নিছক একটি পুজো নয়। বাঙালির আবেগের সঙ্গে, তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছে সরস্বতী। স্মৃতির সরণি বেয়ে তেমনই দুষ্টুমিমাখানো কোলাজ। উঠে এল বেঙ্গল টাইমসে।
কাকু, সরস্বতী পুজোর চাঁদা টা,
‘তোদের কোন ক্লাব রে’,
‘কাকু তরুণ সংঘ’,
‘কতবার নিবি, কালকেই তো নিয়ে গেছিস, আর কতগুলো তরুণ সংঘ আছে বলতো.?’
‘ও–ও, ঠিক আছে, ঠিক আছে। কিন্তু আমাদেরটাই সবথেকে পুরোনো……!’
এই চাঁদা কাটা থেকেই শুরু হতো আমাদের ছোটো বেলার সরস্বতী পুজো……
প্রত্যেকটা পাড়ায় কিছু খচড়া টাইপের কাকু থাকতো যারা চাঁদা দিতে চাইতো না, ‘কালকে আসবি’, কখনও ছেলেমেয়েদের দিয়ে ‘বাবা বাড়িতে নেই’, এইসব বলে কেটে যাওয়ার চেষ্টা করতো।
কতকগুলো একটু বেশি বিজ্ঞ বিজ্ঞ কাকু বা জ্যেঠু থাকতো, তারা ‘তোদের স্কুলের হেডস্যার কি এখনও ভক্তিবাবুই আছে.?’,
কিংবা ‘আগে সরস্বতীর বানানটা বল’ দিয়ে শুরু করতো।
আমরা নিজেদের মধ্যে ‘এই তুই বল, তুই বলনা, তুই তো স্কুলে প্রথম বেঞ্চে বসিস’, (প্রথম বেঞ্চে বসা ছেলেরা যেন সর্বজ্ঞ)
শেষে ‘কাকু বীণাপানি বানানটা বলে দিচ্ছি, পাঁচ টাকা দিয়ে ছেড়ে দিন’,
কতকগুলো কাকিমা, ‘ওমা কতো বড়ো হয়ে গেছিস, তোর মাকে আসতে বলিস, তোরা পুজো করছিস, খুব ভালো, আমি আসবো, হ্যাঁ’...
‘কাকিমা চাঁদাটা./’
‘চাঁদা তো আমি দিতে পারবো না রে, তোরা তো জানিস টাকা পয়সা আমার কাছে থাকে না, ওর বাবাই রাখে, কালকে আসিস…
ফচকেমি আমরাও করতাম, এক ভদ্রলোকের নাম ছিল ফটিক (পদবিটা লিখলাম না, কারণ এগুলো সত্য ঘটনা, মানহানির মামলা না করে দেয়)।
এখনও মনে আছে, চাঁদার রশিদে ওনার নাম লিখেছিলাম
এভাবে- ফTIK. ☺
অন্ধকারে বুঝতে পারেননি, বুঝতে পেরে পরের দিন লুঙ্গি পরে ক্লাবে এসে অনেক হম্বিতম্বি করে গেছিলেন। কে লিখেছিল সেই মামলাটা আজ অব্দি সেটল হয়নি।
যারা চাঁদা দিত না, তাদেরকে টার্গেট করা হতো পুজোর আগের দিন রাতে অভিযান চালিয়ে, ফুল চুরি, ইঁট চুরি, বাগানের ফুলকপির শেকড় কেটে আবার পুঁতে দেওয়া, সাইকেল পাঞ্চার, ছোটখাট অপরাধ যেগুলো ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের আওতায় আসতো না সেগুলো করে।
এই ধরনের চিবিয়ে চিবিয়ে মিনমিন করে কথা বলা লোকগুলো সামাজিক না হলেও একটু শৌখিন টাইপের হতো, লুঙ্গি না পরে সাদা পাতলুন পরতেন, বাড়ির বাগানে গাঁদা ফুল, ফুলকপি, পালং শাক, ছাদে লাউ কুমড়ো লাগাতেন (কিন্তু কাউকে দিতেন না)।
দিনের বেলায় সার্ভে করে (কার বাগানে কী আছে), রাতের বেলায় পাঁচিল টপকে এই সব হর্টিকালচারে অ্যাটাক করা হতো,
সবাই এক্সপার্ট থাকে না সবকাজে, তাই কে কে যাবে, Right Person for the Right Job খুঁজে তাদের কেই পাঠানো হতো,
পরের দিন পুজো মন্ডপে দেখতাম, সকাল সকাল সেই রসকসহীন কাকুরা এসে, মা সরস্বতী না, নিজের বাগানের ফুল গুলো খুঁজতো,
‘এই শোন, ওই থোকা গাঁদা আর রক্তকরবী গুলো কোথায় পেলি রে’, (আহা, কী আবদার, যেন এই বলে দেবো আর কী, ‘হ্যাঁ কাকু, ওগুলো আপনার বাগানেরই মাল’, তাই কী হয়, কাকু…?)
