ভারতীরা সমঝোতার রাস্তা খুলে রাখছেন না তো!‌

কুকুরের মতো মারব, ছেলে ঢোকাবো— এসব কথা ছেড়ে আসল কথায় আসুন। বলুন কিষেনজির কী হল, বলুন কার নির্দেশে ফোন ট্যাপ হত?‌ মিথ্যে মামলা কার নির্দেশে, গরু–‌বালির আসল ভাগ কার কাছে যায়?‌ ভারতী ঘোষ যা যা জানেন, তার এক শতাংশও বলেননি। মুখ্যমন্ত্রী এস এম এস ফাঁসের হমকি দিচ্ছেন। ভারতী কেন চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন না?‌ ভবিষ্যতে সমঝোতার রাস্তা খোলা রাখছেন না তো?‌ লিখেছেন ধীমান সাহা।

গর্জন আর বর্ষণের মাঝে দুস্তর ব্যবধান। ফণীর ক্ষেত্রেই তো দেখলেন। গোটা বাংলা আতঙ্কিত। এই বুঝি ফণী আসছে। এই বুঝি গোটা বাংলা লন্ডভন্ড হয়ে গেল। বিরাট বিপর্যয় নেমে এল। কিন্তু কার্যত কিছুই হল না।
ভারতী ঘোষের ক্ষেত্রেও অনেকটা সেই রকম। তিনি হুঙ্কার ঝাড়লেন, ‘‌উত্তর প্রদেশ থেকে হাজারা ছেলে ঢোকাবো। বাড়ি থেকে বের করে কুকুরের মতো মারব।’‌ আসলে, পুলিশ সুপার থাকার সময়ে এভাবেই লোককে চমকেছেন। একে পুলিশ সুপার। তার ওপর মাথায় মুখ্যমন্ত্রীর হাত। তিনিই কার্যত তৃণমূলের জেলা সভাপতি হয়ে উঠেছিলেন। কে কোথায় টিকিট পাবে, কে ব্লক সভাপতি হবে, তিনিই নাকি ঠিক করতেন। আর মুখ্যমন্ত্রীও নাকি তাঁর কথাকেই সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন।

bharati ghosh4
সে যাই হোক, তিনি চাকরি ছেড়েছেন বহুদিন। বিজেপিতে যোগ দেওয়াও প্রায় ছমাস হয়ে গেল। এখনও পর্যন্ত এমন কোন কথাটা বলেছেন যেটা শাসকের অস্বস্তি বাড়াতে পারে?‌ তিনি বলছেন, রাজ্যে গণতন্ত্র নেই। তিনি বলছেন, রাজ্যে পুলিশ শাসকদের কথায় চলে। হায় রে!‌ এটা বলার জন্য ভারতী ঘোষ হওয়ার কী দরকার?‌ এটা তো চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া পাঁচুগোপালও জানে। যে ভারতী ঘোষ পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার অলিন্দে রইলেন, যিনি একটা জেলার অলিখিত জেলা সভাপতি রইলেন, যিনি এত এত কর্মকাণ্ডের নেত্রী, তাঁর কাছে ‘‌গণতন্ত্র নেই’‌ এই ভাষণ কে শুনতে চায়!‌ তিনি এমন কিছু বলবেন, যাতে শোরগোল পড়ে যাবে। তিনি এমন কিছু বলবেন, যেটা অন্যরা জানে না। কই, গত ছমাসে তেমন কিছুই তো পাওয়া যায়নি।

মুখ্যমন্ত্রী হুঙ্কার দিলেন, সীমা ছাড়াবেন না। এসপি থাকার সময় উনি যেসমস্ত এসএমএস আমাকে পাঠিয়েছিলেন, সেগুলো সামনে আনলেই আর কিছু বলতে হবে না।

