ধীমান দাশগুপ্ত
লঘু বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে গেলে আসল বিষয়গুলো অনেক সময় চাপা পড়ে যায়। অভিযোগের সংখ্যা বাড়াতে গেলে তার খেসারত অন্যভাবে দিতে হয়। সেটাই বারবার হচ্ছে বামেদের ক্ষেত্রে। নির্দিষ্ট কোনও বিষয়কে সামনে রেখে আন্দোলন করলে বা প্রতিবাদ করলে তার একটা আলাদা মূল্য আছে। কিন্তু একটা দাবির সঙ্গে আরও দশটা দাবি জুড়ে দিলে আসল দাবি কোনটা, সেটাই লোকে গুলিয়ে ফেলে। তখন আসল আন্দোলনটাও ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
অতি সম্প্রতি তার আরও একটা নমুনা পাওয়া গেল। প্রতিটি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকতে হবে, এই দাবি নানা মহল থেকেই উঠছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই বোঝা যাচ্ছে, কেন বাহিনী দরকার। এই আবহে বামেরাও সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি জানাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। দিল্লিতে বামেরা সেই দাবি জানালেনও। কিন্তু মুশকিলটা হল তার সঙ্গে আরও একগুচ্ছ দাবি জুড়ে দিলেন। ফলে, আসল বিষয়টাই লঘু হয়ে গেল।
বাঘিনী নামে একটি ছবি বাজারে আসতে চলেছে। অনেক মনে করতেই পারেন, এটি মমতা ব্যানার্জির বায়ো পিক। এই ছবিকে মমতাকে আরও মহান দেখানোর জন্য করা হয়েছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বামেরা এই ছবি আটকাতে নির্বাচন কমিশনের দরজায় খামোখা কড়া নাড়তে যাচ্ছেন কেন? এত বড় বড় বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে এই বিষয়টাকে নিয়ে এত হইচই করছেন কেন?
১) প্রথমত, এই ছবি মমতার ছায়া অবলম্বনে হলেও, একে বায়োপিক বলা যায় না। কেন্দ্রীয় চরিত্রে যিনি, তাঁর নাম মমতা নয়। পরিচালক দাবিও করেননি এটা বায়োপিক। কিছু মিল, কিছুটা কল্পনা, সব মিলিয়ে একটা ছবি। পরিচালকের এটুকু স্বাধীনতা থাকবে না? এটাকে আটকানোর এত উদ্যোগ কেন?
২) ছবিটা মমতাকে মহান দেখানোর জন্যই বানানো হয়েছে। হোক না, তাতে ক্ষতি কী? এই ছবির জন্য একটা ভোটও এদিক ওদিক হবে বলে বিশ্বাস করেন? এই ছবি ভোটে কোনও প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয়? তাহলে, খামোকা এর বিরোধীতা করতে যাচ্ছেন কেন?
৩) এই ছবি দেখবেন কারা? যাঁরা মমতাকে পছন্দ করেন, তাঁরা। তাঁরা তো এমনিতেই মমতার সমর্থক। নিশ্চয় বামেরা হলে গিয়ে এই ছবি দেখার জন্য ভিড় করবেন না!
৪) এরকম অনেক ছবি হলে আসে। নিঃশব্দে হল থেকে সরেও যায়। কেউ জানতেও পারে না। এটাও তেমনই একটা তৃতীয় শ্রেণির ছবি হতে চলেছে। কারণ, চাটুকারিতার উদ্দেশ্যে যে ছবি তৈরি হয়, দর্শকদের কাছে তার তেমন মূল্য থাকে না। এই ছবি এমনিতেই খুব অল্প লোক দেখবেন। তাহলে, বামেরা এই ছবির খামোখা পাবলিসিটির দায়িত্ব নিচ্ছেন কেন?
৫) মনমোহন সিংকে কটাক্ষ করে ছবি তৈরি হল। কজন দেখল? কী এমন প্রভাব তৈরি হল? বরং, সেটা বিজেপির নিম্নরুচিকেই প্রকট করল। উরি নিয়ে ছবি হল। সেখানেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। যাঁরা টিকিট কেটে হলে সিনেমা দেখতে যান, তাঁদের এত বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। কোনটা কোন উদ্দেশ্যে বানানো হচ্ছে, তাঁরা ঠিক বুঝতে পারেন।
৬) সহজ কথা, এই ছবি চলুক। গুটিকয় লোক দেখবেন। তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে! তাছাড়া, লোকের সময়ের দাম আছে। এই ছবি লোকাল কেবল বা পাড়ায় পাড়ায় দেখানো হলেও দেখার লোক পাওয়া যাবে না। যেভাবে জোর করে মিছিলে নিয়ে যেতে হয়, হয়ত সেরকমই জোর করে লোককে ধরে বেঁধে দেখাতে হবে। তাছাড়া, যাঁরা তৃণমূলের সমর্থক, তাঁদের অধিকাংশের এত ধৈর্য আছে বলে মনে হয়! তাঁরা হয়ত বলে বসবেন, ধুর, কোনও আইটেম সং নেই। ধুর, কোনও নাচগান নেই। এটা আবার সিনেমা নাকি?
৭) এমনিতেই এই দাবি ধোপে টিকবে না। কারণ, এক্ষেত্রে পরিচালকের যুক্তিটাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হবে। নির্বাচন কমিশন এই ছবির মুক্তিতে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করবে না। কোর্টে গিয়েও লাভ হবে না। ফালতু একটা দাবিকে নিয়ে লড়াই করে কোনও ফল পেলেন না। এতে ভাবমূর্তি খুব উজ্জ্বল হবে?
৮) তাহলে, এর বিরুদ্ধে একেবারে সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে সোচ্চার হতে হল কেন? এই ছবিটাকে উপেক্ষা করা যেত না? সেটাই তো সবথেকে বড় প্রতিবাদ। এইসব ইস্যু তুললে বুথে বুথে বাহিনীর দাবিটা অনেক লঘু হয়ে যাচ্ছে না? অবাধ ভোটের মৌলিক দাবিটা ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে না?
৯) ছবিটা না চললেই বা আপনার কী লাভ? আর চললেই বা কী ক্ষতি? বরং ছবিটা আটকানোর চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে কোন মুখে অনীক দত্তদের পাশে দাঁড়াবেন? কোন মুখে বলবেন, ছবি আটকানো উচিত নয়?
১০) অনেক বামপন্থী বন্ধু রেগে যেতেই পারেন। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন তো। যেখানে অবাধে ভোট লুঠ হচ্ছে। যেখানে বাহিনী পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে রাজ্য পুলিশ থেকে প্রশাসনের অপদার্থতা এভাবে প্রকট হয়ে উঠছে, সেখানে একটা ছবি বেরোবে কি বেরোবে না, তা নিয়ে নালিশ করা কি খুব জরুরি?