গৌতম দেব সমীপেষু

স্বরপ গোস্বামী

‌ভোটের বাজার। অথচ, আপনি নেই। একেবারেই মানা যাচ্ছে না।
দিন কয়েক আগে, সোশ্যাল সাইটে একটা ভিডিও। আপনি কিছু একটা বলছেন। এমনিতেই দূর থেকে মোবাইলে রেকর্ড করা, ফলে আওয়াজ তেমন স্পষ্ট নয়। আপনার কথাগুলোও বোধ হয় জড়িয়ে যাচ্ছিল। আগের সেই ঝাঁঝ নেই।
না থাকারই কথা। এক, বয়স। দুই, স্নায়ুর সমস্যা। তিন, দুর্ঘটনার পর আরও বেশি করে গৃহবন্দী। এই অবস্থায় স্বাভাবিক কথা বলাই কঠিন। বাইরে বেরোনো, জনসভায় বক্তৃতা তো আরও কঠিন। ‌তারকা প্রার্থীরা কে লেবুর সরবত খাচ্ছেন, কে লাল চা খাচ্ছেন, এসব নিয়ে টিভিতে, কাগজে দিনভর প্রচার। কিন্তু আপনার বাড়িতে এখন চ্যানেলের ক্যামেরাও হানা দেবে না।
অথচ, একটা সময় ছিল, যখন গৌতম দেব মানেই সুপারহিট। জনসভায় গৌতম দেব বক্তা মানে, আর কষ্ট করে লোক জোগাড় করতে হবে না। পিলপিল করে লোক ছুটে আসবে। টিভিতে আপনি মানেই বিরাট টিআরপি। মেয়েরাও সিরিয়াল দেখা বন্ধ করে আপনার ইন্টারভিউ শুনতেন। আপনাকে স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়ার সে কী হুড়োহুড়ি। তিন দিন আগে থেকে দিনে কুড়ি–‌তিরিশবার করে প্রোমো— অমুক দিন, সন্ধ্যে সাতটায় মুখোখুমি গৌতম দেব।
২০১০ এর আগে পর্যন্ত কজন আপনাকে চিনতেন?‌ আপনার কী দপ্তর, কজন জানতেন?‌ কজন আপনার বক্তৃতা শুনেছেন?‌ অথচ, ২০১১ তে আপনিই বামেদের সবথেকে বড় সেলিব্রিটি। মাত্র এক বছরে এতখানি পরিচিতি, এই বাংলায় আর কেউ পেয়েছেন?‌ জানা নেই। যে গৌতম দেব এত বছর মন্ত্রী থাকার পরেও ২০১০ এর আগে কোনও চ্যানেলের স্টুডিওতে যাননি, সেই গৌতম দেব মাত্র এক বছরেই এত বিখ্যাত‍‌!‌ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রের কাছে আগামী দিনে গবেষণার বিষয় হলেও হতে পারে।
মূলস্রোত থেকে দূরে সরে গেলে, তাঁকে নিয়ে মাতামাতি কমে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কী করে ভুলে যাব সেই দিনগুলোর কথা!‌ গোটা বাংলা ধরে নিয়েছে, রাজ্যে পরিবর্তন হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী থেকে মিডিয়াও হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে। বাম নেতা–‌কর্মীদের মধ্যেও যেন হেরে যাওয়ার মানসিকতা চলে এসেছে। একা আপনিই রুখে দিলেন হাওয়াটা। নতুন একটা স্বপ্ন দেখালেন। অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করল, অষ্টম বামফ্রন্ট হতেও পারে।

