ধীমান সাহা
কমিউনিস্ট পার্টির একটি বাঁধা বুলি হল, ব্যক্তির থেকে দল বড়। আদর্শগত দিক থেকে কথাটা সত্যি। কিন্তু শুধু আদর্শ দিয়ে যদি ভোটে জেতা যেত, তাহলে নির্বাচনী কৌশল বলে কোনও জিনিসের দরকার পড়ত না। ব্যক্তির যদি কোনও গুরুত্বই না থাকে, তাহলে কঠিন আসনে ওজনদার প্রার্থীকে দাঁড় করানো হত না।
সিপিএম পার্টির ওপরে অনেকের অনেক রাগ আছে। সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামের কথা বাদই দিন। পাড়ায় পাড়ায়, কলেজে–কলেজে, অফিসে–অফিসে সিপিএম দিনের পর দিন যে অকারণ মাতব্বরি করেছে, তার জন্য সিপিএম–কে অনেকেই দু চক্ষে দেখতে পারে না। এঁদের কাছে গিয়ে যদি বলা হয়, ‘ভোট দিন বাঁচতে তারা হাতুড়ি কাস্তে’, এঁরা মুখ বাঁকিয়ে চলে যাবেন।
যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রেও এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। এঁদের অনেকেই তৃণমূলের ওপর বীতশ্রদ্ধ হলেও সিপিএম–কে ভোট দেবেন না। দেবেন বিজেপি–কে। অথবা, ক্ষমা–ঘেন্না করে তৃণমূলকেই দেবেন।
এই পরিস্থিতিতেই একজন ওজনদার প্রার্থী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। দলের থেকে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। সারদা কান্ডে সারা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা গ্রামীণ এলাকা। সোনারপুর, বারুইপুরের গ্রামীণ অঞ্চলে সেই ক্ষত এখনও দগদগে। সেই ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কানে সিপিএম গ্রহণযোগ্য না হলেও বিকাশরঞ্জন নামটি অতি সহজেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কারণ, এই ব্যক্তি সারদা–কাণ্ডের সিবিআই তদন্তের দাবিতে বিনা পারিশ্রমিকে মামলা করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট থেকে জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। তাঁকে হারানোর কত চেষ্টাই না হয়েছিল। কোটি কোটি টাকা খরচ করে দিল্লির আইনজীবী ভাড়া করা হয়েছিল। বিনা পারিশ্রমিকের আইনজীবীর কাছে সবাইকে সেদিন হার মানতে হয়েছিল।
বিকাশরঞ্জন যখন সিবিআই তদন্তের জন্য মামলা করছিলেন, তখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা কী করছিলেন? মদন মিত্রের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে মিমি চক্রবর্তী মিছিলে হাঁটছিলেন। আর অনুপম হাজরা এই সেদিন পর্যন্ত তৃণমূলের এমপি ছিলেন। সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে তিনি লোকসভায় দিনের পর দিন হল্লা করে গেছেন। অর্থাৎ, সারদায় ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে তাঁরা কেউই দাঁড়াননি। তাঁরা দাঁড়িয়েছেন প্রতারকদের পাশে। নিশ্চিত থাকুন, আগামীদিনেও সেই ভূমিকাতেই তাঁদের দেখতে পাবেন।
তাই যাদবপুরের লড়াইটা সিপিএম বনাম তৃণমূল বনাম বিজেপি নয়। বিকাশ বনাম মিমি বনাম অনুপমের লড়াই। দল নয়, এই লড়াইয়ে ব্যক্তিই বড়। বিকাশরঞ্জন সারদা কাণ্ডের বিচার চেয়ে মামলা করেন। কর্মীদের ডিএ–র দাবিতে লড়াই করেন। পঞ্চায়েতে লাগামহীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করেন। এসএসসি–র দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেন। বাকিরা না বোঝেন রাজনীতি, না বোঝেন আইন, না বোঝেন নৈতিকতা।
ভোটকর্মীরা ঠিক করুন, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়া এইসমস্ত একঘেয়ে বুলি আওড়াবেন? নাকি চিটফান্ড বিরোধী লড়াইয়ের সৈনিক বিকাশরঞ্জনের কথা তুলে ধরবেন? আইনসভায় এই মানুষটার যাওয়া উচিত নাকি মিমি, অনুপমদের যাওয়া উচিত? একবার তৃণমূল বা বিজেপি সমর্থকদের কাছে এই প্রশ্নটা রাখুন তো। দেখুন তাঁরাও কেমন লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে, নইলে আবোল তাবোল বকতে শুরু করবে।
দলের নিশ্চয় কর্মসূচি, ইস্তেহার আছে। কিন্তু কিছুদিনের জন্য ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী’ ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী’, ‘ফ্যাসিবাদী শক্তি’ এইসমস্ত শব্দগুলোকে একটু বাড়ির লকারে বন্দি রাখুন। দ্বিধা–দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে ব্যক্তি বিকাশরঞ্জনকে তুলে ধরুন। আখেরে দলই লাভবান হবে। দল হিসেবে সাংগঠনিকভাবে তৃণমূল বা বিজেপি–র থেকে সিপিএম আদৌ এগিয়ে আছে কিনা জানি না। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে মিমি বা অনুপমদের থেকে বিকাশরঞ্জন হাজার মাইল এগিয়ে আছেন। এগিয়ে থাকা লোকটাকে আরেকটু এগিয়ে দিন।