মমতা বোঝালেন, ভুলস্বীকার তাঁর অভিধানে নেই

স্বরূপ গোস্বামী

জ্যোতি বসু বেশ কয়েকবার ভুল স্বীকার করেছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও ব্যতিক্রম নন। তিনিও বারবার নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। শুধরে নেওয়ার কথা বলেছেন। এই নিয়ে কম কটাক্ষ হয়নি। বলা হয়, ‘‌বামপন্থীরা শুধু ভুল করে আর অনেকদিন পরে ভুল স্বীকার করে।’‌ চাইলেই সবাই ভুল স্বীকার করতে পারে না। ভুল স্বীকার করতে একটা চওড়া হৃদয় লাগে।
লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পর মমতা ব্যানার্জি কী কী বলতে পারেন, তা অনেক আগে থেকেই বোঝা গিয়েছিল। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে চেনেন, তাঁর নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন, ভুল স্বীকার তাঁর অভিধানে নেই। যে কোনও ব্যর্থতার দায় তিনি বরাবর অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে এসেছেন। এবারও তাই করলেন।
১)‌ হারলেই নির্বাচন কমিশনকে দোষারোপটা নতুন নয়। ২০০১ সালে হারার পরেও বলেছিলেন, ‘‌গিল পারচেজড’। যাঁরা সেই সময় রাজনীতির খোঁজখবর রাখতেন, তাঁদের মনে থাকার কথা। এবারও শুরু থেকেই নির্বাচন কমিশনের ওপর খড়্গহস্ত। হ্যাঁ, নির্বাচন কমিশন নিজেদের ভূমিকা ঠিকঠাক পালন করতে পারেনি। সেই কারণেই রাজ্যের শাসক দল নানা জায়গায় গুন্ডামি করতে পেরেছে। নির্বাচন কমিশন যদি শুরু থেকে শক্ত হাতে হাল ধরত, তাহলে তৃণমূল আরও চার–‌পাঁচটা কম আসন পেত।

২)‌ সিপিএম নাকি নিজের ভোট বিক্রি করে দিয়েছে। সিপিএম–‌কে নিয়ে এত চিন্তা কেন?‌ গত কয়েকবছর ধরেই বলে এসেছেন, সিপিএম সাইনবোর্ড হয়ে গেছে। তাদের কোনও লোক নেই। দূরবীন দিয়ে দেখতে হয়। সেই ভোট কোথায় গেল, তা নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কেন?‌ ভোটাররা কারও কেনা গোলাম নয়। সিপিএম যদি সব ভোট ধরে রাখতে পারত, তাহলে তো তৃণমূল ক্ষমতায় আসতেই পারত না। দিনের পর দিন মুখ্যমন্ত্রী সিপিএমের ভোট ভাঙানোর চেষ্টা করেননি?‌ সিপিএম–‌কে দুর্বল করার চেষ্টা করেননি?‌ এখন তার মাশুল তো দিতেই হবে।

mamata banerjee2

৩)‌ বিজেপিকে কে বাড়িয়েছে?‌ কে তাদের এই রাজ্যে পায়ের তলায় মাটি এনে দিয়েছে?‌ ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কার সঙ্গে জোট বেঁধেছিল?‌ ২০০৬ বিধানসভায় কার সঙ্গে জোট ছিল?‌ ১৯৯৮, ২০০৩, ২০০৮— পঞ্চায়েত নির্বাচনে কার সঙ্গে বিজেপির জোট ছিল?‌ কলকাতা পুরসভায় সুব্রত মুখার্জি যখন মেয়র ছিলেন, তখন ডেপুটি মেয়র কে ছিলেন?‌