মানছি, সরকারি চাকরির কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে। চাইলেও সব গোপন বিষয় বলা যায় না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে চ্যালেঞ্জটা ছুঁড়ে দিলেন, সেটা তো গ্রহণ করা যেত। ভারতী ঘোষ তো বলতেই পারতেন, হ্যাঁ, ফাঁস করুন।

bharati ghosh5

সেই এস এম এস মুখ্যমন্ত্রী যদি ফাঁস করতেন, কী হত?‌ এটা বোঝা যেত, ভারতী ঘোষ নানা অপকর্ম করে মুখ্যমন্ত্রীকে তার ফিরিস্তি শোনাচ্ছেন। অমুকের নামে মামলা দিয়েছি। অমুকের মামলা আলগা করে দিয়েছি। অমুককে আচ্ছা টাইট দিয়েছি। অমুক টাকা অমুক জায়গায় পাঠানো হয়েছে। অমুককে জোর করে তৃণমূলে এনেছি। ইত্যাদি ইত্যাদি। তাতে কার মুখ পুড়ত?‌ ভারতী এই কাজগুলো করেছেন, এটা যেমন বোঝা যেত, তেমনি কার নির্দেশে করেছেন, সেটাও তো পরিষ্কার হত। অপরাধ বিজ্ঞানে নিয়মই হল, যে যার জন্য অন্যায় কাজ করে, সে তাকে আগে জানায়। ভারতীও তেমনটাই করেছেন।

তাহলে ভারতী চ্যালেঞ্জটা নিলেন না কেন?‌ বলতেই তো পারতেন, আপনি প্রকাশ করুন। মুখ্যমন্ত্রী সবগুলো হয়ত প্রকাশ করতেন না। যেগুলোতে নিজের সুবিধা হত, সেগুলোই প্রকাশ করতেন। সেটাও মুখ্যমন্ত্রীকেই বেআব্রু করত। কারণ, ভারতী যদি অপকর্ম করে তার ফিরিস্তি দিয়েও থাকেন, তাহলে মুখ্যমন্ত্রী আগে তাঁকে থামাননি কেন?‌ ২০১২, ১৩, ১৪, ১৫ সালে এস এম এস পাঠানোর পরেও ২০১৮ পর্যন্ত এস পি করে রেখেছিলেন কেন?‌ কারণ, মুখ্যমন্ত্রীও চাইতেন, ভারতী এই কাজগুলোই করুন।

মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সুবিধামতো এস এম এস গুলো প্রকাশ করতেন। পরে ভারতীর সামনেও বলার সুযোগ থাকত, উনি আমার এস এম এস প্রকাশ করেছেন। এতে আমার সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারনা হচ্ছে। আমি তাঁর উত্তরগুলো প্রকাশ করতে চাই। এই মর্মে কোর্টে আবেদন জানানো যেত। দেখা যেত, কোর্ট কী বলে। নইলে, জনতার দরবারে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তাগুলোও ফাঁস করাই যেত। ভারতীর ফাঁস করা যদি অন্যায় হয়ে থাকে, তাহলে পদ ও গোপনীয়তার শপথ নেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর এস এম এস ফাঁসটা আরও বড় অন্যায়।

কিন্তু ভারতী চ্যালেঞ্জটা নিলেন না কেন?‌ কিষেনজিকে কীভাবে মারা হয়েছিল, ভারতীর কাছেই জানতে চাই। খড়গপুর পুরসভা কীভাবে তৃণমূলের দখলে এল, ভারতী ঘোষ বলুন। বামেদের কার কার নামে মিথ্যে মামলা দেওয়া হল, কার নির্দেশে, ভারতী ঘোষ বলুন। গরু, বালি খাদানের টাকা কোথায় যায়, ভারতীর সৎসাহস থাকলে বলুন। মানস ভুঁইয়ার নামে মিথ্যে খুনের মামলা তখন কে দিতে বলেছিলেন, সামনে আসুক। কার নির্দেশে কার কার টেলিফোন ট্যাপ করা হত, বলা হোক। সেই ট্যাপের রেকর্ডিং কাকে শোনানো হত, ভারতী সৎসাহস থাকলে সামনে আনুন।

কিন্তু এসব কোনও কিছুই সামনে আসবে না। কারণ, এসব কোনওকিছুই ভারতী ঘোষ বলবেন না। তিনি বলে যাবেন, গণতন্ত্র নেই। তিনি বলে যাবেন, পুলিশ কাজ করছে না। এসব কথা বলার জন্য অনেকে আছে। এগুলো বলার জন্য ভারতী ঘোষ হওয়ার দরকার নেই। তিনি যা জানেন, তিনি যা বলতে পারতেন, তার এক শতাংশও বলেননি। ভেবে দেখুন, ভবিষ্যতে সমঝোতার রাস্তা খোলা রাখছেন না তো?‌ ‌

***

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.