এই ওয়াকআউট সত্যিই বিরক্তিকর হয়ে উঠছে

স্বরূপ গোস্বামী

বিধানসভা মানেই একটা চেনা ছবি। স্লোগান দিতে দিতে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন বাম বিধায়করা। কখনও কখনও বাম–‌কংগ্রেস একসঙ্গে। দুপুরদিকে, যখন বিশেষ খবর থাকে না, তখন এই দৃশ্যটা বিভিন্ন চ্যানেলে লাইভ দেখানো হয়। বিকেল হতে না হতেই ভ্যানিস হয়ে যায়। কারণ, তখন খবরটা গুরুত্বহীন হয়ে যায়। কাগজে আগে এই ওয়াক আউটের ছবি ছাপা হত। এখন তারাও আর তেমন গুরুত্ব দেয় না। কারণ, ব্যাপারটা গা–‌সওয়া হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, বেশ একঘেয়ে ও বিরক্তিকর হয়ে গেছে।

আগের পাঁচ বছর না হয় ছেড়েই দিলাম। মমতা সরকারের দ্বিতীয় পর্বে তিন বছর হয়ে গেল। এই দফাতেও রোজই কোনও না কোনও বাহানায় ওয়াক আউটকে একরকম রুটিনে পরিণত করে তুলেছেন বাম বিধায়করা। আর এই রুটিনটাই যেন হাস্যকর ও গুরুত্বহীন করে তুলছে বাম পরিষদীয় দলকে। সরকারের পারফরমেন্স কেমন, সে বিতর্কে নাই বা গেলাম। কিন্তু বিরোধী হিসেবে বাম বিধায়করা নিজেদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করলেন?‌ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বিরোধী হিসেবে তাঁরাও চূড়ান্তই ব্যর্থ। বিরোধিতা মানে চিৎকার করা বা হল্লা করা নয়। বিরোধীতা মানে সভা পন্ড করে দেওয়া নয়। বিরোধিতা মানে হল্লা করে বেরিয়ে যাওয়াও নয়। অথচ, এই সহজ পথটাই বারবার বেছে নিতে চাইছেন বাম বিধায়করা।

walk out

তৃণমূল যখন বিরোধী ছিল, তারা হইহল্লা করত। কিন্তু বিতর্কের সময় উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে বিতর্কটাও করতেন। তখন সংখ্যা গরিষ্ঠতা যতই বামেদের সঙ্গে থাক, বিতর্কে অনেক সময়ই এগিয়ে থাকতেন বিরোধীরা। সৌগত রায়ের যুক্তিনিষ্ঠ ও পরিসংখ্যানভিত্তিক আক্রমণ সামলাতে হিমশিম খেতে হত মন্ত্রীদের। বামেদের এই দলে এমন কোনও বিধায়ক আছেন যিনি দারুণ বিতর্ক করে সবার সমীহ আদায় করে নিয়েছেন?‌ না আছে প্রস্তুতি, না আছে যুক্তি। আছে শুধু হই হল্লা। এমন বিরোধী থাকলে শাসকরা সত্যিই খুব নিশ্চিন্ত থাকে।

মানছি, সরকার কোনও শিষ্টাচার মানছে না। মানছি, স্পিকার মশাই নির্লজ্জস্তরের পক্ষপাতিত্ব করছেন। মানছি, শাসকদলের অধিকাংশ বিধায়ক পরিষদীয় নিয়ম কানুন জানেনও না, মানেনও না। সুস্থ বিতর্ক করার মতো রাজনৈতিক শিক্ষাও নেই, তাই আগ্রহও নেই। মানছি, বিরোধীরা বলতে উঠলেই হই হই করে চিৎকার শুরু হয়ে যায়। তাই বলে বিরোধীরাও কি সেই অসভ্যতা আর চিৎকারের প্রতিযোগিতায় সামিল হবেন? সারা বছরে বিধানসভা চলে কদিন?‌ যে কটা দিন চলছে, সেই কটা দিনও এই মঞ্চটার সদ্ব্যবহার করা যায় না?‌ সেই কটা দিনও রোজ ওয়াক আউটের নামে ওয়াক ওভার দিতে হবে?‌ শাসকরা বিতর্ক এড়িয়ে যেতে চাইবে, সেটা স্বাভাবিক। তাই বলে বিরোধীরাও বিতর্ক এড়িয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাবেন?‌ বাইরে বেরিয়ে নকল বিধানসভার সস্তা নাটক করবেন?‌ আর প্রেস কর্নারে গিয়ে ক্ষোভ উগরে দেবেন?‌

