‌একটি মূর্তি ভাঙা এবং দশটি অপ্রিয় প্রশ্ন

সরল বিশ্বাস

মূর্তি কারা ভাঙল?‌ এই নিয়ে তরজা চলছেই। যদিও বাংলা মিডিয়া দেখলে মনে হবে, সেটা বিজেপিই ভেঙেছে। বাংলা মিডিয়ার ক্ষেত্রে সেটাই কাম্য। দিদিমণির বেঁধে দেওয়া সুরে গান গাইতেই সবাই অভ্যস্থ। ঠিক যেমন, জাতীয় মিডিয়া মোদিজির সুরে সুর মেলাতে ব্যস্ত। তবু কিছু প্রশ্ন উঠছে। বেঙ্গল টাইমসে তা তুলে ধরাই যায়।

১)‌ যে কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেই দেখা হয়, এর ফলে লাভ কার হচ্ছে?‌ মূর্তি ভাঙলে অন্তত বিজেপির কোনও লাভ নেই। ভোটের আগে মূর্তি ভেঙে মানুষকে ক্ষেপিয়ে দেবে, এত মূর্খ বিজেপি নয়। যদি বিজেপি ভেঙে থাকে, অবশ্যই জঘন্য অপরাধ। কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু যদি তাদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে অন্য কেউ ভেঙে থাকে, সেটা আরও বেশি নিন্দনীয়। তাদের আরও কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। শুধু যারা ভেঙেছে, তাদের নয়। যারা বাজার মাত করতে চাইল, তাদেরও।
২)‌ বিজেপি ভাঙলেও অন্তত পরিকল্পনা ছিল না, এটা পরিষ্কার। কিন্তু পরিকল্পনা না থাকলেও তো অনেককিছু হয়ে যায়। ধরে নিলাম, তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় কেউ কেউ করে ফেলেছে। কিন্তু তাৎক্ষিক উত্তেজনা কখন আসে?‌ ধরা যাক, বিদ্যাসাগর কলেজের ভেতর থেকে তৃণমূলের দিক থেকে ঢিল ছোঁড়া হচ্ছিল। সেক্ষেত্রে কলেজে ঢুকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে হতে পারে। কিন্তু তাহলে মূর্তি ভাঙার আগে তো সেই ছেলেগুলোকে পেটাতে হয়। তৃণমূলের লোকেরা অক্ষত রইল, অথচ মূর্তি ভেঙে গেল, এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।

vidyasagar college
৩)‌ মূর্তি তো ছিল ভেতরে। সেটা বাইরে এল কী করে?‌ রাগের মাথায় ভেঙে ফেললে, ভাঙা অংশগুলো সেখানেই পড়ে থাকার কথা। সেগুলো বাইরে কী করে এল?‌ ভেতরের জিনিস বাইরে এনে ভাঙল?‌ এই যুক্তিটাও যে তেমন দাঁড়াচ্ছে না।
৪)‌ সিসিটিভি। ইদানীং বিভিন্ন স্কুলেও সিসিটিভি থাকে। সেখানে বিদ্যাসাগর কলেজে থাকবে না, এ তো হতে পারে না। ফুটেজ কই?‌ যা হয়!‌ বলা হল, কলেজ ছুটি ছিল। তাই ক্যামেরা চালানো ছিল না। ছুটিই যদি ছিল, তাহলে ভেতরে এত লোক কী করছিল?‌ আর ছুটির সময়েই তো বেশি করে ক্যামেরা চালু থাকার কথা। যখন কেউ থাকবে না, তখন ক্যামেরা পাহারা দেবে, এই কারণেই তো লোকে সিসিটিভি লাগায়।
৫)‌ সত্যিই যদি বিজেপি ভাঙত, তাহলে ক্যামেরা খারাপ বললে পার পাওয়া যেত?‌ এতক্ষণে বেচারা প্রিন্সিপালকে হয়ত অ্যারেস্ট করা হত। কেন ক্যামেরা খারাপ, এই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কতবার যে তোপ দাগতেন, তার ঠিক নেই। প্রিন্সিপাল বিজেপির এজেন্ট, তাই টাকা নিয়ে সিসি ক্যামেরা বন্ধ রেখেছেন, এরকম অভিযোগ তুলে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিতেন।

