ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত। অমরত্ব পাওয়া এই লাইনগুলি লিখেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। শতবর্ষ পেরিয়ে আসা পদাতিক কবি। একুশ বছর আগে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের মুহূর্ত তুলে ধরলেন ময়ূখ নস্কর
পত্রিকা অনেক রকমের হয়। দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক। কিন্তু এসবের বাইরেও কিছু পত্রিকা থাকে, যাঁদের বলা হয় ঐকিক পত্রিকা। এই ধরনের পত্রিকার একটিই সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রচুর পরিকল্পনা সত্ত্বেও দ্বিতীয় সংখ্যাটি কিছুতেই পৃথিবীর মুখ দেখে না। সে অর্থে এই পত্রিকাগুলিকে অদ্বিতীয় বলতে পারেন।
২০০১ সালে আমি এমনই একটি ঐকিক পত্রিকার সম্পাদনা করেছিলাম। পত্রিকা কেমন হয়েছিল তা নাই বা শুনলেন। একটা তথ্য শুনে যা বোঝার বুঝে নিন, পত্রিকার আরও দুজন সম্পাদক ছিল, তারা আমারই বন্ধু। কিন্তু লোকের সামনে বিড়ম্বনায় ফেলতে চাই না বলেই তাদের নাম উল্লেখ করছি না। আমার এই দ্বিধা দেখেই বুঝে নিন পত্রিকাটি কেমন হয়েছিল। আমিও নিজের বউ ছাড়া কারোর কাছে সেই পত্রিকা নিয়ে বাহাদুরি ফলাই না। আপনাদের কাছেও ফলাচ্ছি না। তবুও কথাগুলো বলতেই হল, কারণ আসলে যে কথাটা বলতে চাইছি, তার সঙ্গে পত্রিকাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কলকাতা ইউনিভার্সিটির রাখালদা তখনও বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে ছিলেন। তাঁর ক্যান্টিনে বসে বসেই সম্পাদনার কাজকর্ম হত। একদিন সবার মনে হল, এই পত্রিকা তো একদিন সাহিত্য জগতে মহিরুহ হয়ে উঠবে, তাই প্রথম থেকেই সাহিত্য জগতের মহীরুহদের লেখা এতে ছাপানো যাক। লেখা সংগ্রহের ব্যাপারে অবশ্য মন্দাক্রান্তা আর শ্রীজাতর (দুজনেই তখনও নেহাতই নবাগত) বেশি এগোতে পারিনি, কিন্তু সাক্ষাৎকার পেয়েছিলাম… সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের।
আর পদাধিকারের জোরে সুবিধাবাদের চরম নিদর্শন রেখে, সেই সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম আমি। সেই অভিজ্ঞতার বিবরণই আপনাদের শোনাতে বসেছি।
বন্ধুদের কাছে খুব বাহাদুরি করে বলেছিলাম, “আমার ঠাকুরদা হারানচন্দ্র নস্করের সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পরিচয় ছিল। তাঁর ডাকবাংলার ডায়রি বইতে ঠাকুরদার উল্লেখ আছে।“ কিন্তু মনে মনে জানি, বজবজ জুটমিলের দিনগুলো কোন সত্যযুগে কালের গর্ভে মিলিয়ে গেছে। ঠাকুরদা মারা গিয়ে বোধহয় মার্কসলোকে গমন করেছে। কবির বয়েসও নয় নয় করে ৮০ পেরিয়েছে। কোথাকার কে হারানদা, তা মনে আছে কি না কে জানে?
তাই যাবার আগে ঠ্যাং দুটো কাঁপতে লাগল। আমি, আমার বন্ধু স্বরূপ গোস্বামী (যে বেঙ্গলটাইমসে এই লেখাটি পড়ছেন, তার সম্পাদক) এবং আরেক বন্ধু সুস্মিত সরকারকে বললাম, যাবি?
কলেজ স্ট্রিটের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে শরৎ মুখার্জি রোডে যখন পৌঁছলাম, তখন বিকেল হয়ে গেছে। ঠিকানা মিলিয়ে যে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, স্বরূপ বলল, “এটা কি কবির বাড়ি বলে মনে হচ্ছে?” কড়া নাড়তে এক কিশোরী এসে দরজা খুলে দিল। বোধহয় কবির নাতনি। পরিচয় দিতে মেয়েটি বলল, “একটু বসুন।” স্বরূপ আবার ফিসফিস করে বলল, “এই মেয়েটির মধ্যে কি একজন সাম্যবাদী কবির নাতনি হবার কোনও লক্ষণ আছে?”