বিধানসভার লড়াইটা একেবারেই অন্যরকম। এখানে মেঠো চিৎকার নয়, মেধা আর যুক্তির বিন্যাসটা বেশি জরুরি। এখানে একটা অন্যরকম চর্চার দরকার হয়, এই বোধটাই অনেকের নেই। সাধারণ বাজেট থেকে বিভাগীয় বাজেট, রাজ্যপালের ভাষণ থেকে বিলের আলোচনা, প্রশ্নোত্তর থেকে উল্লেখপর্ব, জিরো আওয়ার থেকে বেসরকারি বিল, পয়েন্ট অফ অর্ডার থেকে কলিং অ্যাটেনশন। কোনটা কীভাবে করতে হয়, কজন বিরোধী বিধায়ক জানেন?‌ শেখানোর চেষ্টা হয়েছে?‌ অথচ এগুলো যদি ঠিকঠাক প্রয়োগ করা যেত, একটা দারুণ ছাপ ফেলা যেত। ওই তিরিশজন নিয়েও সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলা যেত, বিকল্প দিশা দেখানো যেত। সব দলেই এমন অনেক প্রাক্তন বিধায়ক আছেন, যাঁদের কাছে এগুলো শিখে নেওয়া যেত। অতীতের নানা কার্য বিবরণী নিয়ে অ্যাসেম্বলি প্রসিডিংস বেরোয়। কজন সেই পাতা উল্টে দেখেছেন?‌ বিধানসভার ভেতর অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি আছে। কজন গিয়েছেন সেখানে?‌ কজন জানেন এই লাইব্রেরির কথা?‌ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, সৌগত রায়, জয়নাল আবেদিনরা যখন বিরোধী ছিলেন, কীভাবে বিরোধিতা করতেন, একটু জানতে ইচ্ছে করে না?‌ এই ইচ্ছেটুকু থাকলেও অনেকটা শিখতে পারতেন। জানতে পারতেন, শিক্ষা বাজেট নিয়ে বলবেন বলে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মতো দুঁদে ব্যারিস্টার সারা রাত বাড়ি ফেরেননি। বিধানসভায় থেকেই নীরবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। পরেরদিন কী চমৎকার একটা বক্তৃতা করেছিলেন। শিক্ষাদপ্তরের হাফডজন মন্ত্রীর প্রায় ‘‌ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’‌ অবস্থা হয়েছিল। চাইলেই সেই বক্তৃতা লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়া যায়। কেউ পড়েছেন?‌ ৯৬–‌২০০৬ মানস ভুঁইয়া বিধায়ক ছিলেন না। কিন্তু যত্ন নিয়ে, পরিশ্রম করে কংগ্রেস বিধায়কদের ভাষণ তৈরি করে দিতেন। অনেক কংগ্রেস ও তৃণমূল বিধায়ককেও দেখেছি, পরেরদিন কীভাবে ভাষণ দেবেন, অভিজ্ঞ বাম বিধায়কদের কাছ থেকে রাতে তালিম নিয়ে যেতেন। এই বাম বিধায়কদের সেই শেখার আগ্রহটা আছে?‌ এমন কোনও প্রতিফলন কিন্তু গত আট বছরে চোখে পড়েনি।

assembly2

অন্যর কথা শোনাটাও একটা সহিষ্ণুতা। শোনার ধৈর্য থাকতে হয়। দুঃখের বিষয়, এই বিরোধীদের সেই সহিষ্ণুতাটুকুও নেই। শাসকদলের মন্ত্রী বা বিধায়করা যখন কথা বলছেন, অহেতুক চিৎকার করে যাচ্ছেন। এই চিৎকারের কী উল্টো ফল হতে পারে, ভেবে দেখেছেন?‌ আপনারা আছেন ৩৪ জন। তার মধ্যে হয়ত সভায় আসেন ২০ জন। চিৎকারের প্রতিযোগিতায় শাসকদলের সঙ্গে পারবেন?‌ সেখানে আছেন ২১০ জন (‌দল ভাঙিয়ে সংখ্যাটা আরও বেড়েছে)‌। অধিকাংশেরই তেমন বিদ্যে–‌বুদ্ধি নেই। শিষ্টাচার–‌সৌজন্যও নেই। বিতর্ক নয়, তাঁরা চিৎকারটাই পারেন। সেই দলে চিৎকার করলেই নম্বর বাড়ে। ববি হাকিম বলতে উঠলে বামেরা যদি চিৎকার করেন, সুজন চক্রবর্তী বলতে উঠলে শাসকদের থেকেও বিকট চিৎকার আসবে। স্পিকার বলতেই পারেন, আপনারাও চিৎকার করেছেন, তাই আপনাদের সময়েও চিৎকার হচ্ছে।

বরং, কৌশলটা উল্টো হতে পারত। এই বার্তাটাই দেওয়া যেত, আমাদের কেউ অন্যের বক্তৃতার সময় টুঁ শব্দটিও করবে না। আমাদের সময় যদি কোনও বাধা আসে, তাহলে বুঝতে হবে, স্পিকার তাঁর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। বুঝতে হবে, শাসকদলের কেউ স্পিকারকে মানেন না। এইভাবে বলটা স্পিকারের কোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া যেত। বলা যেতে পারত, হল্লা হলে বুঝতে হবে, বিশেষ কারও অনুপ্রেরণাতেই হচ্ছে। তখন তাদের পাল্টা চাপে ফেলা যেত। তখন যথার্থ যুক্তির লড়াইয়ের পরিসর তৈরি হতে পারত। এবং যে যুক্তির লড়াইয়ে ববি হাকিমের থেকে অশোক ভট্টাচার্য অনেক এগিয়ে থাকতেন। যেখানে পার্থ চ্যাটার্জির চেয়ে সুজন চক্রবর্তী অনেক এগিয়ে থাকতে পারতেন। তা না করে, আপনারা হল্লার লড়াইয়ে নেমেছেন। এরপরেও আপনাদের বিচক্ষণ বলা যায়?
কমরেড, বাইরের লড়াই আর ভেতরের লড়াই একেবারেই আলাদা। এই মঞ্চটাকে ব্যবহার করতে শিখুন। হল্লাবাজি আর ওয়াক আউটের সস্তা পথটা এবার ছাড়ুন।।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.