছর আগেই সংসদে যাওয়ার কথা ছিল। দশ বছর আগেই কৃষ্ণনগর আসনটা মহুয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু তৃণমূল সুপ্রিমো রাজি হননি। কী মন্তব্য করেছিলেন, সে কথা না হয় নাই বা লিখলাম। বাধ্য হয়ে মহুয়াকে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলেই আশ্রয় খুঁজতে হল। ২০১১ বিধানসভায় টিকিট দিলেন না। এমনকী, ২০১৪ লোকসভাতেও টিকিট পেলেন না। তাঁর বদলে টিকিট পেলেন কে? ‘ঘরে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেওয়া’ সেই কৃতী সাংসদ তাপস পাল। নেত্রীর কাছে তখনও মহুয়া নয়, তাপস পালদের কদরই বেশি। ২০১৬ তে বিধানসভায় দেওয়া হল এমন আসনে (করিমপুর), যেখান থেকে জিতে আসা অনেকটা দক্ষিণ কলকাতায় বামেদের জিতে আসার মতোই অবিশ্বাস্য। মহুয়া সেই লড়াইয়েও জিতলেন। মন্ত্রীসভায় আনা হল না। যেটুকু সুযোগ পেলেন, নিজেকে সুন্দরভাবে মেলে ধরলেন।
এবার কৃষ্ণনগরে কোনওভাবেই আর তাপস পালকে দেওয়ার সুযোগ ছিল না। জেলার অন্য কোনও নেতাকে দিলেও ওই সিট বেরোতো না। অনেক রথী মহারথী হারলেও মহুয়া জিতে এলেন। সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের বয়স হয়েছে। তাঁদের পক্ষে আগের মতো সংসদীয় কাজে ততটা সক্রিয় থাকা মুশকিল। বাংলার মুখ হয়ে উঠতেই পারেন মহুয়া। এবার বাংলা থেকে যে ৪২ জন গেছেন, তাঁদের মধ্যে সেরা বাজি হয়ে উঠতে পারেন মহুয়াই।
কিন্তু এখানেই সংশয়। ২০০৯ এই তিনি লোকসভায় আসতে পারতেন। আসাটা পিছিয়ে গেল দশটা বছর। সবার উপরে–তে ছবি বিশ্বাসের মতো বলতেই পারতেন, ‘ফিরিয়ে দিন সেই দশটা বছর।’ এই দশটা বছরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত মহুয়া মৈত্রর নামটা। যে ইনিংসটা দশ বছর আগে শুরু হতে পারত, সেই ইনিংসটা শুরু হল দশ বছর পর। লোকসভায় তিনি যত গুরুত্ব পাবেন, দলের অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠবেন না তো! গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কগুলোয় তাঁকে বসিয়ে রাখার চেষ্টা শুরু হবে না তো? কারণ, তিনি যতটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন, তাঁর কাছে বাকিদের ঠিক ততটাই ম্লান মনে হবে। অন্য কেউ বেশি প্রচার বা বেশি গুরুত্ব পেয়ে গেলে, তাঁর কী দশা হয়, এমন অসংখ্য উদাহরণ তৃণমূলে রয়েছে। তাঁর যোগ্যতাই তাঁর অন্তরায় না হয়ে ওঠে।
আশঙ্কা সরিয়ে রেখে আশার দিকেই তাকানো যাক। নিজেকে আরও দারুণভাবে মেলে ধরুন মহুয়া। সংসদটা হল্লাবাজদের জায়গা নয়, সংসদটা মহুয়া মৈত্রদেরই জায়গা, এটা বুঝিয়ে দিন। বাকিরা কি মহুয়া মৈত্রকে দেখে কিছু শিখবেন! সে আশা না করাই ভাল। কারণ, চাইলেই মহুয়া মৈত্র হওয়া যায় না। সেই শিক্ষা, সেই বাগ্মীতা, সেই রাজনৈতিক চেতনা তড়িঘড়ি অর্জন করা যায় না। তবে মহুয়াকে দেখে তাঁরা হয়ত বুঝবেন, সাংসদ হতে গেলে এরকম যোগ্যতা নিয়েই আসতে হয়। দিদির টিকিটে বা মোদির হাওয়ায় ভোটে জেতা যায়। ভাতা পাওয়া যায়, ফ্ল্যাট পাওয়া যায়, এমপির প্যাড ব্যবহার করা যায়, বিমানে চড়া যায়, সংসদে সেলফি তোলা যায়, এলাকায় তোলা তোলা যায়। কিন্তু সাংসদ হয়ে ওঠা! মহুয়াকে দেখে ওঁরা অন্তত বুঝুন, দিল্লি বহু দূর।