‌কটা আসন?‌ মমতা নিজেও ঘোর সংশয়ে

সুগত রায়মজুমদার

এবারের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বেশ দুশ্চিন্তায়। যেভাবে সারা রাজ্যে মরিয়া হয়ে একা প্রচার করে বেড়াচ্ছেন, তাতে উদ্বেগটা প্রতিমুহূর্তেই বেরিয়ে আসছে। তিনি এটা প্রবলভাবে অনুমান করেছেন বলেই প্রচার করছেন ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ’ পাবই। এই শব্দ দুটি পশ্চিমবঙ্গবাসীদের মনে গেঁথে দিতে চাইছেন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটের নামে কী হয়েছে, তা সারা দেশেই ছড়িয়ে গেছে। প্রশাসন বা মিডিয়া যাই বলুক, আসল সত্যিটা কী, মানুষ কিন্তু হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছেন। বিরোধী দলগুলি একবছর আগের সেই স্মৃতিকে উসকে দেবে, সেটাই স্বাভাবিক। তৃণমূল যেভাবে বিরোধী সব দলগুলিকে আক্রমণ করছে, তাতে পরিষ্কার চিত্রটি ফুটে উঠছে, তৃণমূলেরও দিন শেষ হয়ে আসছে। প্রথম ৫ বছরে সাধারণ মানুষকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে মন কেড়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় ৫ বছরের শুরুতে মমতার মধ্যে একটা প্রবল আত্মতুষ্টি লক্ষ করা যাচ্ছে। তা থেকেই তিনি তাঁর পরিকল্পনা বদলেছেন। মানুষ কখনও এভাবে দেখতে চায়নি মমতাকে। কারণ অনেক লড়াই করেই তাঁর উত্থান হয়েছিল। সেই লড়াইয়ের ইতিহাস সম্পর্কে বিরোধীরাও মনে মনে হয়ত শ্রদ্ধাশীল। তাই তাঁর এই পথকে কখনই সমর্থন করতে পারেন না জনগণ। এই পথ অনুসরণ করলে সিপিএমের মতো তাঁরও হয়ত একই দশা হবে।
যে কোনও নির্বাচনে মানুষের প্রধান অগ্রাধিকার গণতন্ত্র। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেভাবে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন, তা সারা ভারতের মানুষ জানেন। সেজন্যই মমতা ব্যানার্জি এখন নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতেছেন। তিনি বুঝেছেন, তিনি যে জোট করতে চেয়েছিলেন বেশ কিছু ভারতীয় রাজনীতিতে পরিত্যক্ত নেতাদের নিয়ে, যাঁদের বেশিরভাগেরই ভারতীয় রাজনীতিতে কোনও ভিত নেই। তাঁদের সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারছেন না। এতে বিজেপির পথ আরও সুগম হবে। ওমর আবদুল্লা ও ফারুক আবদুল্লারও বর্তমা্‌নে কোনও জনভিত্তি নেই সাধারণের মধ্যে। ওমর সম্প্রতি একটি দেশবিরোধী ও ভারতীয় সংবিধান–বিরোধী বক্তব্য রেখেছিলেন। সেখানে তাঁর বক্তব্য ছিল, দেশে দু’জন প্রধানমন্ত্রী ও দু’জন রাষ্ট্রপতি চাই। যেটা কখনই ভারতে সম্ভব নয়। সেই নেতার সঙ্গে মমতার জোট হলে জোটের কী দশা হতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
তিনি যদি প্রথম থেকেই সর্বভারতীয় দল কংগ্রেসের মতো ঐতিহ্যশালী দলের সঙ্গে জোট করতেন, তা হলে হয়তো এই আশঙ্কার সম্মুখীন হতে হত না। তিনি যেখানেই প্রচারে যাচ্ছেন, সেখানেই প্রথমে ধর্মের রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছেন। যেমন, সর্বজনবিদিত বিজেপি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে। তিনি ভাবেন, বিজেপি হয়তো হিন্দু ভোটটা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেবে। এই আশঙ্কা থেকেই তাঁর দল রামনবমী ও হনুমান পুজো পালন করে একশ্রেণীর মানুষের কাছে ধর্মীয় গোঁড়ামির প্যাঁচে পড়ে যাচ্ছেন। নিয়ম করে সব মিটিংয়ে মন্ত্রপাঠ করছেন, যা হাসির খোরাক হয়ে উঠছে। আবার কখনও যখন মুসলিম অধ্যুষিত জায়গায় প্রচারে যাচ্ছেন, সেখানে বলছেন, অধীরের আরএসএস–সংযোগ আছে। আবার তাঁর রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব প্রণব মুখার্জির পুত্র অভিজিৎ মুখার্জির বিরুদ্ধেও আরএসএস যোগযোগের প্রচার সাধারণ মানু্ষ ধর্মীয় বিভাজনকেই ধরবেন। ফলে সারা ভারতের রাজনীতিতে তিনি একা হয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ভূমিকা কোথাও হিন্দু ভোট বিভাজন, কোথাওবা সংখ্যালুঘু ভোট বিভাজন— এটা মানুষ ভালভাবে নিতে পারছেন না। এ ছাড়াও যাঁরা জোটের সভায় এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে স্ট্যালিন কংগ্রেসকেই বেছে নেবেন। চন্দ্রবাবু নাইডুও তেমন নির্ভরতা দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। কারণ তিনি একসময় এনডিএ–র চেয়ারম্যানও ছিলেন। তিনিও যে কোনও সময় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারেন। বিহারে লালুপুত্র তেজস্বী যাদবও কংগ্রেসের সঙ্গে থাকতেই স্বচ্ছন্দ। একমাত্র ভরসা অখিলেশ যাদব। মায়াবতীও সুনিশ্চিত নন। কেজরিওয়ালও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট চাইছেন। যা মমতা ব্যানার্জি কখনই চান না। তাঁর লক্ষ্য, রিজিওনাল দলগুলির সঙ্গে জোট। বিজেপি বা কংগ্রেস নয়। এতে তাঁর একা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে। তিনি সম্প্রতি মোদি ও রাহুল দুজনের বিরোধিতা করছেন। সেজন্য রাহুল গান্ধীও সম্প্রতি মালদার ভাষণে তাঁকে তীব্র আক্রমণ করেন।

