পাহাড়ের অচেনা ঠিকানা, তিনচুলে

কোলাহল থেকে দূরে, নির্জন এক পাহাড়ি গ্রাম। মন মাতাল করে দেওয়া দৃশ্য। দেখে এলেন রূপম রায়।

বছর তিনেক আগে একটা বাংলা ছবির পোস্টার দেখেছিলাম। মন যে করে উড়ু উড়ু। না, ছবিটা দেখা হয়নি। তবে পোস্টারে যা ছিল, তা আমারও মনের কথা। আমারও মনটা কেমন যেন উড়ু উড়ু করে। একবার ঘুরে এলেই যে সেই উড়ু উড়ু ভাব কমে, এমন নয়।আবার কবে যাব, তার অপেক্ষায় দিন গোনা।
আমার মতো অনেকেরই পায়ের তলায় সর্সে। এখনই হয়ত অনেকে পুজোর ভ্রমণ নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। কুন্ডু স্পেশাল, ব্যানার্জি স্পেশাল বা অন্যান্য ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে হয়ত খোঁজ নিচ্ছেন। সেই গরম আর নেই। লাগামছাড়া বৃষ্টিও হয়ে গেল। কিন্তু আপনি তো এখনই যাচ্ছেন না। যখন যাবেন, বৃষ্টির চোখরাঙানি থাকবে না। তাহলে, পাহাড় থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়! ঠান্ডা মানেই কেউ ভাবছেন কাশ্মীর, কেউ সিমলা, কেউ বা মানালি। কেউ হয়ত বুকিং করেও ফেলেছেন। না, তাঁদের বুকিং বাতিল করতে বলব না। কিন্তু যাঁরা এখনও বুকিং করেননি, বা যাঁদের ভিনরাজ্যে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, বা হাতে লম্বা ছুটি নেই, তাঁদের জন্য বরং একটা জায়গার হদিশ দেওয়া যাক।

দূরে কোথাও নয়। ভিনরাজ্যেও নয়। এই বাংলাতেই। নিশ্চয় দার্জিলিং! না, ঠিক তাও নয়। তবে খুব কাছাকাছি। আর ভনিতা না করে নামটা বলেই দেওয়া যাক- তিনচুলে। নামটা চেনা চেনা লাগছে ? যাঁরা বেড়ানোর ব্যাপারে খুব খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা হয়ত নাম শুনেছেন। যাঁরা শোনেনননি, তাঁদের হীনমন্যতায় ভোগার কিছু নেই। কারণ, বাংলার পর্যটন মানচিত্রে তিনচুলে তেমন বিখ্যাত নাম নয়।

tin chule3

নিশ্চয় ভাবছেন, কীভাবে যেতে হয়। কোথায় থাকার জায়গা ? খরচ কী রকম ? এসব কথায় না হয় পরে আসছি। তার আগে বরং জেনে নেওয়া যাক, কী পাবেন এই তিনচুলেতে গিয়ে ? একেবারে নির্জন এক পাহাড়ি গ্রাম। বিছানায় হেলান দিয়ে দেখুন সপারিষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা। কংক্রিটহীন জঙ্গলের স্নিগ্ধতা। সারাদিন পাখির কিচিরমিচির, সেই কলতানেই ঘুম ভাঙা। ছায়া সুনিবিঢ় পথে হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। সবচেয়ে বড় পাওনা সহজ সরল পাহাড়ি মানুষের আতিথেয়তা।
অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল, এই তিনচুলেতে যাওয়ার। কিন্তু যাওয়া আর হয়ে উঠছিল না। একসঙ্গে তিন বন্ধু। অবাধ গণতন্ত্র মানেই শতপুষ্প বিকশিত হোক। কেউ পাহাড়, তো কেউ জঙ্গল। কেউ নদী তো কেউ সমুদ্র। কেউ চেনা জায়গার খোঁজে, তো কেউ চাইছে নিরালা। গণতন্ত্রে নাকি সংখ্যাগরিষ্ঠতাই শেষ কথা বলে। কিন্তু কোন প্রশ্নেই বা ভোট হবে ? একেক প্রশ্নে একেকরকম মেরুকরণ। তাছাড়া, বেড়াতে যাওয়া নিয়ে ভোটাভুটি এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। বেশ, জায়গা নিয়ে না হয় একমত হওয়া গেল। কিন্তু ছুটি নিয়েও তো হাজার সমস্যা। এর হয়, তো ওর হয় না। শেষমেষ বেরিয়ে পড়া গেল। আমি, আমার বাল্যবন্ধু সন্তু, স্কুলের সহশিক্ষক দেবাশিস আর ফটোগ্রাফার বন্ধু সঞ্জয়। প্রত্যেকেই কম-বেশি বর্ণময় চরিত্র। প্রথমে ধরতে হবে শিলিগুড়িগামী যে কোনও ট্রেন। আমরা অন্য ট্রেনের টিকিট না পাওয়ায় নিতে হয়েছিল কামরূপের টিকিট।