একটা দমফাটা হাসি আটকে রেখে বলতেই হতো, ‘কী জানি কাকু বলতে পারবো না, কেউ দিয়ে গেছে বোধহয়,’ (সঙ্গে একটু সহানুভূতি) ‘কিন্তু কেউ যদি আপনার বাগান থেকে না জানিয়ে নিয়ে থাকে তাহলে সেটা একেবারেই অনুচিত কাজ’
(নির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারতেন না কাকুরা)
কার বাড়ির থেকে একবার ইঁট নিয়ে আসা হয়েছিল। সে ঠিক ধরে ফেলেছিল। এসে বলেছিল, ‘ইঁটগুলো নিয়ে এসেছিস ঠিক আছে, বেদীটাও বানিয়েছিস ঠিক আছে, কিন্তু বিসর্জনের পর ইঁটগুলো চুপচাপ বাড়িতে ফেরত দিয়ে আসবি, আমার সব গোনা আছে’। বুঝলাম, আমরা গাছে চললে, এ চলে পাতায় পাতায়। অনেকের বাড়ির দেওয়ালে রাতারাতি চুনকাম করে দেওয়া হতো। তখন কী আর জানতাম, এতে তাঁদের উপকারই করে দিচ্ছি ফ্রি–তে রঙ করে দিয়ে……
সত্যি, আমাদের কে কেউ শেখায় নি অনেক কিছু, নিজেরাই শিখেছি, Management, Team Work, Job Assignment, Surgical Strike মিষ্টি করে মিথ্যা কথা বলা...
পরের দিন পুজো, উপোস (বাঙালি উপোস, এগারোটা বারোটা পর্যন্ত), অঞ্জলি (চোখ বন্ধ করেও আড়চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ‘কাউকে’ একটু খোঁজা ), কুল খাওয়া (সরস্বতী পুজোর আগে নাকি কুল খেতে নেই), টাইম পেলে স্কুলে যাওয়া আর বাঙালিদের চিরাচরিত মেনু – খিচুড়ি, বাঁধাকপি, চাটনি, বোঁদে খেয়ে আসা, সন্ধেবেলায় শঙ্খ আর উলুধ্বনী প্রতিযোগিতা, মনে করে ইংরেজি, অঙ্ক আর বিজ্ঞান বইগুলো মায়ের পায়ে ঠেকানো, বইয়ের মাঝখানে ফুল রেখে দেওয়া…, আর বিসর্জনের দিন মিঠুনের ডিস্কো ডান্সার গানে নাচা… এই ছিল আমাদের সরস্বতী পুজো।
এখনও পুজো আছে। আছে শাকালু, শরকাঠি, চক দিয়ে হাতেখড়ি, অঞ্জলি…
‘নাও মা সরস্বতী পুষ্পের ভার, দাও মা সরস্বতী বিদ্যার ভার’
নেই শুধু সেই বাঁধাকপির টেস্ট, থোকা থোকা গাঁদার বাগান, ফচকেমি, খচড়া কিন্তু সৎ আদিখ্যেতাহীন কাকু জ্যেঠুগুলো।
আর
অঞ্জলি দেওয়ার সময় ‘কাউকে’ খোঁজার সেই চাপা উৎসাহ, ছটপটানি… সেই অস্থিরতা…
সূর্য ডুববে একদিন, সকাল এখন বিকেল… জীবনের বয়স বাড়ছে……
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনেপ্রাণে তরুণ থাকি না…… বুড়ো হয়ে কি লাভ…??? যদিও আমার গিন্নি ভালোবেসে আমায় বুড়ো বলে ডাকে….!!!
(হোয়াটসঅ্যার মারফত সংগৃহীত। লেখকের নাম জানা নেই। তবে অনেকের স্মৃতির সঙ্গে মিলে যাবে। লেখাটা পড়ে অনেকেই হারিয়ে যেতে পারেন ছেলেবেলায়।)