vote8
মমতা ব্যানার্জি রাজ্যে কন্যাশ্রী, উৎকর্ষ বাংলা, সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, কৃষকবন্ধুর মতো ভাল কিছু প্রকল্প করেছেন। এটা সকলেই জানেন। তিনি যে রাজ্যে নানা উন্নয়ন করেছেন, এতে কি কারও সংশয় আছে? সে উন্নয়ন চোখে দেখা যায়। অনেক বামপন্থী বন্ধুও মনে করেন, আগের সরকারের থেকেও অন্তত কাজের নিরিখে মমতা এগিয়ে আছেন। শুধু নিজের কাজ নিয়ে যদি ভোটে যেতেন, তাহলেও ভাল ফল হতে পারত। পঞ্চায়েতে ভোট হলেও কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত?‌ কিন্তু মানুষকে ভোট দিতেই দেওয়া হল না। অনেক জায়গায় এই অভিযোগ ছিল সিপিএমের বিরুদ্ধে। তারাও নানা জায়গায় আধিপত্য চালিয়েছিল। সেজন্য বিরক্ত হয়ে মানুষ পরিত্রাণ চেয়েছিল। মানুষ মমতা ব্যানার্জিকেই ভরসা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। সেই তিনিই যদি রাজ্যের সর্বশক্তিমান হয়ে মানুষের গণতন্ত্র হরণ করেন ও ধর্মীয় রাজনীতির ফয়দা নিতে চান, তা হলে কেন পশ্চিমবঙ্গের জনগণ তাঁকে আবার সুযোগ দেবেন? গণতন্ত্র হরণ হলে জনসধারণ তাঁকেও সরিয়ে দিতে দ্বিধা করবেন না। সুতরাং এই লোকসভা নির্বাচনে তিনি নিজেও শঙ্কিত, কটা আসন পাবেন। সেজন্যই তিনি ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ’ শব্দদুটি মানুষের মনে গেঁথে দিতে চাইছেন। কিন্তু মানুষ এখন যে তাঁর কাছ থেকেও মুক্তি চাইছেন, এই সত্যিটা কি তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন?‌ এই নির্বাচনে তার একটা ইঙ্গিত হয়ত পাওয়া যাবে।
তাঁর দল মা মাটি মানুষের দল। তাঁর কাছ থেকে মানুষ আশা করেন, তিনি মা মাটি মানুষকে শ্রদ্ধা করবেন। সেটাই যদি না রাখতে পারেন, কেন মানুষ তাঁকে পুনরায় রাজ্যের শাসনে আনতে চাইবেন? সুতরাং আগামী দিন তাঁর জন্য একটা কালো দিন অপেক্ষা করতে পারে। সেজন্য এখনই তাঁকে সতর্ক হতে হবে। তিনি বরং রাজ্যে মানুষের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও বেকারদের কর্মসংস্থান নিয়ে সচেতন হোন। এভাবে অত্যাচারিত হলে বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও জনগণ তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা করবেন না।

 

(‌ওপেন ফোরাম। বেঙ্গল টাইমসে পাঠকের মুক্ত মঞ্চ। মতামত লেখকের নিজস্ব। ‌তাঁবেদারির জন্য অনেক কাগজ, অনেক চ্যানেল আছে। কিন্তু বেঙ্গল টাইমসের সুর একটু স্বতন্ত্র। এখানে সবার সমালোচনা চলতে পারে। নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা উঠে আসে এই ওপেন ফোরামে। চাইলে, আপনিও আপনার যুক্তিনিষ্ঠ, সুচিন্তিত মতামত জানাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা:‌ bengaltimes.in@gmail.com)

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.