পয়লা বৈশাখ এলেই বাঙালিকে আর দেখতে হচ্ছে না। সে নিজেকে ‘গর্বিত বাঙালি’ প্রমাণ করেই ছাড়বে। অথচ, সারা বছর বাঙালিয়ানাকে শিকেয় তুলে রাখবে। বাংলা বই পড়বে না, বাংলা ছবি দেখবে না, বাংলা গান শুনবে না। কাজকর্মেও বাংলা ভাষাকে দূরে ঠেলে রাখবে। বাঙালি কি বছরে দুটো বা তিনটি দিন শুধু বাঙালি হয়ে উঠবে? লিখেছেন স্বরূপ গোস্বামী।।
পয়লা বৈশাখ মানেই বাঙালির আদিখ্যেতার শেষ নেই। এমনই আদিখ্যেতা দেখা যায় পঁচিশে বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি। যেন এই দুটো বা তিনটে দিন বাঙালি হলেই চলবে। বাকি দিনগুলোয় বাঙালি হওয়ার কোনও দায় নেই। এই একটা দিন ‘আ মরি বাংলা ভাষা’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘আমার সোনার বাংলা’— এমন কত বাংলা প্রেমের বন্যা বয়ে যায়।
এগুলো করুন। পয়লা বৈশাখে ধুতি পরুন। নববর্ষে বা জামাইষষ্ঠীতে ইলিশ খান। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘অমর একুশে’ মেসেজ ফরোয়ার্ড করুন। কিন্তু নিজেকে কতগুলো প্রশ্ন করুন। আপনার দৈনন্দিন জীবনে বাংলা কতটুকু? আপনার ছেলে বা নাতনি কোন মাধ্যমে পড়ে? নিশ্চয় বাংলা নয়। আপনার স্ত্রী বা বউমা হয়ত বলেন, ‘বাংলা আবার ভাষা নাকি’ ? আপনি নীরবে মেনে নিয়েছেন। কী জানি, আপনি নিজেও হয়ত মনে মনে এমনটাই বলছেন। মনে করে দেখুন তো, শেষ বাংলা বই কবে পড়েছেন? কয়েক মিনিট খবরের কাগজ উল্টে পাল্টে দেখা বা ফেসবুকে কয়েকটা পোস্ট পড়ে ভাবছেন আপনি দেশ উদ্ধার করে দিয়েছেন। কিন্তু টানা আধঘণ্টা পড়ার মতো ধৈর্য্য আপনার আছে তো? বইমেলায় তো গিয়েছিলেন। কটা বই কিনেছেন? যদি কিনেও থাকেন, কটা বই পড়েছেন? আচ্ছা, আপনি শেষ কবে বাংলায় কাউকে চিঠি লিখেছেন? শেষ কবে চিঠি পেয়েছেন? বাঙালি আগে বিজয়ায় একে–তাকে চিঠি পাঠাতো। এখন সে পাঠটুকুও উঠে গেছে। চিঠি লেখাও হয় না। তাই চিঠি আসেও না। অবশ্য, না লিখলে পাওয়ার আশা না করাই ভাল।
আপনার বাড়ির আশেপাশে নিশ্চয় লাইব্রেরি আছে। একসময় হয়ত সেখানে নামও লিখিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ কবে সেই লাইব্রেরিতে গিয়েছেন? এখন কার্ডটা রিনিউ করান তো? সেখান থেকে শেষ কবে বই তুলেছেন? বিয়েবাড়িতে আগে বই উপহার দেওয়ার চলছিল। এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে। ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজনে তো অনেক বাংলা বই পাওয়া যায়। কবে অর্ডার দিয়েছেন? এবার আসা যাক গান শোনায়। অনেককেই দেখা যায়, কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাস্তা পেরোচ্ছেন। বাসে, ট্রেনে, মেট্রোয়–সব জায়গায় একই ছবি। যেন কতই ব্যস্ত। কতই না সঙ্গীতবোদ্ধা। সারা সপ্তাহে কটা বাংলা গান শোনেন? কটা গান পুরো গাইতে পারবেন? বাড়িতে সিডি বা ডিভিডি প্লেয়ার নিশ্চয় আছে। শেষ কবে সেখানে বাংলা গান চালিয়েছেন? মাসে কটা নাটক দেখেন? মানছি, দৈনন্দিন ব্যস্ততায় হয়ত নাটক দেখার সময় থাকে না। তাই বলে, বছরে দশটা নাটক দেখতে পারেন না? এতখানি ব্যস্ত আপনি নন। হতে পারে, আপনার আগ্রহ নেই। না থাকতেই পারে। বাংলা সিনেমা। হলে গিয়ে শেষ কবে দেখেছেন? এই বছরেই তো একগুচ্ছ ভাল বাংলা ছবি এল। কটা দেখেছেন? কটা দেখার ইচ্ছে হয়েছে ? জিওর ফ্রি সিম পেয়েছেন। মনের সুখে অনেককিছুই ডাউনলোড করছেন। সেই তালিকায় কটা বাংলা ছবি আছে? পুরনো ছবিগুলো ডাউনলোড করতে ইচ্ছে হয় না?
বাংলা কম্পোজ করতে পারেন? হোয়াটসঅ্যাপে এখনও ইংরাজি হরফে লিখতে হয় কেন? বাংলা হরফে লেখা কিন্তু খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। চাইলেই অভ্যেস করা যায়। কজন এভাবে বাংলা লেখার বা শেখার চেষ্টা করেছি? ফেসবুকে দু চার লাইনের পোস্ট দিয়েই দায় শেষ। যেই দশলাইন লিখতে বলা হল, তখনই কঙ্কাল বেরিয়ে পড়বে। খাওয়া থেকে পোশাক, অলঙ্কার থেকে পুজো, সবকিছুই যেন অবাঙালিদের আদল এসে জেঁকে বসছে বাংলায়।
শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাও কেমন যেন দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। এই যে রামনবমী নিয়ে এত মিছিল বেরিয়ে গেল, বাংলার সংস্কৃতিতে এগুলো ছিল? কেউ রাম মিছিল তো কেউ হনুমান মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। এত প্রার্থীর এত প্রচার, কোনও মন্দির–মসজিদ বাদ পড়ছে না। কেন্দ্র–রাজ্য যেন প্রতিযোগিতা করে চলেছে। এত পুজোর ধুম এই বাংলায় ছিল? এত কাট আউটের বন্যা, সিনেমার অবুঝ তারকাদের ভোট ময়দানে নামিয়ে দেওয়া, এসব বাংলার রাজনীতিতে ছিল? এ দল থেকে ও দলে যাওয়া, টিকিট পেয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া— এটা যেন জলভাত হয়ে গেছে। আদর্শবোধ তো ছেড়ে দিন, ন্যূনতম চক্ষুলজ্জাটুকুও থাকছে না। মনে করে দেখুন তো, এক দশক আগেও এই সংস্কৃতি এই বাংলায় ছিল? যাঁরা গো বলয়ের এইসব সংস্কৃতি বাংলায় টেনে আনতে চাইছেন, তাঁরা আদৌ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালবাসেন তো?
বাঙালি যদি হতে হয়, তাহলে একদিন বা দুদিনের আদিখ্যেতা নয়। রোজ বাঙালি হয়ে উঠুন। বাংলাকে ভালবাসুন। বাংলা বই পড়ুন, গান শুনুন, ছবি দেখুন। বাংলা লিখতেও শিখুন। নইলে পয়লা বৈশাখের এই ‘বঙ্গপ্রেম’ বড্ড বেমানান মনে হবে।