tin chule.rupam5

এন জে পি-তে ট্রেন পৌঁছলো একটু দেরিতে, সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। না, স্টেশনে নেমে গাড়ি খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। কারণ, তিনচুলেতে যাঁর বাড়িতে আমরা থাকব, সেই অভিরাজকে আগে থেকেই ফোনে বলা ছিল। সে বলেছিল, কোনও চিন্তা নেই। আমি স্টেশনেই গাড়ি পাঠিয়ে দেব। শুধু পাঠিয়ে দেওয়াই নয়। ড্রাইভারের ফোন নম্বর আমাদেরকে এবং আমাদের ফোন নম্বর ড্রাইভারকে আগাম জানিয়েও রেখেছিল। মোবাইলের সৌজন্যে ড্রাইভার রাজা রাইকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হল না। রাজাকে দেখেই আঁতকে উঠলাম। এ তো অবিকল বিমল গুরুংয়ের মতো দেখতে। বিপদে পড়লে গুরুংয়ের ভাই বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায় (তাতে অবশ্য বিপদ আরও বেড়ে যাতেও পারে)। রাজা রাইকে সে কথা বলতেই ওর মুখে চওড়া একটা হাসি। কিন্তু হাসতে হাসতে শুরুতেই যা শোনালো, আমাদের হাসি শুকিয়ে গেল। ভোরে আসার সময় নাকি তার গাড়ির সার্কিট পুড়ে গেছে। ফলে, হর্ন, আলো, ইন্ডিকেটর কিছুই কাজ করছে না। শুধু তাই নয়, না ঠেললে নাকি স্টার্টও দেওয়া যাবে না। একে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা, তার উপর যদি গাড়ির এই দশা হয়, তাহলে তো সর্বনাশ। রাজাভাই আশ্বস্ত করল, চিন্তা নেই। ভরোসা রাখিয়ে। ওর হাসিই বলে দিল, ওর ওপর ভরসা রাখাই যায়।
আমরা বললাম, কিছু তো খাওয়া হয়নি। কোথাও একটা দাঁড়িও। রাজাভাই বলল, দাঁড়ালে কিন্তু আবার ঠেলা মারতে হবে। তবে তিন্তা নেই। কোনও ঢালু জায়গা দেখে দাঁড়ানোই যায়। কোথায় দাঁড়াবে, সেটা রাজাভাইয়ের উপরেই ছেড়ে দিলাম। সেবক পেরিয়ে, তিস্তার পাশ দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। ডানদিকে উত্তাল তিস্তা। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে আমাদের গাড়ি। কালিঝোরায় গিয়ে থামল রাজাভাই। একসঙ্গে প্রাতরাশ হয়ে গেল। কালিঝোরা নানা কারণে বিখ্যাত। অনুসন্ধান ছবির শুটিংয়ের সময় এই কালিঝোরার বাংলোতেই দিন পনেরো ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। বাইরের পর্যটকদের কাছে এই তথ্যটাও একটা ভাল বিজ্ঞাপন। এবার কালিঝোরা থেকে রওনা। তিস্তাবাজার ছাড়িয়ে গেলাম পেশকের দিকে। একটু একটু করে ঠান্ডা এসে লাগছে। দেবাশিস, বেচারা আগের রাতে ট্রেনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই ওর ভীতি থাকা স্বাভাবিক। পেশক পেরোতেই গায়ে গরম জামা দিয়ে ফেলল। পেশক পেরোতে কি পোশাকের কথা মনে পড়ল? কী জানি, হতেও পারে। তবে, একটু হিমেল হাওয়া আসছিল, এটা ঘটনা। বুঝলাম, এবার আমাদেরও শীতবস্ত্র বের করতে হবে। লোপচু আর তাকদা পেরোতেই আমরাও শীতবস্ত্রে নিজেদের ঢেকে নিলাম। এই তাকদায় দারুণ একটা বাংলো হয়েছিল। হঠাৎ কী খেয়াল হল, গুরুংয়ের দলবল সেটা পুড়িয়ে দিল। এতে কার লাভ হল ? বিমল গুরুংরা যদি বুঝত, তাহলে আর ভাবনা ছিল না।