ঘরের ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধ সোফার উপরে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। মুখ দেওয়ালের দিকে। কিন্তু মাথাভর্তি কাশ ফুলের মতো চুল দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না তিনি কে। মেয়েটি বলল, “দাদু ও দাদু…” বলে আমাদের আগমন বার্তা জানাল। বৃদ্ধ ছেলেমানুষের মতো আর্তনাদ করে বললেন, “আঁ আঁ আমি এখন কথা বলব না।“ বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
অগত্যা ফিরে আসতে হল, পরদিন সকালে আসার আশ্বাস নিয়ে। ফিরে আসার সময় রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে এক রোমাঞ্চকর কাণ্ড হয়েছিল। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন থাক। বরং সেই রাতে বাড়ি ফিরে কী রোমাঞ্চকর কাণ্ড করেছিলাম তাই বলি।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুজপ্রতিম এক কবি লিখেছিলেন, “আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ, স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি।“ ঠিকই লিখেছিলেন। কিন্তু স্পর্ধারও তো একটা সীমা পরিসীমা থাকে! তখন আমার বয়স আঠারো পেরিয়ে মাত্র কয়েক ধাপ এগিয়েছে। আজ ভাবলে হতবাক হই, কোন স্পর্ধায় সুভাষ মুখোপাধায়ায়কে নিয়ে একটা আস্ত কবিতা লিখেছিলাম, তাঁর হাতে তুলে দেবার জন্য ? কবিতার কথায় পরে আসব, আগে কবি-সাক্ষাতের কথা সেরে নিই।
পরদিন সকালে স্বরূপের সময় হল না। আমি আর সুস্মিতই গেলাম। কবি তাঁর বারান্দার চেয়ারে গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে বসে আছেন। কানে গোঁজা একটি বিড়ি। ঘরের ভিতরে কী কী ছিল মনে নেই, এটুকু মনে পড়ছে, বিভিন্ন পশু পাখির ছবি ও নাম লেখা একটা চার্ট, যা স্কুলের বাচ্চাদের কাজে লাগে, টাঙানো ছিল। কেন কে জানে?
গতকালের সেই কিশোরী এসে বলল, “দাদু কানে শুনতে পায় না। যা বলার আছে, লিখে দেবেন।” সে কি? তা হলে গতকাল নাতনির কথা বুঝল কী করে? বুড়ো কি লিপ রিডিং জানে ? সুস্মিত বলল, “ওরে বুড়ো বুড়ো বলিস না। সেটাও হয়তো লিপ রিডিং দেখে বুঝে নেবে।
যাই হোক। কাগজে লিখলাম, “আমি বজবজের বুড়ো হারানদার নাতি।” তিনি বললেন, “ও আচ্ছা।” বললেন বটে, কিন্তু স্পষ্ট বুঝলাম, সৌজন্যের খাতিরে বলা। অতদিনের কথা কারও মনে থাকে? এবং আমি ভুল বুঝেছিলাম। নিজেই শুরু করলেন হারানদার কথা। আমার এক পিসি, আমার জন্মের ঢের আগে মারা গেছিল। তাঁর কথাও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মনে আছে।
কথা বলতে বলতে মনে একটু বল ভরসা পেলাম। গতকাল রাতের স্পর্ধাটা আবার একটু একটু করে ফিরে এল। তারপর করে ফেললাম সেই দুঃসাহসিক কাজ। কথায় বলে, দেবদূতরা যে কাজ করতে ভয় পায়, মূর্খরা সেই কাজ অনায়াসে করে ফেলে। আমি মূর্খ নিঃসন্দেহে, নইলে তাঁর হাতে স্বরচিত কবিতা তুলে দিতে পারি?
কবিতাটা শুনবেন ? না থাক! লোক হাসিয়ে লাভ নেই। সান্ত্বনা একটাই, তিনি তরুসম সহিষ্ণুতা দেখিয়ে কবিতাটা ‘ভালো হয়েছে’ বলেছিলেন।
সেটা যে কতবড় মিথ্যা কথা ছিল, তা এখন বেশ বুঝতে পারি। আর ভাবি, কি ভাগ্যিস, এই কবিতা পড়ার পরেও তিনি বেশ কয়েক বছর বেঁচেছিলেন।
তবুও, যতই মিথ্যা হোক, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ভালো বলেছিলেন, এটা কি জীবনের কম বড় প্রাপ্তি! আপনারাই বলুন না।