স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্ম ভয়াবহ

স্বরূপ গোস্বামী

এ কূল ও কূল দু’‌কূল হারানোর কথা হামেশাই শুনি। এই নির্বাচনে কারও কারও জীবনে হয়ত তেমনটাই ঘটতে চলেছে। কেউ অল্পের জন্য কোনও একটা কূল রক্ষা করবেন। কেউ আবার দুটো কূলই হারাবেন।

বিধানসভায় কংগ্রেসের হয়ে জিতে অনেকেই যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। জিতলেন তৃণমূল–‌বিরোধী ভোটে। জেতার পর মনে হল, উন্নয়নে শামিল হওয়া দরকার। তাই, পতাকা ধরে নিলেন। অথচ, বিধানসভা থেকে পদত্যাগও করলেন না। আমাদের স্পিকার মশাইও খুবই উদার। গত আট বছরে দলত্যাগ বিরোধী আইনে কাউকেই শাস্তি দিতে পারেননি। ফলে, বাইরে তৃণমূল, কাগজে কলমে বাম বা কংগ্রেস— এই লুকোচুরিটা অনেকদিন ধরেই চলছে।

কিন্তু এবার লোকসভা নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকজনকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। ১)‌ অমর সিং রাই দার্জিলিং বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করে দার্জিলিং লোকসভায় দাঁড়ালেন তৃণমূলের হয়ে। ২)‌ ইসলামপুরের কং বিধায়ক কানাইয়ালাল আগরওয়াল তৃণমূলের টিকিটে লড়ছেন রায়গঞ্জ থেকে। ৩)‌ কান্দির বিধায়ক অপূর্ব সরকার লড়ছেন বহরমপুর থেকে। ৪)‌ নওদার বিধায়ক আবু তাহের লড়ছেন মুর্শিদাবাদ থেকে।
অন্য দলেও এই উদাহরণ আছে। ১)‌ ভাটপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক বিজেপির টিকিটে লড়ছেন ব্যারাকপুর থেকে। ২)‌ হবিবপুরের সিপিএম বিধায়ক খগেন মুর্মু বিজেপির টিকিটে লড়ছেন মালদা উত্তর কেন্দ্র থেকে।

এই ছজনকেই পদত্যাগ করতে হয়েছে। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু মুশকিলটা হল, হঠাৎ করে বিধানসভার উপনির্বাচন ঘোষণা। ১৯ এবং ২০ মে উপনির্বাচনের দিনও জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তার ফলে, এঁদের অধিকাংশই পড়লেন মহা বিপদে। কীভাবে, একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

vote8

১)‌ কানাইয়ালাল আগরওয়াল। এবার রায়গঞ্জ থেকে জেতার আশা খুবই কম। হয়ত তৃতীয় স্থান পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এদিকে, ইসলামপুরও হাতছাড়া হওয়ার জোগাড়। স্ত্রী বা কন্যাকে প্রার্থী করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু উপনির্বাচনে প্রার্থী করা হল করিম চৌধুরিকে। করিম জিতবেন না হারবেন, বলা মুশকিল। কিন্তু ইসলামপুর থেকে কানাইয়ালালের আর বিধায়ক হওয়া হল না। একদিকে, সাংসদ হওয়াও মুশকিল। অন্যদিকে, বিধায়ক পদও হাতছাড়া। এ কূল, ও কূল দু কূল যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা।

২)‌ অপূর্ব সরকার। একসময় অধীরের ডান হাত বলা হত। ২০০৬ এ অতীশ সিনহার বিরুদ্ধে নির্দল হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন এই অপূর্বকে (‌ডেভিড)‌। কান্দি থেকে জিতিয়েও এনেছিলেন। পরপর তিনবার। করা হল পুরসভার চেয়ারম্যানও। সেই অপূর্বই কান্দি পুরসভা বাঁচাতে যোগ দিলেন তৃণমূলে। তাঁকেই দাঁড় করানো হল অধীরের বিরুদ্ধে। বিধানসভা থেকে পদত্যাগও করতে হল। জেতার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এদিকে, কান্দি উপনির্বাচনে ফের তাঁর নাম ঘোষণা করাও মুশকিল। তার মানে আগাম স্বীকার করে নেওয়া যে, অপূর্ব লোকসভায় হেরে যাচ্ছেন। ফলে, অপূর্বর নাম ঘোষণা করা যাবে না। অন্য কাউকেই দাঁড় করাতে হবে। সেই ভোটে নতুন প্রার্থী জিতবেন কিনা, পরে দেখা যাবে। মোট কথা, অপূর্বকে তখন শুধু পুরসভার চেয়ারম্যান হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কান্দি উপনির্বাচনে যদি তৃণমূল হারে, তবু রক্ষা। কারণ, ২০২১ এ দাঁড়ানোর একটা সুযোগ থাকবে। কিন্তু যদি তৃণমূল জেতে, তাহলে ২০২১–‌এও অনিশ্চিত। কী জানি, তখন হয়ত আবার কংগ্রেসে ফিরতে হবে।