goutam deb5
নির্বাচনে ভরাডুবি হল ঠিকই, কিন্তু আপনি পেরেছিলেন একটা স্বপ্ন দেখাতে। এবার সেই স্বপ্ন দেখানো লোকটাকে খুব মিস করছি। এবার ভোটে বামেরা কটা আসন পেতে পারে?‌ অতিবড় আশাবাদীরাও একটা–‌দুটোর বাইরে ভাবতে পারছেন না। কেউ বলছেন, রায়গঞ্জ থাকবে তো?‌ কেউ বলছেন, এবার মুর্শিদাবাদ কি আসবে?‌ এর বাইরে তৃতীয় কেন্দ্রের কথা বলতে বা ভাবতে গিয়েও যেন দশবার হোঁচট খাচ্ছেন। পথে, বাসে, মেট্রোয় অনেক বামপন্থীকেই বলতে শুনছি, তৃণমূলকে হারাতে পারলে বিজেপিই পারবে। যেসব কেন্দ্রে বামেরা চার লাখের ওপর ভোট পেয়েছিল, সেসব কেন্দ্রে হয়ত দু লাখে নেমে আসবে। বাকি দু’‌লাখ যাবে কোথায়?‌ বেশিরভাগটাই যাবে বিজেপির বাক্সে। কোনও সংগঠন না থাকা সত্ত্বেও, নেতা না থাকা সত্ত্বেও, কাঠামো না থাকা সত্ত্বেও এই বাড়তি দেড়–‌দু লাখ ভোট তারা বাড়তি পেয়ে যাবে। নিজেদের ভোট+‌বামেদের ভোট+‌ বিক্ষুব্ধ তৃণমূলিদের ভোট। সবমিলিয়ে কোথাও কোথাও বিজেপি জিতেও যাবে। কোথাও দ্বিতীয় হবে।
এই প্রবণতা কোচবিহার থেকে পুরুলিয়া, সর্বত্র। এই প্রবণতাকে আটকানো বড় একটা চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যেই চার দফার ভোট হয়ে গেছে। বাকি তিন দফাতেও প্রবণতাটা বদলানোর সম্ভাবনা খুবই কম। মোদিকে আক্রমণ করেও লাভ হবে না। বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি নিয়ে সোচ্চার হয়েও লাভ নেই। দিদিভাই–‌মোদিভাই সেটিংয়ের তত্ত্ব শুনিয়েও লাভ নেই।
দরকার ছিল একটা স্বপ্ন দেখানোর। যিনি হাতে গুনে গুনে কুড়ি–‌বাইশটা আসনের কথা বলে যেতেন। যিনি জোর গলায় বলতে পারতেন, পুরুলিয়া জিতছি, ঘাটাল জিতছি, জয়নগর জিতছি, ঝাড়গ্রাম জিতছি, বোলপুর জিতছি। এভাবে বলতে বলতে একসময় এসে বলতেন, এখন বললে হয়ত অনেকে বিশ্বাস করবেন না, তবু লিখে নিন, ডায়মন্ড হারবারেও জিতছি। যিনি গুনে গুনে বলে যেতেন, অমুক অমুক আসনে তৃণমূল থার্ড হবে।
হয়ত পরে মিলত না। হয়ত পরে লোকে হাসাহাসি করত। করুক গে। কিন্তু ভোটের দিন পর্যন্ত এই বিশ্বাসের জমিটা তৈরি করা খুব দরকার ছিল। সারদা নিয়ে আপনি যখন সোচ্চার হয়েছিলেন, অনেকেই বিশ্বাস করেননি। কিন্তু আজ সিবিআই সেটাই বলছে, যেটা ছবছর আগে আপনি বলেছিলেন। সিপিআই পাঁচ বছরের চেষ্টায় যে জায়গায় পৌঁছেছে, আপনি মাত্র দুদিনে তার থেকে বেশি তথ্য তুলে ধরেছিলেন। আপনার হাতে পুলিশ নেই, ফোন ট্যাপ করার সুযোগ নেই। অন্যের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট দেখার সুযোগ নেই ট্রেন বা বিমানের প্যাসেঞ্জার্স লিস্ট দেখার সুযোগ নেই। জেরা করার সুযোগ নেই। জমির দলিল দেখার বা সিএজি রিপোর্ট দেখার সুযোগ নেই। তারপরেও আপনি মাত্র দুদিনে চিটফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্তকে এতটা এগিয়ে দিয়েছেন। সিবিআই পাঁচ বছর ধরে শুধু অশ্বডিম্ব প্রসব করে গেছে। কেন জানি না, মনে হয়, সিবিআইয়ের উচিত সপ্তাহে একদিন করে আপনার কাছে ক্লাস করা। তাহলে, ওঁরা হয়ত কিছুটা শিখতে পারতেন।
গত পাঁচ বছরে আপনার ঝুলিতে যে কত কেলেঙ্কারির ফাইল আছে, কে জানে!‌ একেকদিন একেকটা তাস ফেলতেন, শাসক দল বেআব্রু হয়ে যেত। এমন এমন নথি বের করে আনতেন, রাজ্য রাজনীতিতে ঝড় বয়ে যেত। সেদিন অনেকেই আপনার কথা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আজকের এই আবহে যা বলতেন, মানুষ বিশ্বাস করত। কারণ, সেদিন আপনি যা যা বলেছিলেন, আস্তে আস্তে সেগুলোই দিনের আলোয় সামনে আসছে। যাঁরা তৃণমূল করেন, তাঁরাই আজ তৃণমূলকে সবথেকে বেশি অবিশ্বাস করেন।
কমরেড, সভা হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে। সভা–‌মিছিলে লোকও হচ্ছে। ফেসবুকে বুদ্ধিদীপ্ত পোস্টও হচ্ছে। কিন্তু সব থেকেও কিছু যেন নেই। সেই স্বপ্ন দেখানো মানুষটা নেই। বিশ্বাস করুন, সেই স্বপ্ন দেখানো মানুষটাকে এবার খুবই দরকার ছিল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.