ডাক্তারদের দায়িত্ব এড়াতে কে বাধ্য করছেন!‌

এবার থেকে বিন্দুমাত্র ক্রিটিকাল পেশেন্ট দেখলেই বলবো, ‘‌অন্য ডাক্তার দেখান। আমি চিকিৎসা করতে পারবো না। এই রোগের চিকিৎসা আমার আয়ত্বের বাইরে।’‌ আয়ত্তের মধ্যে থাকলেও আমি কোনওমতেই ‘‌রিস্ক’‌ নেব না! পেশেন্ট পার্টি কেঁদে মরে গেলেও না!খারাপ ডাক্তার? ভীতু ডাক্তার? হিপোক্রেটিক ওথ ভুলে যাওয়া ডাক্তার? পালিয়ে যাওয়া ডাক্তার?
বেশ! আমি খারাপ, ভীতু, পালিয়ে যাওয়া ডাক্তারই হয়তো। তবু আমি ওই পেশেন্টকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে দায়িত্ব থেকে পালানোই ভাল।
কারণ ওই পেশেন্ট বাঁচানোর রিস্ক নিতে গিয়ে, আমার যাবতীয় ডাক্তারি জ্ঞান উজাড় করেও যদি সে মারা যায়, আর পেশেন্ট পার্টি আমায় মেরে আমার মাথার খুলি ফাটিয়ে দেয়? আমারও আপনজন আছে। বাবা মা, বউ ছেলে আছে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম! তার চেয়ে রেফার করে দেওয়াই ভাল। বিপদ ঘাড়ে নিয়ে লাভ নেই। ধরে নিন, আজ নীলরতনের ঘটনার পর একজন ডাক্তারের মনে এই চিন্তার জন্ম হল।
এবার ধরুন পেশেন্ট পার্টি আপনি। ওপরে বলা কথাগুলি ভেবে নিয়ে ধরুন পাঁচজন ডাক্তারই আপনাদের ‘‌পারবো না। অন্য ডাক্তার দেখুন’‌ বলে ঘুরিয়ে দিলেন। বিনা চিকিৎসায় আপনার পেশেন্ট মারা গেল! খবরদার আমাদের ডাক্তারদের দোষ দেবেন না! এর জন্য দায়ী আপনারা! আমাদের মনে মৃত্যুভয় ঢুকিয়েছেন আপনারা! পালিয়ে যাওয়া মানসিকতা তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র আপনাদের কর্মের ফলে! ফলভোগ আপনাদেরই করতে হবে!

nrs1

একজন অর্ধমৃত রোগী মারা যাবে। রোগীর বাড়ির লোকজন আবেগের বশে ডাক্তারের গায়ে হাত তুলবে। ডাক্তাররা মার খেয়ে অনশনে বসবে। সমাজ মিচকি মিচকি হাসবে। ‘‌কর না অনশন!ওই তো দম তোদের! আবার মরবে, আবার মারবো!’‌

দুদিন পরই- আবার মৃত্যু, আবার মার, আবার অনশন! আবার মিচকি হাসি। এই সাইকেল চলতেই থাকবে।

আর যদি মৌন মিছিল করেন? লোকজন ডাক্তারি পড়া মেয়েদের রাস্তায় হাঁটতে দেখে রসালো কথা বলবে, কিন্তু মিছিলের মানুষের সঙ্গে হাঁটবে না। লোকজন দেখবে না, ২৩–‌২৪ বছরের ছেলে মেয়েগুলি, যারা বাবা মায়ের আদরের সন্তান, যারা কোনওদিন বাবা মায়ের কাছে একটা চড়ও হয়তো খায়নি, তারা নিজেদের বাঁচাতে আজ রাস্তায় নামছে। লোকজন পাত্তাও দেবে না, ডাক্তারদের মিছিলে ১০ জন হাঁটল, নাকি ১০০০ জন। তারা দেখে সিপিএম না বিজেপি না তৃণমূল; তারা দেখে কুকুর মরলো, না রেপ হওয়া মেয়েটা হিন্দু না মুসলিম। লোকজন এটাই বলবে, ‘‌জানিস, ডাক্তারগুলো ডিউটি ফাঁকি দেয়, হাজার হাজার টাকা কামায়। ওদের মার খাওয়াই উচিত!’‌