vidyasagar3
৬)‌ সবকিছু ফেলে যেভাবে বিদ্যাসাগর নিয়ে তৃণমূল লাফিয়ে পড়ল, সেভাবে এই ঘটনার ফায়দা নিতে চাইল, তাতে সন্দেহটা আরও গাঢ় হয়।
৭)‌ মুখ্যমন্ত্রী বলে বসলেন, কী প্রমাণ আছে আমরা ভেঙেছি?‌ আমরা ভেঙেছি, সেটা প্রমাণ করুক। এই কথা লোকে কখন বলে?‌ অপরাধ বিজ্ঞানের প্রাথমিক নিয়মেই বলা আছে, যে বলবে প্রমাণ কই, বুঝতে হবে, সে কার্যত নিজের দোষ স্বীকার করেই নিয়েছে।
৮)‌ বাংলার মূলস্রোত মিডিয়া (‌যাদের বেশিরভাগই দিদিমণির ইশারায় চলে)‌ মূর্তিভাঙা নিয়ে যেভাবে সোচ্চার হল, সেটা কতটা স্বেচ্ছায়, আর কতটা ‘‌তাঁকে’‌ খুশি করতে, সে প্রশ্ন তো থাকেই। তৃণমূল কি সত্যিই এসব ভাঙচুরের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না?‌ বিধানসভা ভাঙচুরের ইতিহাস তো অন্য কথাই বলছে। নেত্রীর উপস্থিতিতে যেভাবে তাঁর বিধায়ক–‌বাহিনী বিধানসভা ভাঙচুর করেছিল, সেই ভিডিও চাইলেই দেখা যায়। তারপর থেকে কোনওদিন দুঃখপ্রকাশ করেছেন, এমনটাও শোনা যায়নি। অর্থাৎ, ভাঙচুরের এই ট্রাডিশনটা বেশ পুরনো। এবং অনেকেই তাতে বেশ অভ্যস্থ। এবং নেত্রী কখনও এসব কাণ্ডের জন্য ভাইদের ধমকেছে, এমন অভিযোগ নেই।
৯)‌ বেশ কয়েকটি অডিও ক্লিপিংস ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বরং, কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যই মনে হচ্ছে।
১০)‌ এবং সিট। বিশেষ তদন্তকারি দল। এখনও পর্যন্ত কোন কোন ঘটনায় সিট গঠন করা হয়েছে, এবং সেইসব তদন্তে সিটের ভূমিকা কী, একবার মনে করে দেখুন, তাহলেই পরিষ্কার। সারদার কথাই ভাবুন। সিটের কাজ কী ছিল?‌ সুপ্রিম কোর্টে সিবিআইয়ের অভিযোগ, সিটের কাজই ছিল যাবতীয় প্রমাণ লোপাট করা, অপরাধীদের আড়াল করা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, মূর্তি বিজেপি ভেঙেছে। এরপর সিট কেন, সিটের বাবাও অন্য কথা বলতে পারবে?‌ মুখ্যমন্ত্রী যখন একবার বলে ফেলেছেন, তখন সেটাই ধ্রুব সত্য। এর বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা সিটের নেই।

এই দশ দফা থেকে কিছুই হয়ত প্রমাণ হয় না। কিন্তু এই প্রশ্নগুলো উঠতেই পারে। এই অসঙ্গতিগুলো মানুষকে ভাবাতেই পারে। বিজেপি যদি মূর্তি ভাঙে, অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু যদি বিজেপির ঘাড়ে দোষ চাপাতে অন্য কেউ ভাঙে, সেটা আরও বেশি নিন্দনীয়। এটুকু বোঝা গেল, বিজেপি যদি ভেঙেও থাকে, সেটা তাৎক্ষণিক উত্তেজনায়। আর অন্য কেউ যদি ভেঙে থাকে, তবে সেটা পরিকল্পনা মাফিক। এবং এমন পরিকল্পনা নিচুস্তরে হতে পারে না।

সিট বা সিবিআই কেউই বিশ্বাসযোগ্য নয়। মানুষ নিজে নিজেই প্রশ্নগুলিকে সাজাক। নিজে নিজেই তদন্ত করুক। পাল্টা যুক্তিও থাকতে পারে। সেগুলোও উঠে আসুক। দু’‌রকম যুক্তির লড়াই হোক। মনে রাখবেন, সব বাঙালির ভেতরেই কিন্তু ফেলু মিত্তির বা ব্যোমকেশ বক্সী বাস করে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.