৪)‌ অতীতের কথা থাক। ক্ষমতায় আসার পরেও মুখ্যমন্ত্রীই সাধ্যমতো বিজেপিকে অক্সিজেন দিয়েছেন। ২০১৪ তে বিজেপি ১৭ শতাংশ ভোট পেল। তাই তৃণমূল ৩৪ আসন পেল। কিন্তু দু বছর পরেই বিজেপি নেমে এল ১১ শতাংশে। বাম–‌কং জোট উঠে এল প্রায় ৪০ শতাংশে। এই ৪০ তো বিপজ্জনক। যে কোনও সময় আরও একটু বেড়ে গেলেই বিপদ। তার থেকে যার ১১, তাকে আরও একটু প্রাসঙ্গিক করতে হবে, অন্তত কুড়ির কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। তাহলেই তিনি নিরাপদ। বিভাজনের এমন অঙ্ক ছিল না? সেই কারণেই বিজেপিকে আক্রমণ করে গেছেন। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, লড়াইটা শুধু বিজেপির সঙ্গে। বাকিরা কেউ লড়াইয়ে নেই। ভেবেছিলেন, ১১ শতাংশ থেকে ২০–‌২২ শতাংশে টেনে তুলবেন। কিন্তু তা যে বেড়ে চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে, ভাবতে পারেননি। এখন সেই মাশুল তো দিতেই হবে।

৫)‌ পঞ্চায়েতে অধিকাংশ জেলায় বিরোধীদের প্রার্থী দিতে দিলেন না। ভোটের নামে কার্যত প্রহসন হল। বিরোধীরা জেতার পরেও নিস্তার নেই। জোর করে তৃণমূলে যোগ দেওয়ানো হল। তখন প্রশাসক হিসেবে কী করছিলেন?‌ গায়ের জোরে কোথাও আশি, কোথাও নব্বই শতাংশ ভোট পেয়েছেন। সেই সব এলাকায় তাহলে গো হারান হারলেন কেন?‌

৬)‌ পাহাড় আর জঙ্গল মহল। এই দুটো ছিল আপনার গর্বের বিজ্ঞাপন। পেটোয়া প্রচার মাধ্যমও সেই সাফল্যের ছবিই দেখিয়ে গেছে। পাহাড়ে হারলেন চার লাখ ভোটে। আর জঙ্গল মহলেও ধরাশায়ী। অন্যদের দোষারোপ না করে কেন মানুষ মুখ ফেরাল, ভেবেছেন?‌

৭)‌ বললেন, হয়ত বেশি কাজ করে ফেলেছি। তাই এবার দলটা করতে হবে। কাজের কাজটা ঠিকঠাক করলে আজ এই আক্ষেপ করতে হত না। সরকারি কাজ করতে গিয়েও অধিকাংশ জায়গায় দলই দেখেছেন। পাড়ার নর্দমা থেকে শুরু করে টয়লেট, সব নিজে উদ্বোধন করতে গেছেন। যেগুলো পঞ্চায়েতের করার কথা, যেগুলো পুরসভার করার কথা, সেগুলো নিজে ফিতে কেটে ফলক বসিয়ে বাহবা নিতে গেছেন। এত এত প্রশাসনিক বৈঠক। কোথাও বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের ডাকার প্রয়োজন মনে করেননি। এই নির্লজ্জ দলবাজি আপনি নিজেই করে গেছেন। আর প্রচার!‌ এমন নিম্নস্তরে নিয়ে গেছেন, আর কোনও রাজ্য পেরে উঠবে না। মুখ্যমন্ত্রীর কী বলা উচিত আর কী বলা উচিত নয়, সে সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে?‌ কলতলার ঝগড়ার স্তরে নিয়ে গেছেন। এগুলো শোনার পর কোনও সুস্থ রুচির মানুষ আপনার ওপর আস্থা রাখতে পারেন?‌ ‌

mamata

৮)‌ কোথাও কয়লা, কোথাও বালি, কোথাও গরু। কোন পথে পাচার হয়, কার কার কাছে ভাগের গুড় যায়, সবাই জানে। অথচ, আপনি জানেন না?‌ নিচুতলার কর্মী নয়, একেবারে উঁচুতলাতেই যাচ্ছে সেই বখরা। যদি না জানেন, তাহলে পুলিশমন্ত্রী থাকার কোনও নৈতিক অধিকার নেই। আর যদি জেনেও আটকাতে পারছেন না, তাহলে বুঝতে হবে আর আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই। তাহলে দোহাই, আর সততার বড়াই করবেন না।