সত্যিই কি আমরা মার খাবার জন্য এই পেশাকে ভালবেসেছিলাম? এই লেখাটি ছোট্ট। কিন্তু এই লেখা হয়তো ডাক্তারি ছাত্রদের গন্ডির মধ্যেই রয়ে যাবে।
কোনও অডাক্তার, অনার্সের ছাত্র-ছাত্রী, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল বা আর্কিটেক্ট এই পোস্ট পড়েও দেখবে না হয়তো। শেয়ার তো দূরের কথা। ডাক্তারদের মনের কথা ডাক্তাররাই বুকে চেপে প্রতি মুহূর্তে মার খাওয়ার ভয়ে থেকে চিকিৎসা করবেন। তারপর আসবে ‘‌আমি পারবো না, অন্য কোথাও যান’‌।

আমরা ডাক্তার! আমাদের নাকি অনেক টাকা! আমরা নাকি একাই সরকারের ভর্তুকির টাকায় পড়ি! তৈরি হোন। ‘‌আপনি বাঁচলে বাপের নাম’‌ চিন্তাধারা আমাদের মধ্যে গজিয়ে তুলেছে সমাজ। নিজের বাবা-মা যাতে সন্তানহারা না হয়, তাই বহু বাবা-মা কে সন্তানহারা করার মানসিকতা ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে। প্রস্তুত থাকুক সমাজ। কর্মফল ভুগতে হবেই আমজনতাকে।

পুঃ- এই লেখাটি শুধু মাত্র একটি লেখা। ব্যক্তিগত লেখা নয় কিন্তু এটি! বহু ডাক্তারের ক্ষোভ, কান্না, অভিমানের শুধু একটি প্রতিফলন বলতে পারেন একে। প্রতিটি ডাক্তারই চায়, তাঁদের প্রতিটি রোগী সুস্থ হোন। কোনও মায়ের কোল যেন খালি না হয়। কিন্তু এই সমাজ আজ এই মহান প্রচেষ্টায় আনছে সন্দেহ, আনছে স্বার্থপরতার বিষবাষ্প। তাই সমাজেরই দায়িত্ব, ডাক্তারদের তাদের যোগ্য লড়াইয়ের জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া। ‘‌আমার মাকে মেরে ফেলেছে, মার বানচোদকে।’‌ এই কথার বদলে ‘‌ডাক্তারবাবু আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আমার মা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়নি’‌ কথা অনেক ডাক্তারকে ঝুঁকি নিতে সাহস জোগায়। আপনার একটি গালাগাল, একটি থাপ্পড় ওই ডাক্তারের ঝুঁকি নেওয়ার সাহসকে ছিনিয়ে নিতে পারে।
কি মনে হয়, যে ডাক্তার একবার মার খেয়েছেন, উনি আর কোনোদিন ঝুঁকি নিয়ে কোনও পেশেন্টের অপারেশন করবেন? না! করবেন না।
মনে রাখবেন, একজন ডাক্তার কতটা ঝুঁকি নিয়ে রোগী দেখেন সেটি বোঝার ক্ষমতা আপনার সত্যিই নেই। যতই আপনি জ্বরের ওষুধ প্যারাসিটামল জানুন বা গুগল করে বোঝার চেষ্টা করুন, ডাক্তারের চেষ্টা, আর আপনার বোঝার দৌড়–‌কোনওদিনই সমান ছিল না, সমান হবেও না। সে চেষ্টা করতে গেলে পাঁচ বছর ডাক্তারি করুন, দু বছর সপ্তাহে তিনটে করে ২৪ ঘন্টা করুন, কম করে ১৫০০০ পেশেন্ট দেখুন। তবে হয়তো বুঝতে পারবেন। না পারলে চেষ্টাও করবেন না। ডাক্তারকে ডাক্তারের কাজ করতে দিন। হয়তো সমাজ বেঁচে যেতে পারে।

(‌এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে সম্প্রতি চিকিৎসকদের ওপর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও এক চিকিৎসকের লেখা। বেঙ্গল টাইমসের এক শুভাকাঙ্খী লেখাটি পাঠিয়েছেন। লেখাটি অনেক বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদেই বেঙ্গল টাইমসে প্রকাশ করা হল। সঠিক লেখকের নাম জানা নেই। তাই কারও নাম ছাপা হল না। সঠিক লেখকের নাম জানলে তাঁর নাম দিয়েই প্রকাশ হবে।)‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.