৩)‌ আবু তাহের। নওদা থেকে টানা চারবার নির্বাচিত। ২০০১ এ তাঁকেও নির্দল হিসেবে জিতিয়ে এনেছিলেন অধীর। অপূর্ব ও আবু তাহের— এই দুজনের জন্য হাইকমান্ডের সঙ্গেও লড়ে গিয়েছিলেন অধীর। কিন্তু তাঁরাই কিনা নাম লেখালেন তৃণমূলে। আবু তাহেরকে প্রার্থী করা হয়েছে মুর্শিদাবাদে। ভোটও হয়ে গেল। জিতবেন কিনা, বলা মুশকিল। জিতলে এক কূল রক্ষা। এদিকে, নওদায় উপনির্বাচন। নিশ্চিতভাবেই অন্য কাউকে টিকিট দেওয়া হবে। ফলে, এই আসনটি আর আবু তাহেরের দখলে থাকছে না। যদি উপনির্বাচনে তৃণমূল জেতে, তাহলেও বিপদ। কারণ, তখন ২১ এ টিকিট পাওয়াই অনিশ্চিত। কী জানি, অপূর্বর মতো তাঁকেও হয়ত ফিরতে হবে কংগ্রেসে।

৪)‌ অমর সিং রাই। ছিলেন দার্জিলিংয়ের বিধায়ক। এবার পদত্যাগ করে লোকসভায় তৃণমূলের প্রার্থী। জিততেও পারেন। সেক্ষেত্রে প্রমোশন। কিন্তু হারলে আফশোস করা ছাড়া উপায় নেই।

৫)‌ বিজেপিতে যাঁরা গেলেন, তাঁদের মধ্যে অর্জুন সিং হয়ত জিততেও পারেন। সেক্ষেত্রে প্রমোশন। উপনির্বাচনে ভাটপাড়া থেকে সম্ভবত দাঁড় করাচ্ছেন ছেলেকে। ছেলে জিতলেও ভাটপাড়ায় অর্জুনের নিয়ন্ত্রণই রইল। আর যদি বিধানসভায় ছেলে হারেন, সেক্ষেত্রে ভাটপাড়া হাতছাড়া। যদি অর্জুন লোকসভাতেও হেরে যান, তাঁর ক্ষেত্রে লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা— তিন কূলই হারাতে হচ্ছে।

vote6

৬)‌ খগেন মুর্মু। বাম ছেড়ে বিজেপিতে। জয়ের তেমন সম্ভাবনা নেই। এদিকে, উপনির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হওয়ার সুযোগও নেই। ফলে, দুটোই হাতছাড়া। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে প্রার্থী হয়েছেন সৌমিত্র খাঁ, অনুপম হাজরা। তাঁদের হারও মোটামুটি নিশ্চিত।

৭)‌ সুব্রত মুখার্জি, মহুয়া মৈত্ররাও লোকসভায় লড়ছেন। কিন্তু তাঁদের হারানোর কিছু নেই। জিতলে সাংসদ। যদি একান্তই হেরে যান, বিধায়ক পদটা অন্তত বহাল থাকছে।

৮)‌ মানস ভুঁইয়া। রাজ্যসভার সাংসদ। দাঁড়িয়েছেন লোকসভায়। কিন্তু তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়নি। যদি মেদিনীপুরে হেরেও যান, অন্তত রাজ্যসভার সাংসদ থেকে যাবেন। তবে, দলবদলের জন্য লোকসভায় প্রাথমিক ধাক্কা খেতেই পারেন।

৯)‌ মালা রায়। কলকাতা পুরসভার চেয়ারম্যান। দাঁড়িয়েছেন লোকসভায়। তাঁকেও পদত্যাগ করতে হয়নি। দক্ষিণ কলকাতায় জিতবেন, ধরে নেওয়াই যায়। যদি বিরাট কোনও অঘটন ঘটে, যদি কোনও কারণে হেরেও যান, পুরসভার চেয়ারম্যান থাকতে বাধা নেই।

১০)‌ আরও একজন। বিনয় তামাং। ছিলেন জিটিএ প্রশাসনিক বোর্ডের চেয়ারম্যান। উপনির্বাচনে তিনিই প্রার্থী। জিতলে হয়ত ক্যাবিনেটে আনা হবে। অর্থাৎ, বড় প্রাপ্তিযোগ। কিন্তু হারলে উভয় সঙ্কট। কারণ, জিটিএ চেয়ারম্যান হিসেবে এর মধ্যেই অনীত থাপার নাম ঘোষণা হয়ে গেছে। ফলে, আর জিটিএ তে ফিরে যাওয়ার উপায়ও থাকছে না। আর উপনির্বাচনে হেরে গেলে এটা অন্তত পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, তিনি মোটেই গুরুংয়ের বিকল্প নন। পাহাড়ে পায়ের তলায় মোটেই শক্ত মাটি নেই। সেক্ষেত্রে ঘিসিং, গুরুংদের মতো আগামীদিনে তাঁকেও হয়ত পাহাড়ছাড়া হতে হবে।

এই দশ দফা থেকে কী বোঝা গেল?‌ দলবদলের কড়া মাশুল হয়ত অনেককে চোকাতে হবে। কারও হয়ত দু–‌কূলই থাকল। কারও হয়ত এক কূল রক্ষা হল। কিন্তু কারও কারও দু–‌কূল যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। মনে পড়ে যাচ্ছে সংস্কৃতের সেই পুরনো প্রবাদটা— স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়। পরধর্ম ভয়াবহ। বাংলার রাজনীতিতে যেভাবে আয়ারার–‌গয়ারামের সংস্কৃতি এসেছে, যেভাবে দিনে রাতে দলবদল হয়ে যাচ্ছে, কোথাও একটা মোক্ষম শিক্ষা পাওয়া খুব জরুরি। কে বলতে পারে, এই লোকসভা নির্বাচন হয়ত সেই কড়া বার্তাটাই দিয়ে যাবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.