৯)‌ যে সব জেলায় পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ — সব বিনা লড়াইয়ে জয় করেছেন, দেখা যাচ্ছে সেইসব এলাকায় ফল সবথেকে বেশি খারাপ। এরপরেও গলা চড়িয়ে অন্য রাজ্যের তুলনা টানছেন?‌ বিরোধীরা তো দূরের কথা, তৃণমূলের লোকেরাই তৃণমূলে ভোট দিতে পারেনি। এই ঘৃণা কতদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন?‌

১০)‌ যাকে সামান্যতম সুবিধা দিয়েছেন, তাকে কী কী মাশুল দিতে হয়েছে, সেই জানে। আপনার সভায় চড়া রোদে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা কারা?‌ তাঁদের কজন আপনাকে ভালবেসে এসেছে?‌ তাঁদের ভোট যদি গোনা হত, দেখা যেত, সেই ভোটের অর্ধেক ভোটও তৃণমূল পায়নি। আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি, প্যারা টিচার, সিভিক ভলান্টিয়ার, লোকশিল্পীদের কার্যত জোর করে আনা হয়েছে। কে আসছে, কে আসছে না, হিসেব নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও একশো দিনের কাজের জব কার্ড আটকে রেখে মিটিংয়ে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। ভোটের বাক্সে সেই রাগের, সেই ঘৃণার প্রতিফলন ঘটবে না?‌ চাইলে, আরও গোটা পঞ্চাশেক কারণ লেখা যায়। কিন্তু কী হবে?‌ তিনি বুঝলে তো!‌ যাঁরা বোঝার, তাঁরা ঠিক বুঝছেন। তাই, ভোটের বাক্সে হিসেব বুঝিয়েও দিচ্ছেন।
বুঝিয়ে দিলেন, ভুল শোধরানো আপনার কম্ম নয়। বুঝিয়ে দিলেন, ভুল স্বীকার করার মতো বুকের পাটা আপনার নেই। প্রকাশ্যে স্বীকার না করুন, মনে মনে উপলব্ধি করার মানসিকতাটুকুও নেই। অথচ, আপনার প্রথম বইয়ের নাম কিনা উপলব্ধি! আপনার উপলব্ধির দৌড় বেশ বোঝা গেল। ‌

আসলে, আপনার শুভাকাঙ্খীর সংখ্যা বড়ই কম। চারপাশে শুধুই পেটোয়াদের ভিড়। যে বুদ্ধিজীবীরা নানা উচ্ছিষ্টের আশায় গুণগান গেয়ে যায়, তাঁদের কারও সাহস হবে আপনার ভুল আপনাকে ধরিয়ে দেবে!‌ যে প্রশাসনকে নির্লজ্জ দলদাসে নামিয়ে এনেছেন, তাঁরা জানে ম্যাডাম কোনটা শুনতে পছন্দ করে। তারা বানিয়ে বানিয়ে বলে। যে মিডিয়াকে বিজ্ঞাপন দিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন, তাঁরাও তালে তাল দিয়ে যাওয়া হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙ। আর দলের যে লোকেরা ঘুরঘুর করে, তাঁরা একেকজন কী, সেটা না লেখাই ভাল। এঁদের চোখ দিয়েই আপনাকে বাংলা দেখতে হয়। সত্যিই, আপনি বড় একা। সত্যিই, আপনি বড় অসহায়।

Share

1 comment

Partha Pradeep Datta says:

I live in Assam. How can I mail my write-up in Bengali language for your perusal and printing in Bengal Times ? Can I mail in PDF format. If yes, would you kindly let me know your mail ID.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.