tin chule5

তাকদা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পেরোনোর পর রাজাভাই আমাদের বলল, রঙলি টি এস্টেটে একটু ঘুরে নিতে পারেন। আমরা তো এককথায় রাজি। পাহাড়ি রাস্তা এমনিতেই সুন্দর, গাড়ি ঘোড়া এদিকটায় তেমন নেই বললেই চলে। রাস্তার দুপাশে চোখ জুড়িয়ে দেওয়া চা বাগান। চা বাগানের গালিচা বলাই ভাল। মাথার উপর নীল আকাশ। হাত বাড়ালেই মেঘের আনাগোনা। সন্তুর কণ্ঠে তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা—বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস , এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে। দেবাশিস অঙ্কের মাস্টারমশাই বলে কবিতা বুঝবে না, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। মেঘ দেখে তারও মন উদাস । কার কথা ভাবছে !
মেঘের বুক চিরে গাড়ি ছুটল তিনচুলের দিকে। গ্রামে ঢোকার আগে এই সুযোগে রাজাভাইয়ের ফোন নম্বরটা দিয়ে রাখা যাক। ৯৭৩৩১ ২৮২২৬। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে গুরুং গেস্ট হাউস। এই রে! এখানেও গুরুং! আর গুরুং বলতে তো ওই একটা মুখই মনে পড়ে। এই গেস্ট হাউসের নম্বর নেব নেব করেও নেওয়া হয়নি। আমাদের ব্যবস্থা অবশ্য অভিরাজের ভান্ডারি অ্যাকমোডেশনে। ফোন নম্বরটা চটপট লিখে নিন ৯৭৪৯৩ ৭০৯৬৫। পাঁচটি ঘর। আমাদের জন্য দুটো আগাম রেখে দিয়েছিল অভিরাজ। ফোনে কয়েকবার কথা হলেও অভিরাজকে এই প্রথম দেখলাম। বয়স মোটামুটি তিরিশের মতো। মুখে হাঁসি লেগেই আছে। টুরিস্ট নয়, যেন শহর থেকে আত্মীয় এসেছে। অভিরাজের মা, বাবা, দিদি, জামাইবুরাও একসঙ্গেই থাকেন। সবমিলিয়ে অতিথি দেখভালের সব দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে এই পরিবার। আমাদের ঘরে বসিয়ে কে কী খাবে জেনে অভিরাজ চলল ব্যবস্থা করতে। নিশ্চয় ভাবছেন খুব খরচ। না, তেমন নয়। থাকার খরচ ঘরপিছু আটশো থেকে হাজার টাকা। সিজনের সময় একটু বেশি। খাবার খরচ সারাদিনে মাথাপিছু চারশো টাকার মতো। ব্যাস, আর আপনার কোনও চিন্তা নেই। বাকি সব দায়িত্ব অভিরাজের। আপনি শুধু মন দিয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করুন।

tin chule4

হঠাৎ গ্রামের নাম তিনচুলে কেন ? যা অনুমান করেছিলাম, তাই। চুলে মানে চুলা বা ওভেন। তিনটি পাহাড় আগে একসঙ্গে দেখা যেত। কিন্তু এখন গাছপালা বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা ঢেকে গেছে। দূর থেকে তিন পাহাড়কে দেখে মনে হত, যেন তিনটি চুলা জ্বলছে। তাই নাম তিনচুলে। দার্জিলিং থেকে তিনচুলের দূরত্ব মাত্র তিরিশ কিলোমিটার। কিন্তু দার্জিলিং যেমন ভিড়ে ঠাসা, এখানটা ততটাই নির্জন। ছোট্ট এই জনপদে চাষবাস বেশ ভালই হয়। ইকো টুরিজমের দিকেও ঝুঁকছেন এলাকার মানুষ। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফেডারেশন থেকে নানা ব্যাপারে সাহায্য পায় এই গ্রাম। পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় সানরাইজ ভিউ পয়েন্টে। অবশ্য, গোটা গ্রামটাই একটা ভিউ পয়েন্ট। একেক জায়গায় যেন একেক রকম সৌন্দর্য। বিরাট কিছু মেঘ না থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব একটা দুর্লভ বস্তু নয়। ঝলমল করবে সেই বরফশৃঙ্গ। একেক সময় একেক রঙে হাজির হবে কাঞ্চনজঙ্ঘা। খুব কাছেই গুম্বাদারা ভিউ পয়েন্ট। কালিম্পংও দূরে নয়। আরেকটু নিচের দিকে তাকালে পাহাড়ের বুক চিরে যেন চলে গেছে উত্তাল তিস্তা নদী। মনে পড়ে গেল শ্রীকান্তর সেই গানের কথা, ‘মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকূল হলে তিস্তা।’ কার মন কার জন্য ব্যাকূল, সে না হয় গোপনই থাক।

tin chule7
শুধু মুগ্ধতা নয়, পাহাড়ের নানা বাঁকে ছড়িয়ে আছে নানা ইতিহাস। যেমন, এই গুম্বাদারা রকের কথাই ধরুন। প্রায় দুশো বছর আগে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এখানেই নাকি আশ্রয় নিয়েছিল লামারা। ব্রিটিশরাও প্রায়ই আসতেন এই গুম্বাদারা রকে। এখানেই নাকি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। ঘুরে আসতে পারেন বড় মাঙ্গোয়ায়, কমলালেবুর বাগানে। থরে থরে যেন সাজানো কমলালেবু এক দুটো পাড়তে চাইলে কেউ বাধা দেবে না। শুধু লেবু নয়, স্কোয়াশ বা জ্যাম-জেলি তৈরির কারখানাও পেয়ে যাবেন হাতের কাছেই। কীভাবে গাছের কমলা থেকে জ্যাম, জেলি হচ্ছে, নিজের চোখেই দেখে আসুন।
অফিসের ব্যস্ততা তো সারাজীবন রইল। পরীক্ষার টেনশন, সংসারের নানা জটিলতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন- এগুলো থেকে কি মুক্তি আছে ? আছে, যদি আপনি সবকিছু ভুলে এই তিনচুলেতে আসেন। অজানা, অচেনা পাখির কুজন, দূরে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিঁদুররাঙা আকাশ, হাতের সামনে সবুজ চা বাগানের উদ্দাম ঢেউ আপনার মনকে দু-দন্ড শান্তি দিয়ে যাবে। তাহলে আর বেশি ভেবে কাজ নেই। ট্রাভেল এজেন্টদের দরজায় ঘুরে লাভ নেই। ফোন করুন অভিরাজকে। সোজা চলে আসুন তিনচুলে।

(বেঙ্গল টাইমসে আগস্ট থেকে ভ্রমণকে আরও গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিছু আমন্ত্রিত লেখা। সেইসঙ্গে পাঠকরাও লেখা পাঠাতে পারেন। কোথাও ঘুরে এলে সেই ভ্রমণকাহিনি পাঠিয়ে দিন বেঙ্গল টাইমসে। সঙ্গে ছবিও পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ bengaltimes.in@gmail.com)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.